প্রসঙ্গ শিক্ষক: আমার পুত্র পা নিজ হাতে ধুয়ে দেয়নি কেন?
আলী ফোরকান
সেই কোন বৃটিশ আমলের কথা। এক পন্ডিত তার ছাত্রদের একটি সরল অঙ্ক কষতে দিয়েছিলেন। তিনি ছাত্রদের প্রশ্ন করেছিলেন, লাট সাহেবের তিন ঠ্যাংওয়ালা কুকুরের জন্য মাসে খরচ হয় ৭৫ টাকা আর নয় সদস্যের তার সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির বেতন ২৫ টাকা। তা হলে তার সংসারের মাথাপিছু খরচ লাট সাহেবের কুকুরের কয় ঠ্যাংয়ের সমান? তৎকালীন সময়ে পন্ডিত মশাইয়ের সরল অঙ্কের সরল হিসাব মেলাতে না পেরে তার ছাত্ররা লজ্জায় মাথা নিচু করে বসেছিল। বৃটিশ আমলের অবসান ঘটেছে বহুকাল। সময় বদলে দিয়েছে সমাজ, স্বপ্ন, জীবনমান। কিন্তুু আজো পন্ডিত মশাইদের সরল অঙ্ক তার ছাত্ররা মেলাতে পারেনি। পন্ডিত মশাইদের স্বপ্ন দিয়ে গড়া তার ছাত্ররা উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়। সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখে। সভা-সমিতিতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে, সাফল্যের কাহিনী বলতে গিয়ে তার শিক্ষকের জ্ঞান এবং জ্ঞান বিতরণের গল্প বলে। টক শোতে অংশগ্রহণ করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ পেশ করে; কিন্তুু একবারও তার ছেলেবেলায় প্রথম শেখা অ আ ক খ যার কাছে, সেই শিক্ষকের জীবনমানের উন্নয়ন নিয়ে ভাবে না। পন্ডিত মশাইদের শ্রম আর স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা প্রতিষ্ঠার উচ্চ শিখরে অবস্থান করে ভুলে যায় তার ছেলেবেলার শিক্ষকের আর্থিক দীনতাকে। তাই তো সমাজে সবকিছু বদলানোর পরও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতন থেকে যায় ড্রাইভারের স্কেলে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের সামাজিক অবস্থান কতোটা দুর্বিষহ। তা আমাদের দেশের শিল্প-সংস্কৃতির দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যাবে। শিক্ষকের জন্য সেখানে বিশেষণ ‘সামান্য শিক্ষক’।
উন্নত দেশের সঙ্গে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের পার্থক্য হলোÑ উন্নত দেশে সবচেয়ে সম্মানিত এবং পছন্দের পেশা হলো শিক্ষকতা। আর আমাদের দেশে শিক্ষকতা সম্পর্কে প্রবাদ হলোÑ ‘যার নেই কোনো গতি, সে করে পন্ডিতি’। নিরুপায় হয়ে মানুষ এ পেশায় আসে। দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন বলে দেশের বিভিন্ন বাহিনীকে আমরা নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সম্মানের সঙ্গে লালন-পালন করি। অথচ দেশের সীমার মধ্যে যে মানুষের বসবাস। মানুষ নিয়ে যে জাতি গঠিত সে মানুষকে সঠিক মানুষ হিসেবে সৃষ্টির জন্য যে শিক্ষকের ওপর আমরা নির্ভরশীল। সে শিক্ষকের কথা আমরা একবারও ভাবি না। শিক্ষা যদি জাতির মেরুদন্ড হয়। তাহলে এই শিক্ষাদানের দায়িত্ব যে শিক্ষকের ওপর ন্যস্ত। তার মেরুদন্ড কেন দারিদ্র্যের অভিশাপে বেঁকে নুয়ে পড়বে? শিক্ষক যখন তার শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষার মাধ্যমে গঠিত জীবনের আলোকিত দিক নির্দেশ করবে, তখন শিক্ষার্থীর মনে অবশ্যই প্রশ্ন আসবে, শিক্ষা যদি তার জন্য আলোকিত জীবনের হাতছানি হয় তাহলে তার শিক্ষকের জীবন কেন দারিদ্র্যের অভিশাপে ঢাকা। শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর কাছে হবে আদর্শ। কিন্তু ড্রাইভারের স্কেলে বেতনপ্রাপ্ত শিক্ষকের জীবনমান তার শিক্ষার্থীর সম্মুখে কোন আদর্শের প্রতীক হয়ে দাঁড়াবে? শিক্ষার নানা ধারা এবং বাণিজ্যিকীকরণের কারণে শিক্ষকের প্রতি যে শ্রদ্ধাবোধ একজন শিক্ষার্থীকে নৈতিকতাবোধে উজ্জীবিত করতো। তা আজ বিলুপ্তির পথে। এখন টাকা যার, শিক্ষা তার। টাকায় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়। সুতরাং কবে কোন কালে কোন দিল্লিশ্বর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, আমার পুত্র আপনার পায়ে শুধু পানি ঢেলে দিয়েছে, পা নিজ হাতে ধুয়ে দেয়নি কেন? তা এখন আর শিক্ষকের মর্যাদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। হারানো মূল্যবোধ মানুষের মধ্যে ফিরিয়ে এনে মানুষকে মানুষ সৃষ্টির লক্ষ্যে। মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম, সহমর্মিতা, পরমত সহিষ্ণুতা ইত্যাদি গড়ে তোলার জন্য একটি মানসম্মত শিক্ষক সমাজ প্রয়োজন। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির অগ্রগতি এবং সুসভ্য হয়ে গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। কুসংস্কার, অন্ধকার জীবন থেকে একটি আলোকিত জীবনে পৌঁছানোর সোপান শিক্ষা। এই শিক্ষার ভিত্তিপ্রস্তর প্রাথমিক শিক্ষা। এই স্তরের ভিত যতো মজবুত হবে, গোটা শিক্ষাব্যবস্থা ততোটাই মজবুত হবে। কিন্তু আমাদের দেশে মেধাবীদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার ক্ষেত্রে আকৃষ্ট করার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। বেতন স্কেল যেমন অসম্মানজনক। তেমনি সামাজিক মর্যাদা এবং জীবনমানও নিম্নমুখী। নতুন শিক্ষানীতি কার্যকর করার মহান দায়িত্ব যে শিক্ষক সমাজের, সেই শিক্ষকদের মানসম্মত করে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মানসম্মত শিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি তা হলো :
