Saturday, June 18, 2016

ভারত - চীন সম্পর্ক

ভারত - চীন সম্পর্ক
আলী ফোরকান
হিমালয় পর্বতমালার দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে নয়নাভিরাম তাওয়াং উপত্যকা। জায়গাটা পড়েছে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে। তাওয়াং উপত্যকার মানুষের কাছে চীন-ভারত যুদ্ধের স্মৃতি এখনো তরতাজা। ওই যুদ্ধের স্মৃতি ভারতীয়দের কাছে হয়তো একটু বেশিই জীবন্ত। কারণ ১৯৬২ সালে চীনা সেনাবাহিনীর হাতে বাজেভাবে মার খেয়েছিল ভারতীয় বাহিনী। পাশের তিব্বত সীমান্ত দিয়ে অভিযান চালানো চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মির হাতে প্রাণ দেয় তিন হাজারেরও বেশি ভারতীয় সেনা।
এখন তাওয়াংসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অরুণাচলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তিনটি কোর মোতায়েন রয়েছে। সব মিলিয়ে ওই তিনটি কোরের সেনাসংখ্যা প্রায় এক লাখ। রিজার্ভ রাখা হয়েছে আরও একটি কোর। শুধু স্থলসেনা নয়, পাশেরই আসামে গত বছর মোতায়েন করা হয়েছে কিছু সুখোই জঙ্গি বিমান। ’৬২-র তুলনায় এ বাহিনীর প্রস্তুতি সব দিকেই অনেক ভালো। সেবার ওই সীমান্তের ভয়াবহ ঠান্ডায় লড়তে পাঠানো ভারতীয় সৈন্যদের পরনে ছিল পাতলা সুতির ইউনিফর্ম যা তৈরি হয়েছিল পাঞ্জাবের গরমের জন্য!
১৯৬২ সালের সপ্তাহব্যাপী অভিযানে অরুণাচল প্রদেশের বড় একটি অংশ দখল করে নেয় চীনা সেনাবাহিনী। সেই সঙ্গে হিমালয়ের পশ্চিমাঞ্চলে কাশ্মীরের একটি অংশও। তবে ভারতীয়দের জন্য ভয়াবহ স্মৃতি সত্ত্বেও তাওয়াংয়ের অনেক প্রবীণ মানুষ চীনাদের মনে রেখেছে ভিন্নভাবে। অনেকেই বলেন, দুই সপ্তাহের চীনা দখলদারির সময় সাধারণ চীনারা তাদের ওই বছর খেতের গম ঘরে তুলতে সহায়তা করেছে। আলু চাষি মেম নানসে বলেন, ‘তারা ছিল ছোটখাটো মানুষ। কিন্তু সব সময় সাহায্যের জন্য প্রস্তুত। তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সমস্যা ছিল না।’
সেই যুদ্ধের এত দিন পর আজকের চীন-ভারত সম্পর্কও অনেকটাই এ রকম অম্লমধুর। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশেরই বাস এই দুই বিশাল প্রতিবেশী দেশে। ১৯৭৬ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হওয়ার পর দেশ দুটি ও তাদের মধ্যকার সম্পর্ক নানাভাবে রূপান্তরিত হয়েছে। পশ্চিম আকসাই চীন (কাশ্মীরের চীনা অংশ) নামের সুউচ্চ সমভূমির প্রতি নজর থেকেই মূলত ১৯৬২ সালে ভারতে অভিযান চালায় চীন। ওই সমভূমি জিনজিয়াং ও তিব্বতকে সংযুক্ত করেছে। এই অভিযানের পেছনে অবশ্য আরও অনেক কারণ ছিল। এর মধ্যে রয়েছে চীনের দুর্ভিক্ষ। দুই দেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতাও এই অভিযানের একটি কারণ। সম্পর্কে নানা অস্থিরতা সত্ত্বেও চীন ও ভারতের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্রমেই বাড়ছে। ১৯৯০ সালে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মাত্র ২৭০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু ক্রমাম্বয়ে তার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নিজ নিজ সমৃদ্ধির জন্যই আপাতত উভয় দেশকে পরস্পরের প্রতি সহযোগিতাপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আফ্রিকার তেল সরবরাহসংক্রান্ত দরপত্রের