Thursday, June 30, 2016

পরিবেশ ও নারী

পরিবেশ ও নারী
আলী ফোরকান
পরিবেশ সংক্রান্ত ভাবনা আমাদের দেশে একেবারেই নতুন নয়। দেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর পরিবেশ সম্পর্কে ভাবনার সূত্রপাত হয় বেশ তাড়াতাড়ি। মূলত ১৯৭২ সালে স্টকহোম কনভেনশনে বিশ্ব পরিবেশের অবক্ষয় ও মানুষসহ প্রাণিকুলের ওপর এর বিরূপ প্রভাব। এ সম্পর্কে উদ্বেগের বাস্তবতায় পরিবেশ দূষণ রোধে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে পদক্ষেপ গ্রহণের পর থেকে শুরু হয় গবেষণা। বঙ্গবন্ধু সরকার দেশের পরিবেশ রক্ষায় ১৯৭২ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে মাত্র ২৭ জন নিয়ে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। ১৯৮৯ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে অধিদপ্তর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। উপরে উল্লিখিত ১৯৭২ সালের ঘোষণার অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল ২১ শতকের পরিবেশ ও উন্নয়ন। নারীর সঙ্গে পরিবেশ, পরিবেশের সঙ্গে উন্নয়ন। উন্নয়নের ভিত্তি জেন্ডার-বান্ধব পরিবেশ এ সবই একটির সঙ্গে অন্যটির সম্পর্কযুক্ত অর্থাৎ একটি অন্যটির পরিপূরক। একটি কথা বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যে, নারী শুধু পুরুষের মতো ভোক্তা হিসেবে তার অবস্থানকে সুদৃঢ় করেনি। বরং প্রকৃতিকে রক্ষা ও প্রাকৃতিক সম্পদের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করেছে। নারীর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সেই দিক বিবেচনায় জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে কনভেনশন সম্পর্কে আলোচনা করা একান্ত অপরিহার্য। ব্রাজিলের রিও সম্মেলনে স্বাক্ষরিত জাতিসংঘ পরিবেশ পরিবর্তন রূপরেখা কনভেনশন আমাদের দেশের জন্য সবচেয়ে দরকারি ও অপরিহার্য আর্ন্তজাতিক সনদ। জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্মেলন হয় যার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল সুদূরপ্রসারী টেকসই সমতাভিত্তিক উন্নয়নের জন্য নারীর অংশগ্রহণ’। পরিবেশ ও উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত জাতিসংঘ সম্মেলন এবং জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ক আর্ন্তজাতিক সম্মেলনে এ বিষয়টি স্বীকৃতি পেয়েছে এবং ২১ সংখ্যক এজেন্ডায় এর সরাসরি প্রতিফলন রয়েছে। মানুষের ধারাবাহিক পরিবেশ বিপর্যয় ও দূষণের আগ্রাসনে এ ধরণীর সার্বিক প্রতিবেশ ব্যবস্থা ধ্বংসের মুখোমুখি ও বিপর্যয়ের শেষ প্রান্তে গিয়ে ঠেকেছে। এ জাতীয় বিপর্যয়ের ফলে নারী উৎপাদনশীল জগৎ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভয়াবহ অবক্ষয়, মরুকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস ও পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার দায়ভার, নারীর খাদ্য, জ্বালানি ও বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহে নারী মজুরিবিহীন কাজে অধিক সময় ধরে জড়িত। যা নারীদেরকে আয়মূলক কাজ থেকে ছিটকে পড়তে সহায়তা করে। গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে সকল মানুষ বিশেষ করে নারীরা বিশেষভাবে অরক্ষিত ও বঞ্চনার শিকার। গ্রাম-প্রধান দেশের একটা বিশাল সংখ্যক নারী কৃষিকাজের সঙ্গে বিশেষ করে সবজি বাগান ও ফল-ফুল উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। বাসাবাড়িতে ও কৃষিজমির কর্মক্ষেত্রে পরিবেশ ঝুঁকি নারীর স্বাস্থ্যের ওপর ভয়াবহ রকমের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একটি সুস্থ পরিবেশের জন্য দরকার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। যে দৃষ্টিভঙ্গির প্রায় সকল ক্ষেত্রে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। পরিবেশগত সিদ্ধান্তের সকল স্তরে নারীদেরকে সরাসরি জড়িত করার জন্য ১৯৯৫ সালের বেইজিং চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে বেশকিছু কৌশলগত লক্ষ্য উল্লেখ করেছে। যাদের মধ্যে অন্যতম হলো : ১. পরিবেশগত সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণের জন্য নারীদের দক্ষতা ও যোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য সুযোগের সমতা সৃষ্টি করা একান্ত অপরিহার্য; ২. পরিবেশ উন্নয়ন সংক্রান্ত রিও ঘোষণায় গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বিবেচনায় এনে পরিবারের অভ্যন্তরে ও বাড়ির বাইরে কর্মক্ষেত্রে সকল প্রকার পরিবেশগত ঝুঁকি এড়িয়ে নারীর জীবনকে সহজ করতে উদ্যোগী হতে হবে; ৩. রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পরিবেশগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রত্যেক স্থানে নারীর পরিপূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে; ৪. জাতিসংঘের সকল সংগঠনের কাজে এবং টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক কমিশনের প্রায় সব কার্যক্রমে জেন্ডার প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। অন্যথায় নারী হুমকির মুখে পতিত হতে বাধ্য; ৫. টেকসই নারী উন্নয়নের নীতি ও কর্মসূচিতে জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করতে হলে সর্বাগ্রে দরকার পরিবেশ বিপর্যয় ও তার ফলে নারীর ওপর সৃষ্ট প্রতিক্রিয়া রোধে প্রত্যেককে উৎসাহিত করা; ৬. গ্লে¬াবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি ও দেশের অভ্যন্তরের কিংবা বাহিরে বেসরকারি সংগঠনসমূহে ব্যাপক ভিত্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে; ৭. প্রচুর গবেষণার মাধ্যমে বের করতে হবে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে নারীরা কতো বেশি নাজুক কিংবা অরক্ষিত। পাশাপাশি জেন্ডার সচেতন গবেষণার ফলাফল সমূহ মৌলিক নীতিমালার সঙ্গে একীভূত করা যাতে করে একটি উন্নত পৃথিবী তৈরি করা সম্ভব হয় যা নারীর জন্য উপযোগী; 
৮. সত্যিকারের দিন বদলের জন্য পরিবর্তিত এ বাস্তবতায় টেকসই উন্নয়নে নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণের পথে সকল প্রকার সমস্যা দূর করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীদেরকে আসতে দিতে হবে। পাশাপাশি সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণের অধিকার দিতে হবে এবং সে লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নীতিমালা উন্নয়ন ঘটাতে হবে; ৯. বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের নারীর জন্য দরকার কারিগরি সহযোগিতার পদক্ষেপ গ্রহণ করা; ১০. নারীর অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণের ব্যাপারে কাজে লাগানো যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নারীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের পর পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে নারীর দক্ষতা পূর্বের চেয়ে বহুগুণে বেড়েছে। এছাড়াও নারী ও পরিবেশকে প্রধান এজেন্ডা করে বহু এনজিও দেশের গ্রাম ও শহর পর্যায়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে পরিবেশের মানোন্নয়নে। আমরা আশা করবো সরকার জেন্ডার-বান্ধব ঘোষণা প্রদানের মাধ্যমে পরিবেশকে সকল কাজের পূর্বে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করবে। 

0 comments:

Post a Comment