Thursday, June 23, 2016

খুশির ঈদে ব্যথার অশ্রু

খুশির ঈদে ব্যথার অশ্রু
আলী ফোরকান
ঈদুল ফিতর। সবার ঘরে ঘরে আনন্দ। কিন্তু শেফালী, আকাশ, লাকি, বাবুল, সোহাগদের মত পথ শিশুদের জীবনে কোন খুশির বার্তা নিয়ে আসে না। দেশের প্রায় সাড়ে ৮ লাখ পথ শিশুর জীবনে এই দিনটি কাটে অন্যের মুখের পানে চেয়ে, তাদের করুণার পাত্র হয়ে। ‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা’ তাদের আবার ঈদ কিসের! ঈদের আর মাত্র  কয় দিন বাকি। ওরা আশায় বুক বেঁধে আছে। এই কয় দিনে বেচাবিক্রি একটু ভালো হলে সেই পয়সায় একটু নতুন জামা হয়তো কেনা যাবে! নয়তো কেউ তাদের জামা দিতে আসবে। যা পরে ওরা ঈদের দিন একট ঘুরে বেড়াবে। ঈদের দিনে অন্য আর দশটা শিশুর মতো ফিরনী, সেমাই খাবার বায়না নেই ওদের। ওরা অন্যসব দিনের মতোই রোজগারের আশায় ফুল, চকলেট বিক্রি করতে নামবে পথে; নয়তো বোতল টোকাবে। সকালে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে এসব শিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঈদ নিয়ে তাদের ভাবনার কথা। সাবিনার বয়স এগার। তার মা রাবেয়া বেগম খুব শখ করে সংগীত শিল্পীর নামে মেয়ের নাম রেখেছেন সাবিনা ইয়াসমিন। কিন্তু বাবার কথা, তার মেয়ের নাম হবে নবীজীর মেয়ের নামে ‘ফাতেমা’। শেষে বাবা-মায়ের একমাত্র আদরের সন্তানের পুরো নাম হয়, সাবিনা ইয়াসমিন ফাতেমা। সাবিনার বাবা মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাও অন্যখানে বিয়ে করে চলে গেছে । এখন সাবিনাকে দেখার আর কেউ নেই। বাবা-মায়ের স্নেহ সাবিনার জীবনে এখন শুধুই সুখস্মৃতি। ঈদের দিনে অন্যরা যখন সেজে-গুজে বেড়াতে বেরোবে, সাবিনা তখন ফুল বেচবে। কেউ দয়া করে কিনবে দুই এক ছড়া, কেউ দূরে সরিয়ে দেবে ধমক দিয়ে। ভৈরব কিশোরগঞ্জ মানিকদিতে বাড়ি লাকির। জšে§র পর কেউ তার নাম রাখেনি। গায়ের রং কালো বলে লোকে তাকে ডাকে ‘কালোনি’। নিজেই নিজের নাম দিয়েছে ‘লাকি’। বাবা পেঁপে বিক্রি করতেন, মা ভিক্ষা করেন, লাকি থাকে চানখাঁর পুলের ফুটপাতে। আগে ঘুমাতে গেলে পুলিশ ফুটপাত থেকে তুলে দিত, এখন আর দেয় না। লাকির ছোট ভাই সুমন। সেও চকলেট বেচে। দিনে ৩৫ টাকার মতো পায়, তবে লাকির ইচ্ছে, যদি ভালো বেচাবিক্রি হয় তাহলে ছোট ভাইটিকে একটি নতুন জামা কিনে দেবে সে। ঈদে কোরমা পোলাও কেউ যদি খেতে দেয় তাহলেই হয়তো খাওয়া হবে। নইলে নিত্যদিনের মতো এক বেলা খাওয়া, অন্য বেলা উপোস। ঈদের দিনে ভালো খাবার কিংবা নতুন জামার চাহিদা নেই সাত বছরের নীপা’র। ঈদের দিনও সে অন্য দিনের মতো চকলেট বেচবে। যা পাবে তা দিয়ে শুধু ভাত খাবে। মিরপুর রোডের মেট্রো শপিং মলের সামনে কথা হয় ৬ বছরের আকাশের সঙ্গে। একটা নতুন লাল জামার বড়ই শখ তার। দয়ালু একটা মেয়ে তাকে ৫০টি টাকা দিয়েছে। ৫০ টাকা পেয়ে আকাশের নীল দুটি চোখ খুশিতে চকচক করে উঠে। হয়তো এই খুশিটুকুই তার ঈদের আনন্দ! আকাশের সঙ্গী নয় বছর বয়সী হেলাল জানায়, ঈদের দিন পেটভরে পোলাও গোস্ত খাইতে মন চায়, আইসক্রিমও খাইতে মন চায়। আর কিছু চাই না। নতুন জামা কিনবে কিনা জানতে চাইলে হেলাল বলে, নতুন জামা কিনতে ইচ্ছে করে। কিন্তু জামা রাখমু কই। কামে গেলে জামা চুরি হইয়া যাইবো। হের লাইগা নতুন জামা কিনতে চাই না। তয় নতুন জামা পিনতে মন চায়। ঈদের দিনে পথশিশুদের আশা করে থাকতে হয়, কখন তাদের কেউ ডেকে একটু সেমাই কিংবা পোলাও খেতে দেবে। মায়ের হাতের খাবার তাদের ভাগ্যে জোটে না। পথশিশুদের জীবনে ঈদ কখনো খুশির ঈদ হয়ে আসবে না। তবুও তারা স্বপ্ন দেখে; আশায় বুক বাঁধে, হয়তো কোন হƒদয়বান ব্যক্তি তাদের জন্যে একদিন জামা-জুতা, ভালো খাবার নিয়ে আসবে! দারিদ্র্য আর না পাওয়ার মাঝে বেড়ে ওঠা ওদের জীবনে একটুখানি পাওয়াই অসীম আনন্দ বয়ে আনে। তবে ঈদের নতুন জামা বা ভালো খাবার খেতে না পারার জন্যে ওদের মনে কোন আক্ষেপ নেই। কারণ এটাই নিয়তি বলে ধরে নিয়েছে ওরা। ওরা জেনে গিয়েছে, কেউ খাবার জন্যে দিনভর কাজ করবে আর কেউ খাবার নষ্ট করবে। এটাই পৃথিবী।

0 comments:

Post a Comment