ব্যাপারে দুই দেশ পরস্পরের সঙ্গে সমন¦য়ের ভিত্তিতে কাজ করেছে। চীনের উৎপাদনশিল্প আর ভারতের সেবা খাতকে অনেকেই দুই দেশের মধ্যে আরও গভীর সহযোগিতার সুযোগ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। বিভিন্ন সময়ে নানা গুরুত্বপূর্ণ আর্šÍজাতিক ইস্যুতেও ভারত ও চীনকে একসঙ্গে কাজ করতে দেখা গেছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন নীতি ও বিশ্ব বাণিজ্যের মতো ইস্যুতে দুই দেশ একত্রে কাজ করেছে। ভারতীয় তৎ সময়ের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছেন, ভারত ও চীন কোনো প্রতিযোগিতার মধ্যে নেই। তিনি প্রায়ই বলে থাকেন, দুই দেশের জন্যই বহু অর্থনৈতিক ক্ষেত্র রয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওয়ের বক্তব্যও একই ধরনের। কোনো সন্দেহ নেই, দুই নেতাই তা বিশ্বাস করতে চান।
ভারত ও চীন উভয়েরই সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। অর্থনৈতিক অগ্রগতির কারণে দুই দেশের কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্যের কবল থেকে বেরিয়ে এসেছে। বিশেষ করে চীনে। তবে বিশ্বের খনিজ তেলের সঞ্চয় দওুত ফুরিয়ে আসায় তেল নিয়ে প্রতিযোগিতার কারণে দ্রুত বর্ধিষ্ণু দেশ দুটির বৈরিতা আবারও ফিরে আসবে এমন আশঙ্কা অনেক বিশ্লেষকেরই। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের আশঙ্কা, চীন রাতারাতি বিশাল পাইপলাইন তৈরি করে অনেক বেশি গ্যাস হাতিয়ে নিতে পারবে। নদীর পানিও দুই দেশের মধ্যকার বিরোধের অন্যতম ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রসহ উত্তর ভারতের অনেক বড় নদীর উৎপত্তি তিব্বতে। এসব নদীর পানির ওপর ভারতের কোটি কোটি মানুষ নির্ভরশীল। সম্প্রতি চীন ঘোষণা দিয়েছে, তারা ব্রহ্মপুত্র নদের পানি দিয়ে জলাধার তৈরি করবে। এতে ভারতীয়দের মধ্যে পুরোনো সেই আশঙ্কা আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে যে বেইজিং হয়তো চীনা কৃষকদের ব্যবহারের জন্য নদীগুলোর পানি সরিয়ে নিতে চাইছে।
ভূখন্ড নিয়েও দুই দেশের মধ্যে বড় ধরনের সমস্যা রয়ে গেছে। সীমান্তের উত্তরাঞ্চলে চীনের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিশাল একটি অংশকে ভারত নিজের বলে দাবি করে থাকে। ভারতের দাবি, ওই এলাকা লাদাখের অংশ। আয়তনে এটি সুইজারল্যান্ডের সমান। অন্যদিকে পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে ভারতের গোটা অরুণাচল প্রদেশসহ বিশাল একটি অংশকে নিজের বলে দাবি করে থাকে চীন। এসব নিয়ে এমনিতেই দুই দেশের মধ্যে নানা তিক্ততা আছে। তার ওপর উভয়ের সাম্প্রতিক কিছু কর্মকান্ড তিক্ততা আরও বাড়ানোর ঝুঁকি তৈরি করেছে। সম্প্রতি সীমান্ত এলাকায় অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন করেছে চীন। এতে সীমান্তে খুব দ্রুত সেনা মোতায়েন করতে পারবে দেশটি। অন্যদিকে ভারতও বসে নেই। তারা অরুণাচল প্রদেশে আরও ৬০ হাজার সেনা মোতায়েন করছে। আসামের বিমানঘাঁটিগুলোর উন্নয়ন কাজে হাত দেয় নয়াদিল্লি। বিমানঘাঁটিগুলোতে মোতায়েন করা হয় সুখোই জঙ্গি বিমান। দুই দেশের এসব পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা নিয়ে সরব গণমাধ্যমও। ভারতীয় গণমাধ্যমে সীমান্তবর্তী এলাকায় চীনের কর্মকান্ডকে হামলার সমতুল্য বলে অভিহিত