১. ড্রাইভারের স্কেল থেকে উন্নীত করে আকর্ষণীয় বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করা, যা মেধাবীদের এই পেশার প্রতি আকৃষ্ট করবে।
২. শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতির চেয়ে মেধাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
৩. প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা শুধু শিক্ষক হিসেবে পরিগণিত হবে, স্তর হিসেবে নয়।
৪. প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং তাদের মতামত গ্রহণ করতে হবে।
৫. প্রশাসনিক নানা নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। প্রশাসনিক কাজকর্ম সহজ করতে হবে।
৬. পেশাগত ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি শিক্ষকদের মানসিক গঠন এমনভাবে সৃষ্টি করতে হবে, যা তাকে দায়িত্বশীল হিসেবে গড়ে তোলে।
৭. কোনো শিক্ষক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকতে পারবেন না।
৮. সমাজের সর্বস্তরে শিক্ষকদের জন্য সুযোগ-সুবিধার কোটা থাকবে। সমাজের যে স্থানেই একজন শিক্ষক যাবেন। সেখানেই শ্রদ্ধায়-সম্ভ্রমে তাকে সবাই গ্রহণ করবে।
৯. শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত কমিয়ে আনতে হবে।
১০. সারাদিনে দুই থেকে তিনটি ক্লাস শিক্ষকের জন্য বরাদ্দ থাকবে। অবসর সময় তিনি যাতে তার ক্লাসকে আকর্ষণীয় করার ব্যাপারে সৃষ্টিমূলক চিন্তাভাবনা করতে পারেন।
১১. একজন শিক্ষক তার স্কুলের বাইরে অন্য কোনো কাজে সম্পৃক্ত থাকতে পারবেন না।
১২. প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের জন্য, বিশেষ করে শহরের শিক্ষকদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৩. শিক্ষকদের পেশার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সন্তুষ্টি সৃষ্টি করতে হবে।
১৪. প্রশাসনিক ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ঘুষ প্রদানে নিরুৎসাহিত করতে হবে। তাদের জন্য নির্ভীক প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।
১৫. অসৎ শিক্ষকের জন্য কঠোর শাস্থিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১৬. চিকিৎসা সুবিধা সহজতর করতে হবে।
১৭. সব রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।
১৮. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আদর, আপ্যায়ন, উপহার প্রদান কমাতে হবে।
১৯. শিক্ষকদের তোষামোদ বৃত্তি থেকে দূরে রাখতে হবে।
২০. শুধু মেধা নয়, মননেও যেন শিক্ষক উৎকৃষ্ট হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
২১. শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর কাছে মহান এক আদর্শের প্রতীক। সুতরাং তার শুধু মেধাই নয়, মনন, নৈতিকতাবোধ, জীবনযাপনের প্রণালি সবই অন্যদের কাছে গ্রহণযোগ্য আদর্শের প্রতীক যাতে হয়। সেটাও লক্ষ্য রাখতে হবে।
শিক্ষকদের ব্যাপারে এ সমাজে বহুকাল ধরে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে আসছে সবাই। অনেকেই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আবার লেখাপড়া হয় নাকি! বহুকাল ধরে এমনি মনোভাবই চলে আসছে সমাজে। শিক্ষকদের পাহারা দেয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে নানা পদ্ধতি। দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন ট্রেনিং; তারপরও সমাজের মনোভাব শিক্ষার গুণগত মানের পরিবর্তন হচ্ছে না। মেধাবীরা আকৃষ্ট হচ্ছে না এই পেশার প্রতি। মানসম্মত শিক্ষক তৈরি হচ্ছে না বলেই মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে না মানুষ। ফলে নৈতিকতার অবক্ষয় আজ সমাজজীবনের সর্বত্র। মেধার বিকাশ হলেও বিকশিত হচ্ছে না মানবিকতা। সমাজে প্রতিনিয়তই ঘটছে নানা ধরনের পৈশাচিক কর্মকান্ড।
মানুষ সৃষ্টির প্রয়াসেই প্রয়োজন দক্ষ এবং যোগ্য শিক্ষক। শিক্ষক একটি সমাজের দর্পণস্বরূপ। যে সমাজে শিক্ষক দরিদ্র, সে সমাজও দরিদ্র; যে সমাজে শিক্ষক দুর্নীতিপরায়ণ। সে সমাজও দুর্নীতিপরায়ণ। মানুষের মধ্যে সুপ্ত মানবিকতা বিকাশের মহান দায়িত্ব শিক্ষকের। সুতরাং দক্ষ, আদর্শবান, দায়িত্বশীল একটি শিক্ষক সমাজ গড়ে তোলার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং সবার। লেখক: গবেষক ও কলামিষ্ট
০১৭১১৫৭৯২৬৭
0 comments:
Post a Comment