Saturday, June 18, 2016

ওবামার ভারত সফর: অস্ত্র প্রতিযোগিতাই বৃদ্ধি পাবে



ফিরে দেখা     
ওবামার ভারত সফর: অস্ত্র প্রতিযোগিতাই বৃদ্ধি পাবে 
 আলী ফোরকান
জার্মানি যেভাবে সমৃদ্ধ, বিকশিত ও সম্প্রসারিত হয়েছে। এতে ইউরোপ তথা বিশ্বের জন্য হুমকিতে পরিণত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র চীনের অর্থনৈতিক বিকাশ ও সমৃদ্ধিকে ঠিক একইভাবে দেখছে। সেই প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাম্প্রতিক ভারত সফর শুধু দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার লক্ষ্যে কিছু চুক্তি সম্পাদনের জন্য ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান উদ্বেগ হল, কিভাবে এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান আধিপত্যকে সামাল দেবে। মার্কিন নেতৃবৃন্দ মুখে যতই ইসলামকে ‘মহান ধর্ম’ এবং বিভিন্ন মুসলিম দেশকে ‘মডারেট’ বলে সার্টিফিকেট দিক না কেন। যুক্তরাষ্ট্র বাস্তবে ইসলাম এবং বিকাশমান চীনকে ভয় করছে। এশীয় অঞ্চলে জাপান ঐতিহ্যগতভাবে ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে থাকলেও এখন জাপান আর সে ভূমিকা পালন করতে পারছে না। সে কারণে এশিয়ায় চীনের সম্ভাব্য আগ্রাসন ঠেকাতে ভারতকে কাছে টানা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বিকল্প নেই।
ওবামার ভারত সফর নিঃসন্দেহে দেশটির নেতৃবৃন্দের নৈতিক মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর দীর্ঘকাল ভারত কোনো পরাশক্তিকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পায়নি, বরং চীনের ‘শীতল হুমকি’র মুখোমুখি ছিল; যে হুমকি এখনো বিদ্যমান বলে ভারত মনে করে। চীন সরকারিভাবে যে অনলাইন ম্যাপিং সার্ভিস চালু করেছে তাতে ভারতের অরুণাচল, হিমাচল ও লাদাখের আকসাই চীন এলাকাকে চীনের ভূখন্ড হিসেবে দেখিয়েছে। এটা চীন যে শুধু এবারই দেখাল তা নয়, পুরো এলাকাকে তারা দীর্ঘ দিন ধরে নিজেদের বলে দাবি করে আসছে। তাদের মতে, অরুণাচল প্রদেশ আসলে দক্ষিণ চীন। যা ভারতের জবরদখলে রয়েছে। ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল শংকর রায় চৌধুরী দি এশিয়ান এজ-এ এক নিবন্ধে চীনের দাবিকে অরুণাচলের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার সমস্যা বলে উল্লেখ করেছেন। ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল ভি কে সিং গত বছরের ১৯ অক্টোবর দিল্লিতে এক সেমিনারে চীন ও পাকিস্তানকে ভারতের প্রধান নিরাপত্তা হুমকি বলে উল্লেখ করেন। সে কারণে ভারত নিজের নিরাপত্তার জন্য তিব্বতকে বাফার জোন হিসেবে দেখতে চায়। ভারত তিব্বতের স্বাধীনতার পক্ষে। আর চীন তিব্বতকে নিজ ভূখন্ডের অংশে পরিণত করেছে। এ বিরোধ অনেকটাই নিপত্তির অতীত।
যুক্তরাষ্ট্র চীনের মোকাবেলায় ভারতকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে দেখতে চায়। ওবামা ভারত সফরকালে ঘোষণা করেছেন, এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে পূর্ণ সমর্থন দেবে। এ ঘোষণার আগে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের কাছে যুক্তরাষ্ট্র নিজ অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য বৃদ্ধি করতে হলে জাতিসংঘের কাঠামোতে যে সংস্কার করতে হবে সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে যে, এটা জাতিসংঘের নিজস্ব ব্যাপার। তারা যে প্রক্রিয়ায় অন্যান্য বিষয়ে সংস্কার করে থাকে, এ ক্ষেত্রেও একইভাবে সংস্কার করবে। