পরিবেশ: আজ শুধুই স্মৃতি
আলী ফোরকান
নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওর, পুকুর-ডোবা এ নিয়ে আমাদের দেশ। অতীতে বর্ষা মৌসুমে সব জলাধার জলে টইটম্বুর করত। আবার শীতে এগুলো কিছুটা শুকিয়ে যেত। ভরা জলে পালতোলা দাঁড়টানা নৌকায় চড়ে মানুষ যেত এখানে-সেখানে। নদীর জলের কলকল ধ্বনী, পালতোলা নৌকার দাঁড়টানা দৃশ্য মানুষকে বিমোহিত করত। এসব দৃশ্য দেখে কবিরা রচনা করেছেন কত গান, কবিতা। জলপথের পাশেই সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছে, গড়ে উঠেছে জনপথ, শহর বন্দর। সওদাগরেরা তাদের সওদা নিয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেরিয়েছেন জলপথে। আজ তা শুধুই স্মৃতি। আজ সেই জলাভূমি নেই, নেই সেই জলপথ। কেন এমন হল তা বিশেষজ্ঞরা খুঁজবেন। তবে আমরা সাধারণ চোখে যে কারণগুলো দেখি তা পরিহার করতে পারলে এ অবস্থা কিছুটা হলেও রোধ করা যেত। প্রথমত, জলবায়ুর পরিবর্তন হয়েছে উল্লে-খযোগ্যভাবে। অতি বর্ষায় উজান থেকে প্রচুর পলিমাটি, বালু পানির সঙ্গে জমা হয়েছে খালে-বিলে, হাওড়ে-বাঁওরে, পুকুরে-নদীতে। স্বভাবতই পলি বালু জমে জমে জলাধারের তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। পুকুর ছাড়া অন্য কোন জলপথের সংস্কার হয়নি। নামকাওয়াস্তে কিছু খাল কাটার কথা উলে¬খ করা যেতে পারে। বর্ষায় যখন উজান থেকে প্রচুর পানি আসতে থাকে, তখন এসব ভরাট হওয়া জলাধারগুলো অতিরিক্ত পানি ধারণ করতে পারে না। ফলে প্রতিবছর একাধিকবার বন্যা হয় এবং ফসল, জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আবার শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে চাষাবাদ ব্যাহত হয়। ফসল কম হওয়ায় খাদ্যাভাব আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ তো গেল প্রাকৃতিক কারণ। মানব সৃষ্ট অনেক কারণ রয়েছে। আমরা নির্বিচারে বন-জঙ্গল, লোকালয় থেকে গাছ কেটে ফেলছি। যে গাছ শিকড় দিয়ে মাটিকে ধরে রাখে আমরা সেই গাছ কেটে ফেলছি। ফলে বর্ষায় প্রচুর মাটি বর্ষার পানির সঙ্গে জলাধারে গিয়ে তা ভরাট করে ফেলছে প্রতিনিয়ত। আবার শুষ্ক মৌসুমে যখন পুকুর-ডোবা, খাল-বিল, নদ-নদীতে পানি কমে যায় তখন আমরা ওই জলাধারের কিনারে ধান লাগাই। আমরা জলাধারের পাড় কেটে গভীর অংশে মাটি ফেলে ভরাট করি, যেন কিনারা থেকে গভীর অংশ যতদূর সম্ভব সমতল হয়ে জমিতে পরিণত হয়। তাতে ধান লাগাতে সুবিধা হয়। কিন্তু আমাদের এই অর্বাচীন কাজের ফলে এক সময় ওই জলাধার আর জলাধার থাকে না, ওটা জমিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। আমরা অনেক রাস্তাঘাট করেছি, বেড়িবাঁধ দিয়েছি, আর বক্স কালভার্ট নির্মাণ করেছি এবং সেটা করেছি কোনরূপ অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে। ফলে বর্ষায় পানি প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে, নতুবা পানি নিষ্কাষণে প্রবল সমস্যা হচ্ছে। যখন শুধু নদীই পানি বের হওয়ার একমাত্র ভরসা, তখন তার দু’কূল ছাপিয়ে বন্যা সৃষ্টি হচ্ছে। ড্রেজার দিয়ে যখন নদীর তল কাটা হয়, তখন কেন যেন ওই মাটি নদীতেই ফেলা হয়। আমরা জলাধার ভরাট করে বিরাট বিরাট অট্টালিকা বানিয়ে জলাধার নষ্ট করেছি। এতে আমরা অবকাঠামোগত উন্নতি পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু পাওয়ার চেয়ে হারিয়েছি অনেক বেশি। মানব সৃষ্ট এসব কাজের ফলে জলাধারের ধারণক্ষমতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। আমরা প্রতি বছর এর বিনিময়ে পাচ্ছি বন্যা, নদীভাঙন। হাজার হাজার মানুষ প্রতিনিয়ত সর্বহারা হচ্ছে। এমনিতেই প্রাকৃতিক বিপর্যয় আমাদের নিত্যসঙ্গী। তার ওপর যদি আমরা এই বিপর্র্যয়কে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করি, তাহলে একদিন আমাদের কী পরিণত হবে তা এখনই ভাবা উচিত।
0 comments:
Post a Comment