করা হয়। অন্যদিকে বেইজিং থেকে প্রকাশিত ইংরেজি ট্যাবলয়েড গ্লোবাল টাইমস-এর সম্পাদকীয়তে ভারতকে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়, চীনের সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘাতের পরিণতি বহনের সামর্থ্য তাদের আছে কি নেই। সেটা ভারতের বিবেচনা করে দেখা প্রয়োজন। চীনের বিরুদ্ধে সাইবার হামলারও অভিযোগ করেছে ভারত। চলতি বছরের শুরুতে ভারতের তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও চীনে ভারতের বিশেষ দূত এম কে নারায়ণন অভিযোগ করেন, চীনা হ্যাকাররা তাঁর ওয়েবসাইটসহ ভারত সরকারের অন্যান্য বিভাগের ওয়েবসাইট হ্যাক করেছে। স্পর্শকাতরতা আছে দালাই লামা তথা তিব্বত নিয়েও।
তবে সবকিছুর পরও চীন-ভারত সম্পর্ক মানেই কেবল প্রতিযোগিতা বা বৈরিতা নয়। দুই দেশের মধ্যে মাঝেমধ্যে মৈত্রীর চিহ্নও দেখা যায়। গত বছর জাতিসংঘের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে চীন ও ভারত যে সংহতি দেখিয়েছে, তাতে দেশ দুটির কর্মকর্তারা পরস্পরের প্রতি কৃতজ্ঞ। বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ক্রমেই শিল্পায়িত হয়ে ওঠা চীন ও ভারতের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দাবিকে দুই দেশ একসঙ্গে মোকাবিলা করেছে।
সম্প্রতি নতুন একটি ইস্যু নিয়ে ভারত-চীন সম্পর্ক নতুন চাপের মুখে পড়েছে। চীন ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল বিসওয়ালকে ভিসা দিতে অস্বীকার করে। চীনের যুক্তি, বিতর্কিত কাশ্মীর তাঁর নেতৃত্বাধীন কমান্ডের অধীন। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীনের সামরিক প্রতিনিধিদলের ভারত সফর স্থগিত করে দেয় নয়াদিল্লি। নতুন এ ইস্যু সরগরম করে তোলে ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গন। কংগ্রেসের  সে সময়ের মুখপাত্র মনীশ তেওয়ারি বলেছেন, ‘চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চায় ভারত, কিন্তু সেটা একতরফা হতে পারে না। আত্মসম্মান বিকিয়ে কোনো সম্পর্ক নয়।’
গত বছর চীন ভারতীয় কাশ্মীরিদের পাসপোর্টে আলাদা কাগজ সেঁটে ভিসা দেওয়া শুরু করে। কাশ্মীরের বড় অংশই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত। এর একটি অংশের দাবিদার চীনও।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি অবশ্য চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ছিন্ন করার সম্ভাবনা বাতিল করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এমনিতে ভালো, যদিও মাঝেমধ্যে ‘সাময়িক সমস্যা’ দেখা দেয়।
বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের ওপর চীনের চাপ বাড়িয়ে চলার কারণ সম্পর্কে বিশ্লেষকেরা বলছেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তারে ভারত ও চীন একে অপরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ¡ী। দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ভারতীয় বাজারে থাবা বসাতে গিয়ে কিছু অসুবিধা হচ্ছে চীনের। দ্বিতীয়ত, ‘লুক ইস্ট’ নীতি দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারত এক বড় জায়গা নিয়েছে যা বেইজিংয়ের পছন্দ নয়। দুই দেশের সম্পর্কে সাম্প্রতিক টানাপোড়েনের এটাই মূল কারণ।

0 comments:

Post a Comment