Thursday, June 23, 2016

শিশুশ্রম বন্ধে গণজাগরণ চাই

শিশুশ্রম বন্ধে গণজাগরণ চাই
আলী ফোরকান
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও কর্তৃক স্বীকৃত বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। ২০০২ সাল থেকে ১২ জুনকে বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রম নিরসনে বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে আন্দোলন দিবস উদযাপনের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে ও দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। তবে একটা প্রশ্ন সামনে আসে।বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা কি শিশুশ্রম নিরসনে এগিয়েছি, না পিছিয়েছি? বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন শিশুশ্রমের হার ক্রমাগত নিচের দিকে ধাবিত হচ্ছে সেখানে বাংলাদেশে এ হার বৃদ্ধি আমাদের শঙ্কিত করছে। বাংলাদেশে বর্তমানে শিশুশ্রম অন্যতম সামাজিক সমস্যা। শিশুশ্রমের ফলে শিশুদের মননশীলতা ও শারীরিক ক্ষতি হয় এবং মানসিক চাপ বাড়তে থাকে। অন্যদিকে শিশুরা আয়ের লক্ষ্যে তাদের বয়স ও লিঙ্গ অনুযায়ী বিপদ, ঝুঁকি, শোষণ, বঞ্চনা ও আইনগত জটিলতার সম্মুখীন হয়ে নিজকে নিয়োজিত করে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে জড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ৪৩০ ধরনের কাজে শিশুরা জড়িত।।এর মধ্যে ৬৭ ধরনের কাজই হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ। বেজ লাইন সার্ভে ইন লেবার সেক্টর ইন বাংলাদেশ  একটি গবেষণা প্রকাশ করে। যেখানে শিশুরা কাদের প্ররোচনায় এবং কেন শ্রমে নিয়োজিত হয় তা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে প্রায় ৬৬.৮ ভাগ শিশুশ্রমিক তাদের মা-বাবার অনুরোধে, ১৬.২ ভাগ সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে এবং ১৫.৬ ভাগ শিশুশ্রমিক তাদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমে কাজে নিয়োজিত হয়। প্রায় ৫০ ভাগ শিশুশ্রমিক শিক্ষাসংক্রান্ত খরচের কারণে এবং ১৯.৫ ভাগ কাজের জন্য স্কুলে যেতে পারে না। স্কুলে যেতে পারা মোট শিশুর ৯.৮% শিশুশ্রমিক বলে যে, তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার জন্য তাদের বাবা-মায়েরা তাদের স্কুলে পাঠায় না। শিশুশ্রমিকদের মধ্যে ৬২.৫% অশিক্ষিত, ১১.৭% সম্প্রতি স্কুলে যায় এবং ৬১.৪% শিশুশ্রমিক পঞ্চম শ্রেণীর নিচে পর্যন্ত পড়াশোনা জানে। শিশুশ্রমিকদের বাবা-মায়েদের মধ্যে প্রায় ৩১.১% নিজ কর্মে এবং ২২.৪% দিনমজুরের কাজে জড়িত। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, সাধারণভাবে শিশুশ্রমে নিয়োজিত হওয়ার কারণগুলো হলো দরিদ্রতা, এতিম বা পথশিশু, হারিয়ে যাওয়া শিশু, শিশুশ্রমের সহজলভ্যতা, জনসংখ্যা স্ফীতি, শিক্ষা শেষে চাকরি লাভের অনিশ্চয়তা, এতিমখানা বা পথশিশুদের পুনর্বাসনের সুযোগ সীমিত, বিভিন্ন আইনে শিশুর বয়সের ভিন্নতা ইত্যাদি। শিশুরা যখন তাদের সোনালি জগতের বাইরে অন্য জগতে প্রবেশ করে, বেঁচে থাকার জোগান দেয়, তখন তাদের শারীরিক, মানসিক, আবেগিক, সামাজিক ও নৈতিকতার অবনতি ঘটতে থাকে। বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা তাদের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। মানসিক বুদ্ধি লোপ পায়, ইচ্ছার বিপর্যয় ঘটে এবং ইচ্ছাশক্তি অবদমিত হয়ে যায়, উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়। এখনো শিশুরা ইলেকট্রিক, ওয়েল্ডিং ও লেদ মেশিনের কাজে নিয়োজিত হচ্ছে। বিভিন্ন যানবাহনের হেলপার হিসেবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। এক শ্রেণীর লোকের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বোমা তৈরি ও পিকেটিং-এ অংশ নিচ্ছে। ব্যাটারি কারখানা, চুড়ি তৈরির কারখানা, ঢালাই কারখানা, ইট ভাঙার কাজ, ট্যানারি প্রভৃতি স্থানে শিশুরা কাজ করে যাচ্ছে। শিশুরা জানে না তাদের এই কাজ কতোটা ভয়াবহ, তারা জানে না তাদের জন্য কত ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। শিশুদের অধিকার নানাভাবে লংঘন করা হলেও শিশুদের নিয়ে, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় দেশি ও বিদেশি নানা সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের নানা কর্মসূচির পাশাপাশি সারাদেশে ২৬৩টি শিশু সংস্থার নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি ও অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া অনেক সংস্থা আছে যারা আলাদাভাবে শিশুশ্রম নিরসনে কাজ করছে। বেসরকারি সংস্থা, সরকারি পদক্ষেপ, গণমাধ্যম, সিভিল সোসাইটি সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে বাংলাদেশে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে একটি গণজাগরণ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। যে সমস্ত শিশু প্রভাবিত হয়ে শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে তাদের প্রবেশপথগুলো চিহ্নিত করা এবং ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি। খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা এবং সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচির ওপর ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। শহরের কর্মজীবী শিশুদের জন্য মৌলিক শিক্ষা প্রকল্পটি বিভাগীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ না রেখে সারাদেশে সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। শিশুশ্রম বন্ধে ২০০৮ সালে খসড়া আইন প্রণয়ন করা হলেও তা আজও আলোর মুখ দেখেনি। এটি চূড়ান্ত করার আগে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মতামত প্রদানের জন্য উন্মুক্ত করা দরকার। শিশুশ্রম নিরসনে একটি জাতীয় টাক্সফোর্স গঠন করা উচিত। শ্রমের সঙ্গে জড়িত শিশুদের ব্যাপকভাবে কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়। সরকার, বেসরকারি সংস্থা সর্বোপরি জনসমাজের সমন্বয়ে শিশুশ্রমিকদের পিতা-মাতাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং শিশুশ্রমের কুফলগুলো তুলে ধরা। সরকারি উদ্যোগে গণমাধ্যমে শিশুশ্রমের কুফল তুলে ধরে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষও শিশুশ্রমের ক্ষতিকারক দিকগুলো জানতে পারে।

0 comments:

Post a Comment