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে শুধু চীন এখন পর্যন্ত ভারতের স্থায়ী সদস্যপদের ব্যাপারে কোনো মতামত ব্যক্ত করেনি। অনেকে মনে করেন, ভারতের স্থায়ী সদস্যপদের প্রস্তাবে চীন ভেটো দেবে, কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্টের জোরালো সমর্থন ঘোষণার পর চীন এখন পর্যন্ত নেতিবাচক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি; বরং চীনের বক্তব্য ও পদক্ষেপ অনেকটাই ভারতকে আশাবাদী করার মতো। ওবামার ঘোষণার পর চীন নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত-কে ভাইস মিনিষ্টারের পদে উন্নীত করেছে। যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্রে নিয়োজিত চীনের রাষ্ট্রদূতরা ভাইস মিনিষ্টারের পদমর্যাদা ভোগ করে থাকেন।
এ ছাড়া চীনের পররাষ্ট্র দফতর থেকে ওবামার ঘোষণার পর যে প্রতিক্রিয়া দেয়া হয়েছে, সেটিও যথেষ্ট ইতিবাচক বলে ধরে নেয়া যায়। চীনা পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন, চীনের এই সদিচ্ছা সত্তে¦ও ভারত ও চীনের মধ্যে যে সীমান্ত বিরোধ বিদ্যমান। তা শিগগিরই দূর হবে, এমনটি আশা করা বোধহয় সঠিক হবে না। ১৯৬২ সালে সীমান্ত সংঘর্ষের পর উভয় দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন পর্যন্ত যে শীতল সম্পর্ক ছিল, তা কিছুটা উষব্ধ হলেও ঘনিষ্ঠতার পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। চীন যেমন ভারতকে তার ভূখন্ডের দখলদার হিসেবে বিবেচনা করছে। ভারতও অনুরূপ চীনের দিক থেকে হামলার আশঙ্কামুক্ত হতে পারছে না। সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় অস্ত্র মজুদ করার পাশাপাশি ভারত তার এশীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নও আর গোপন রাখছে না। 
ভারতের এমন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার বিপরীতে চীন হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে, এমনটি ধারণা করা ঠিক হবে না। নয়াদিল্লিতে যখন ভারত-চীন সীমান্ত বৈঠক চলছিল, তখন বেইজিং ভিত্তিক বলেন, “এশিয়ায় নয়াদিল্লির ভারত-কেন্দ্রিক নীতি বাস্তবে হিন্দুস্থান-কেন্দ্রিক নীতি। কিন্তু ‘হিন্দুস্থান’ বলে কোনো কিছুর অস্বিত্ব নেই। দেশটির অনেক রাজ্যে বহুসংখ্যক ‘স্থানীয় কেন্দ্র’ বিদ্যমান। বহুবিধ স্থানীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে তথাকথিত ভারতীয় জাতিকে প্রকৃতপক্ষে এক জাতি হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। ইতিহাসে এমন ভারতীয় জাতির অস্তিত্ব কখনো ছিল না। মুসলিম ও ব্রিটিশ শাসনাধীনে একীভূত দেশটি বর্তমানে ‘ভারত’ নামে পরিচিত।”
নিবন্ধকারের মতে, ভারত যদি ঐক্যের জন্য কোনো কিছুর ওপর নির্ভর করে থাকে। তাহলে সেটি হলো হিন্দু ধর্ম। ১৯৪৭ সালে যার ভিত্তিতে দেশটি স্বাধীন হয়েছিল। সে হিসেবে ভারতকে একটি ‘হিন্দু ধর্মীয় রাষ্ট্র’ বলা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, হিন্দু ধর্ম একটি ক্ষয়িষব্ধু ধর্ম, এতে বর্ণ ও জাতগত প্রতারণা ও শোষণ রয়েছে; যা দেশটির আধুনিকতার পথে বড় অন্তরায়। তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেছেন যে, চীনের উচিত তার নিজের স্বার্থে এবং এশিয়ার অগ্রগতির স্বার্থে ভারতের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী যেমন অসমিয়া, বাঙালি, নকশাল, মারাঠি, পাঞ্জাবি, তামিল ও কাশ্মীরিদের সাথে মিলিত হয়ে এবং তাদেরকে সমর্থন দিয়ে ভারতের বাইরে তাদের নিজ্ব স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করা।
