Saturday, June 25, 2016

নগর পুড়লে দেবালয় যে রক্ষা পায় না

নগর পুড়লে দেবালয় যে রক্ষা পায় না
আলী ফোরকান
সম্প্রতি একটি ইংরেজী দৈনিকের প্রথম পাতায় চার কলাম জুড়ে ছাপা হয়েছে ছবিটি। মাথা নিচু করে আছে একটি কিশোরী। দীর্ঘ কালো চুল আর হাত দুটোই শুধু দেখা যাচ্ছে। কিশোরীর কচি হাত চেপে ধরে তাকে প্যাথেডিন ইনজেকশন দিচ্ছে বখাটে ধরনের একটি তরুণ। ভয়াবহ এ দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দী করা হয়েছে রাজধানীর নয়াবাজারের ফুটপাত থেকে। রাতের অন্ধকারে নয়, গোপনেও নয়, প্রকাশ্য দিবালোকে জনসমক্ষে ঘটছে এ ঘটনা। স্কুল থেকে ঝরে পড়া হতভাগ্য এ কিশোরীটি জানিয়েছে, দু’বছর আগে তার বন্ধুরা তাকে সর্বনাশা এ মাদকের জালে জড়িয়ে ফেলেছে। ছবিটি দেখে খুব মন খারাপ হয়ে যায়। এমন না যে, এ ধরনের দৃশ্য আমি আগে দেখিনি। দুঃসহ যানজটকবলিত রাজধানীতে কল্যাণপুর থেকে শাহবাগ দীর্ঘপথ। আসা-যাওয়ার পথে প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের অসংখ্য দৃশ্য চোখে পড়ে। ফুটপাথে, ফুট ওভারব্রীজের নীচে কিংবা খোলা মাঠে গোল হয়ে বসে নিয়মিত চলছে মাদক গ্রহণের এ আত্মঘাতী খেলা। সকল বয়সের মানুষই এতে জড়িয়ে পড়লেও আমার মনে হয়েছে, মাদকসেবীদের বৃহদংশই কিশোর। কিশোরীরাও যে এ মরণফাঁদ থেকে মুক্ত নয়, প্রকাশিত ছবিটিই তার অকাট্য প্রমাণ। প্যাথেডিন শুধু নয়, ফেনসিডিল থেকে শুরু করে হেরোইন ইয়াবা পর্যন্ত হেন নেশাসামগ্রী নেই যা তারা গ্রহণ করছে না। কোনো লুকোছাপা নেই। টহল পুলিশের সামনেই চলছে আত্মহননের এ মহোৎসব। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যারা এ সর্বনাশ থেকে বাঁচাতে পারতেন তাদের এ নিয়ে মাথা ঘামাবার মতো সময় নেই। অন্য অনেক সমস্যা নিয়ে তারা ব্যতিব্যস্ত। আমরা যারা অতি সাধারণ মানুষ তাদের অবস্থাও অনেকটা তাই। আমাদের নির্বাক চোখের সামনে প্রতিদিনই তাদের একটু একটু করে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে দেখেও আমরা তা না দেখার ভান করি। এ ছাড়া উপায়ইবা কী! আমাদের চারপাশে এমনিতেই তো সমস্যার পাহাড়। এই দুঃসহ গরমে প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতে হচ্ছে রাস্তায়। পনের মিনিটের রাস্তা পাড়ি দিতে লেগে যাচ্ছে দু’ঘন্টা। দিনের বেশিরভাগ সময় পানি-বিদ্যুৎ কোনোটাই থাকে না ঘরে। বাজারের অবস্থা নাচুনে বুড়ির মতো। চিনির নাচ থামলো তো শুরু হয়ে গেল চালের নাচানাচি! জীবনযাত্রার ব্যয় যেভাবে বাড়ছে সেই তুলনায় আয় বাড়ছে না। বাড়ছে না কাজের সুযোগ। নিজের জানই বাঁচে না তো, অন্যের ভালোমন্দের দিকে তাকানোর সময় কোথায়! তবে নগর পুড়লে দেবালয় যে রক্ষা পায় না কথাটি অতি পুরোনো। আমাদের পূর্বসূরিরা শতাধিক বছর আগেই সেই সতর্কবাণী উচ্চারণ করে গেছেন। বাস্তবেও তাই ঘটে চলেছে। ইতোমধ্যে বহু সুখীসুন্দর পরিবার মাদকের আগুনে পুড়ে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। নীরবে নিভৃতে আরও বহু পরিবার দগ্ধ হচ্ছে তিলে তিলে। এছাড়া আরো মর্মস্পর্শী একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে সবক’টি জাতীয় দৈনিকে। রাজধানীতে স্কুলপড়ুয়া ১৫ বছর বয়েসী একমাত্র কিশোর ছেলের এলোপাতাড়ি বটির আঘাতে গুরুতর আহত হয়েছেন বাবা, মা এবং বড়ো দুই বোন। মা বলেছেন, তাদের সন্তানটি এমনিতে খুবই শান্ত প্রকৃতির। ছেলেটির বাবা-মা দু’জনই উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। বড়ো বোনটি ঢাকা মেডিক্যালের ছাত্রী। আমাদের বাঙালি পরিবারে ভাইবোনের সম্পর্ক কতো মধুর তা কে না জানে! তারপরও তাদের অতি আদরের একমাত্র ছোট ভাইটি কেন অকস্মাৎ এতোটা মারমুখী হয়ে উঠলো তা এক রহস্যই বটে। বিষয়টি বোঝার জন্য আমি চারপাঁচটি পত্রিকা ঘেঁটেছি। একটি কাগজে লিখেছে যে, ছেলেটি মাদকাসক্ত। সত্যাসত্য জানি না। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, খবরটি যেন মিথ্যা হয়। তবে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, বাবা-মার অগোচরে এমনটি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সামগ্রিকভাবে আমাদের অভিজ্ঞতা খুবই ভয়াবহ। চারপাশে এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া কঠিন যাদের নিকটজনদের মধ্যে কেউ না কেউ এ আগুনে দগ্ধ হননি বা হচ্ছেন না। ধনীদরিদ্র কেউ রক্ষা পাচ্ছেন না মাদকের এ সর্বগ্রাসী ছোবল থেকে। উদাহরণ অনেক। অকালমৃত্যুর পাশাপাশি আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। পরিবারের একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে চিরদিনের জন্য শোকসাগরে নিমজ্জিত হয়েছেন অনেকে। এ বেদনা যে কতোটা দুর্বহ তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন। একবার মাদকের জালে জড়িয়ে পড়লে তাকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা মোটেও সহজ নয়। চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ শুধু নয়, অত্যন্ত ব্যয়বহুলও বটে। দরিদ্র বা সীমিত আয়ের পরিবারগুলোর পক্ষে এ চিকিৎসা অকল্পনীয়ই বলা চলে। কম ব্যয়সাপেক্ষ সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত কিছু নিরাময় কেন্দ্র থাকলেও তা চাহিদার ব্যাপকতার তুলনায় কিছুই নয়। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মতে, দেশে বর্তমানে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। তবে জাতিসংঘ বলছে, কমপক্ষে ৬৫ লাখ লোক সরাসরি মাদকাসক্ত। অথচ এক দশক আগেও এ সংখ্যা ছিল ১০ লাখের কম। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের ৯১ শতাংশই হলো কিশোর ও তরুণ। নারীর সংখ্যাও কম নয়। মোট মাদকাসক্তের ১৩ ভাগই হলো নারী। এদের একটি অংশ মাদক ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত। সবচেয়ে উদ্বেগজনক খবর হলো, মাদক বহন ও পাচারের কাজে পথশিশুদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। ফলে মাদকাসক্তি ছড়িয়ে পড়ছে এ সব শিশুর মধ্যেও। সারা দেশে ইউনিসেফের প্রায় দেড়শ’ ড্রপ-ইন সেন্টার আছে। গত পাঁচ বছরে এ সব কেন্দ্রে প্রায় এক লাখ শিশুকে সহায়তা দেয়া হয়েছে। কিন্তু ফলাফল খুবই হতাশাব্যঞ্জক। সুস্থ হওয়ার পর এ সব শিশুর বড়ো অংশ আবার জড়িয়ে পড়ছে মাদকের জালে। এটা এখন অনস্বীকার্য যে, আমাদের দেশে দিনে দিনে মাদক একটি বিশাল ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানও তাই বলে। তাদের মতে, শুধু রাজধানী ঢাকায় সাড়ে ৫শ’ স্পটে জমজমাট মাদকব্যবসা চলে। সারা দেশে প্রায় এক লাখ লোক এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এদের মধ্যে সমাজের উঁচুতলার লোক যেমন রয়েছে, তেমনি আছে সাধারণ বস্তিবাসীও। মাদকের এ নেটওয়ার্কটি কতোদূর বিস্তৃত ও শক্তিশালী তা কিছুটা আঁচ করা গিয়েছিল ‘ইয়াবা’ বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত একটি চক্র ধরা পড়ার পর। তবে এ সম্পর্কে যৎকিঞ্চিৎ খোঁজখবর রাখেন এমন অনেকে মনে করেন, এটাও বিশাল এক ডুবো পাহাড়ের সামান্য চূড়ো মাত্র। তাদের মতে, এতে বিনিয়োগকৃত টাকার পরিমাণ যেমন বিপুল, তেমনি মুনাফার পরিমাণও আমাদের কল্পনাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো। কল্পনাতীত মুনাফার কারণেই মাদক ব্যবসায়ীরা গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়তেও দ্বিধা করে না। মাদকের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসন শুধু আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে না, একই সঙ্গে বিপন্ন করে তুলছে আমাদের সমাজকেও। বলা বাহুল্য, মাদক খুবই ব্যয়বহুল একটি নেশা। হেরোইনে আসক্ত মাত্র ৯ বছর বয়সী এক পথশিশুর স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায়, এ জন্য তারই লাগতো দৈনিক ৯০ টাকা। