Wednesday, June 29, 2016

পরিবেশ: বিপর্যয়ের দায় মানুষেরই

পরিবেশ: বিপর্যয়ের দায় মানুষেরই
আলী ফোরকান
প্রকৃতির রোষ অবশ্যই, কিন্তু‘ উত্তর ভারতের ভয়ংকর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পেছনের কারণ যে মানুষই। সেই অভিমত বা দাবি ক্রমশই জোরালো হচ্ছে। দেশের পরিবেশবিদেরা একযোগে বলতে শুরু“ করেছেন, প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে উন্নয়নের নামে যা চলছে। প্রকৃতি তারই শোধ তুলেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই বিপর্যয় নিয়ে আলোচনার সময় লাগামছাড়া প্রকৃতি-নিধন বন্ধ করা নিয়েও কথা হয়। পরিবেশবিদদের অভিমত, এখনই রাশ না টানলে হিমালয়কে রক্ষা করা কঠিন হবে। নদীবিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ‘এ দেশের উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘লজিক অব প্রফিট’। অর্থাৎ, পরিবেশ, প্রকৃতি চুলোয় যাক, প্রকল্পটা লাভজনক হচ্ছে কি না, সেটাই আসল কথা। এই মনোভাবের জন্য নদীর পাড়ে পাড়ে বাড়ি, হোটেল তৈরি হয়েছে। যথেচ্ছ গাছ কাটা হয়েছে। নদীর গতিপথ বদলে তৈরি হচ্ছে একের পর এক জলবিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রকৃতি শোধ নেবে না একই অভিমত উত্তরাখন্ডের প্রবীণ পরিবেশবিদ স্বামী জ্ঞানস্বরূপ ও সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের (সিএসই) ডিরেক্টর জেনারেল সুনীতা নারায়ণের। সুনীতার মতে, গোটা পার্বত্য অঞ্চলে কোথাও কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা নেই। সরকার স্রেফ দর্শক সেজে থাকছে। স্বামী জ্ঞানস্বরূপও এই বিপর্যয়ের জন্য সরকারকে প্রধান দায়ী করে বলেছেন, উত্তরাখন্ডে অলকনন্দা ও মন্দাকিনীর ধারে অন্তত ৭০টা ছোট-বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হয়েছে ও হচ্ছে। পরিবেশবিদদের দাবি ও অভিযোগের সত্যতা ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (ইসরো) রিপোর্টেও স্পষ্ট। সেই অভ্যন্তরীণ রিপোর্টে বলা হয়েছে, গোটা হিমালয়জুড়েই নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নষ্ট করা হয়েছে। সিএসইর রিপোর্টে পরিবহনজনিত দূষণের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ২০০৫ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত যানবাহনের সংখ্যা তিন গুণ বেড়ে গেছে। কল্যাণ রুদ্রর মতে, গোটা উপমহাদেশই সার্বিকভাবে এক অকল্পনীয় বিপর্যয়ের প্রতীক্ষায় রয়েছে। এখনই সজাগ না হলে যেকোনো দিন তা ঘটে যাবে। অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের জলবায়ুবিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এ প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্ব যে নতুন দুর্যোগের মুখোমুখি সেই বাস্তবতাকে তুলে ধরা হয়। বহুদিন ধরেই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম উঠে আসছে। খ্যাতনামা গবেষণা সংস্থাগুলোর রিপোর্টে। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনেও বিপন্ন দেশের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয় বাংলাদেশকে। বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদন এ-সংক্রান্ত উদ্বেগে নতুন মাত্রা সংযোজন করল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা দুই থেকে চার ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে আবহাওয়ার যতগুলো নেতিবাচক রূপ রয়েছে। তার প্রায় সবগুলোর প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়বে। বন্যা, খরা, ঝড়, জলেচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সবচেয়ে বেশি আঘাত হানবে যেসব দেশে। তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ‘টার্ন ডাউন দ্য হিট : ক্লাইমেট এক্সিট্রম রিজিওনাল ইমপ্যাক্ট অ্যান্ড কেস ফর রেজিলিয়ান্স’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে তুলে ধরা হয়। জার্মানভিত্তিক গবেষণা সংস্থা পস্টড্যাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চের নেতৃত্বে প্রস্তুতকৃত এ গবেষণা প্রতিবেদনটির সঙ্গে বিশ্বের স্বনামধন্য ৯০ জন জলবায়ু-বিশেষজ্ঞ যুক্ত ছিলেন। প্রতিবেদনটির মূল ব্যাখ্যা ছিল বিশ্বের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বর্তমানে যে হারে বাড়ছে। তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে ২০৯০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা চার ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে। পরিণতিতে বিশ্বজুড়ে কী ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। তার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, ২০৮০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্ছতা ৬৫ সেন্টিমিটার বাড়লে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৪০ শতাংশ ফসলি জমি হারিয়ে যাবে। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরে ৮০ হাজার টন ধান কম উৎপাদিত হয়। এর ফলে ১৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হয় বাংলাদেশ। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বাড়ায় দুই কোটি মানুষ ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবহাওয়া উষ্ণ হয়ে ওঠায় বাংলাদেশের মতো উপকূলবর্তী দেশ অনাকাংক্ষিত সমস্যার শিকার। শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলোর কারণে যেহেতু আবহাওয়া দূষিত হচ্ছে, সেহেতু সমস্যা মোকাবিলার দায় ও ক্ষতিপূরণ দানে তাদের এগিয়ে আসা উচিত। এটি দয়া নয়, তাদের কর্তব্য বলেই বিবেচিত হওয়া উচিত।

0 comments:

Post a Comment