নিবন্ধে আরো বলা হয়, তিনি আরও বলেন, ‘ভারতকে বিভাজন করার লক্ষ্যে চীন তার প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানকে সাথে নিয়ে আসামের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য বাস্তবায়নে -কে এবং তামিল, নাগা ও কাশ্মীরিদের মতো জাতি-গোষ্ঠীগুলোর আকাক্সক্ষা পূরণে সাহায্য করতে পারে, ...এবং সবশেষে ভারত কর্তৃক অবৈধভাবে দখলকৃত দক্ষিণ তিব্বতের ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা, যাকে তারা অরুণাচল প্রদেশ নামে অভিহিত করে। সেই ভূখন্ড উদ্ধার করতে পারে।’
ভারতকে ইউরোপের মতো ২০ থেকে ৩০টি জাতিরাষ্ট্রে বিভক্ত করার আশা ব্যক্ত করে নিবন্ধকার উপসংহার টেনেছেন যে, ভারতের জাতি-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যদি সচেতনতা জাগিয়ে তোলা যায় তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় সামাজিক সংস্কার ও পরিবর্তন আনয়ন এবং বর্ণভেদ দূরীকরণের মাধ্যমে সমগ্র এলাকাকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়া সম্ভব।
এই অবস্থার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিপরীতে ভারতকে তার প্রভাববলয়ে নেয়ার ফলে এশিয়ায় উত্তেজনা হ্রাস পাওয়ার পরিবর্তে বরং বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হবে। ওবামার ভারত সফরকালে দুই দেশের মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলারের যে বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে, তার বাইরেও এ সফরের আরেকটি অগ্রাধিকার ছিল ভারতের কাছে ২৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক উপকরণ বিক্রয়। যার সূচনা হয়েছিল ২০০১ সালে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলারে ১৪৫টি কামান, ৪.৫ বিলিয়ন ডলারে ১০টি হেভি লিফট এয়ারক্রাফট, ২ বিলিয়ন ডলারে আওয়াকস রিফুয়েলিং সিষ্টেম, ৮৮০ মিলিয়ন ডলারে ক্লাটার বোমা ক্রয় করবে। এ ছাড়া ভারতের সামরিক ক্রয় তালিকার মধ্যে আগামী ১০ বছরে ১২ থেকে ১৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যে ৬০০ হেলিকপ্টার আর তিন হাজার ৬০০ কামান রয়েছে। গত বছর ভারত ২.১ ডলার মূল্যে লং রেঞ্জ মেরিটাইম রিকনাইসেসের অর্ডার দিয়েছে ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বজায় রাখার প্রস্তুতি হিসেবে।
ওবামার সফরের মধ্যে ‘না বলা’ অনেক কিছু রয়ে গেছে। যা প্রাথমিকভাবে উপমহাদেশের জন্য এবং ব্যাপকভাবে এশিয়ার জন্য বিপদের বার্তা বয়ে আনবে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ‘এশীয় কূটনীতির কেন্দ্রে’ পরিণত করার নামে দেশটিকে যেভাবে অস্ত্রসজ্জিত করছে, তা ইতোমধ্যে ভারতের প্রতিবেশী পাকিস্তানকে ক্ষুব্ধ করেছে। পঞ্চাশের দশক থেকে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে যে মৈত্রী ছিল, তা সোভিয়েত ব্লকে থাকা ভারতের জন্য ছিল ঈর্ষণীয়। আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্যদের বিতাড়নে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধেও পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রকে সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে আগামী শতকের হিসেবে ঘোষণা করায় পাকিস্তান হতাশ। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দফতর এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, ‘ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতার রাজনীতিতে মেতে উঠেছে। যার নৈতিক কোনো ভিত্তি নেই’।
ভারত-মার্কিন সম্প্রীতি এশিয়ায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হলে কারো আপত্তি থাকার কথা ছিল না। কিন্তু প্রাথমিক আলামতই বলে দিচ্ছে যে, এর ফলে এ অঞ্চলে অস্থিরতা ও অস্ত্র প্রতিযোগিতাই শুধু বৃদ্ধি পাবে।

0 comments:

Post a Comment