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে কোনো কিশোর-তরুণের পক্ষেই নিয়মিত এ টাকা সংগ্রহ করা সহজ নয়। ফলে নেশার টাকা জোগাড় করার জন্যই তাদের একটি বড়ো অংশ জড়িয়ে পড়ে ছিনতাইসহ নানা অপরাধে। তুলনামূলকভাবে সচ্ছল পরিবারের সন্তানেরা ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করে। কেউ কেউ বাবা-মাকেও জিম্মি করে ফেলে। নানাভাবে তাদের ওপর নির্যাতনও চালায়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশও মনে করে যে, রাজধানীর ৯০ শতাংশ অপরাধের মূলে রয়েছে মাদক। 
 মাদকের ভয়াল আগ্রাসন ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের আনাচেকানাচে। দেশের কোনো অঞ্চলই এখন আর এ আগ্রাসনের বাইরে নয়। সবচেয়ে আতঙ্কজনক খবরটি হলো, স্কুলগুলোতে বিস্তৃত হতে শুরু করেছে মাদকের ভয়ঙ্কর থাবা। খোদ রাজধানীর একাধিক নামিদামি স্কুলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের কাছ থেকেও এ ধরনের উদ্বেগজনক খবর পাওয়া গেছে। যে কোনো মূল্যে মাদকের এ আগ্রাসন থামানো দরকার। এবং সেটা এখনই। আমরা ইতোমধ্যে যথেষ্ট দেরি করে ফেলেছি বলে আমার আশঙ্কা। আরও আগেই এ ব্যাপারে আমাদের শক্ত অবস্থান নেয়া উচিত ছিল। কেউ যদি ভেবে থাকেন যে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বহ্নিমুখ পতঙ্গের মতো নেশার আগুনে ভস্মীভূত হলে সেই আগুন থেকে আমরা নিরাপদে থাকতে পারবো তাহলে তিনি মস্তবড়ো ভুল করবেন। মাদকের আগ্রাসন ঠেকাতে হলে সবার আগে এর সরবরাহ নেটওয়ার্কটি ধ্বংস করা দরকার। দেশের সবক’টি সীমান্ত দিয়ে বানের পানির মতো ঢুকছে নানা ধরনের মাদক। তার মধ্যে হেরোইন,ইয়াবা বা আফিমের মতো বিপজ্জনক মাদক পাচারের জন্য মিয়ানমার-সংলগ্ন সীমান্তের কুখ্যাতি রয়েছে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও। মাঝেমধ্যে এর যৎসামান্য ধরা পড়লেও সিংহভাগই নির্বিঘেœ পৌঁছে যাচ্ছে দেশের আনাচেকানাচে। প্রায় প্রকাশ্যেই ট্রেনে, গাড়িতে বা পার্সেলের মাধ্যমে এর আনা-নেয়া চলছে। আমাদের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসন সবই জানে বলেই জনগণ মনে করে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এ ব্যাপারে তারা খুব কমই যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন। নিন্দুকেরা বলেন, কারণটি আর কিছুই নয়, টাকাই তাদের হাতপা বেঁধে রাখে। টাকার খেলা থাকতেই পারে। মাদক আর টাকা পরস্পর অবিচ্ছেদ্যই বলা চলে। তবে আমার ধারণা, সরকারের উদাসীনতাই হলো আসল কারণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের দেশে দেশে সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যে কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করেছে, বিস্ময়করভাবে আমাদের দেশে তার তেমন কোনো প্রভাবই দেখা যায় না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে কালবিলম্ব না করে মাদকের ব্যাপারে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। বিপজ্জনক ও অবৈধ মাদক ব্যবসার সঙ্গে যে বা যারাই যুক্ত হোক তাদেরকে দাঁড় করাতে হবে বিচারের কাঠগড়ায়। পাশাপাশি, গড়ে তুলতে হবে মাদকবিরোধী সর্বজনীন সামাজিক সচেতনতা। অবশ্য সরকারের একার পক্ষে এটা সম্ভব নয়। এ কাজে অন্যদেরও এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত এটাকে তাদের নিয়মিত কার্যক্রম হিসেবে গ্রহণ করা। দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং আর্থসামাজিক অস্থিরতাও অনেক ক্ষেত্রে মাদকের বিস্তারে ভূমিকা রেখে থাকে। কাজটি দীর্ঘমেয়াদী হলেও সরকারকে এদিকেও নজর দিতে হবে বৈকি।

0 comments:

Post a Comment