Saturday, June 25, 2016

শিক্ষাবঞ্চিত হচ্ছে শিশু


শিক্ষাবঞ্চিত হচ্ছে শিশু
আলী ফোরকান
দারিদ্র্য শিশুকে শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। দরিদ্র পরিবারের অভিভাবকরা মনে করেন সন্তানকে লেখাপড়া শেখানোর চেয়ে কাজ শেখানোটাই জরুরী। তবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শুধু দারিদ্র্য নয়, কিছুটা অসচেতনতা ও অজ্ঞতার কারণেও অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চান না। গাইবান্ধার সাদিল্যাপুর উপজেলার নয় বছরের মেয়ে সোনালী। বাবা তার মাকে ছেড়ে অন্যজনকে বিয়ে করেছে। সোনালী ও তার দেড় বছরের ছোটভাইসহ তাদের মা কাজের সন্ধানে ঢাকায় চলে আসে। বছর খানেক ধরে তারা তেজগাঁও এলাকায় বসবাস করছে। দিনে বাসাবাড়িতে কিংবা মেসে কাজ করেন সোনালীর মা, আর রাতে ফার্মগেটের ফুটপাতে পলিথিনের ছাপড়া ঘরে ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঘুমান। সকালে মা কাজে গেলে সোনালী তাদের রাতের রান্নার জন্য জ্বালানি হিসাবে কাগজ, পাতা, খড়ি কুড়ায়, খাবার পানি আনে এবং ছোটভাইটিকে দেখাশোনা করে। সোনালী স্কুলে যেতে চায় কিনা জানতে চাইলে সে বলে, ‘পড়তে আমার ইচ্ছে করে কিন্তু ছোট ভাইরে কোথায় রাইখা পড়তে যামু। আর স্কুলে গেলে রাইতে রান্নার জন্য পাতা, কাগজ কুড়াইতে পারুম না, তাইলে মায়ে ভাত রান্না করবে কি দিয়া।’ 
সোনালীর মতো এমন অসংখ্য শিশুর স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও দারিদ্র্য তাদের সেই ভাবনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এসব শিশুই একসময় ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে জড়িয়ে পড়ে। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৬৭ লাখ ৮৪ হাজার। তার মধ্যে ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী ছেলে শিশু ৪ লাখ ৩৪ হাজার এবং মেয়ে শিশু ৩ লাখ ৩৩ হাজার। মোট ৭ লাখ ৬৭ হাজার। দেশে মোট শ্রমিকের ১২ শতাংশই শিশু শ্রমিক এবং শতকরা ১৮ ভাগ শিশুই শ্রমবাজারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিশু শ্রমিক হিসাবে গণ্য হচ্ছে। শিশুদের শতকরা ৯৪ ভাগ অপ্রাতিষ্ঠানিক এবং বাকি ৬ ভাগ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। মোট শিশু শ্রমিকের শতকরা ৬৬ ভাগ কৃষিতে, ৮ ভাগ শিক্ষাখাতে, ২ ভাগ পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে, ১৪ ভাগ গৃহভৃত্য ও অন্য কাজে এবং ১০ ভাগ অন্যান্য সেবাখাতে নিয়োজিত। শিশু শ্রমিকের মধ্যে শতকরা প্রায় ৮৩ ভাগ গ্রামে এবং বাকি ১৭ ভাগ শহর এলাকায় বাস করে। শহর অঞ্চলে প্রায় ৩০০ ধরনের অর্থনৈতিক কাজে শিশুরা শ্রম দিচ্ছে। 
বাংলাদেশ জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর দানকারী প্রথম সারির রাষ্ট্রসমূহের একটি। ১৯৯০ সালে অনুষ্ঠিত শিশু সšে§লনে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে শিশু সম্পর্কে যে নীতি ছিল, তার অন্যতম হল শিশুদের ক্ষেত্রে সকল ধরনের বৈষম্যের অবসান, শিশু অধিকারকে তুলে ধরা এবং শিশুর বেঁচে থাকা ও উন্নয়নে সরকারের ভূমিকা পালন করা। কিন্তু আমাদের দেশে সকল শিশুর ক্ষেত্রে এসব কতটা পালন হচ্ছে তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। ইউনিসেফ বাংলাদেশের আর্থিক সহযোগিতায় বিএসএএফ-র একটি গবেষণা প্রতিবেদনে ৬টি বিভাগে পরিচালিত গবেষণায় ৪৩০ ধরনের শিশু শ্রম চিহ্নিত করা হয়েছে। যার মধ্যে ৬৭টি হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ। শিশুশ্রমের মধ্যে ২২৬টি ফরমাল, ২০৪টি ইনফরমাল। ১৫৭ টি গ্রাম এলাকায় এবং ৩২০ টি শহর এলাকায় বিদ্যমান। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে শিশুদের ১১ ধরনের কাজকে অত্যন্ত খারাপ ধরনের শিশুশ্রম হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিভিন্ন বস্তি ঘুরে দেখা যায়, বিদেশি সহায়তায় বেশকিছু বেসরকারি সংস্থা সেখানে স্কুল চালাচ্ছে। তবে তার মান সন্তোষজনক নয়। নিয়মিত মনিটরিং করা হয় না। এমনও দেখা গেছে যে, শিক্ষা উপকরণ ও দক্ষ লোকবলের অভাবে স্কুলগুলো ঠিকমত চলছে না। যদিও ঢাকা সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত কয়েকটি শিক্ষা কেন্দ রয়েছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বেসরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সুরভী, ইউসেপ, আহছানিয়া মিশন, ইএমইএস, অপরাজেয় বাংলাদেশ, আইন ও সালিশ কেন্দের পরিচালিত স্কুলগুলোর বেশ সুনাম রয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, এক হাজার টাকা আয় করা পরিবারের শিশুদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ শিশু স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। এক হাজার এক টাকা থেকে ২ হাজার টাকা আয়ের পরিবারে শতকরা ৪৬ দশমিক ২ ভাগ এবং ২ হাজার এক টাকা থেকে ৭ হাজার টাকা আয় করা পরিবারের শতকরা ৮ ভাগ শিশু ঝরে পড়ে। ৭ হাজার টাকা আয়ের উপরের পরিবারের শতকরা শূন্য ভাগ শিশু ড্রপ আউট হয়।
এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, শিশুশ্রমের সবচেয়ে বড় কারণ দারিদ্র্য। যার কারণে স্কুলগুলোতে শিশুর জন্য আনন্দদায়ক শিক্ষার পাশাপাশি খাবারের ব্যবস্থা থাকবে। আমরা ২০১১ সালের মধ্যে সব শিশুকে স্কুলে আনা নিশ্চিত করেছি  এবং ২০১৬ সালের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করতে সক্ষম হবো। এসব পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের মধ্যে আমরা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন করতে সক্ষম হব বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।


0 comments:

Post a Comment