Friday, June 17, 2016

বনজ সম্পদ সংরক্ষণে: আশার আলো

বনজ সম্পদ সংরক্ষণে: আশার আলো
আলী ফোরকান
জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবীর সর্বত্র দুশ্চিন্তায় পরিণত হয়েছে। জলবায়ুর এই পরিবর্তনটি প্রাকৃতিক বিবর্তনের মাধ্যমে হয়নি; বরং মানুষেরই তৈরি বলে আমাদের একটু আশার আলোও আছে। মানুষের যে যে কার্যকলাপের জন্য এই পরিবর্তন ধেয়ে আসছে। সে কার্যকলাপের পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা নিশ্চয়ই জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকাতে পারব। জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্য দায়ী মানুষের কার্যকলাপের মধ্যে নির্বিচারে বনজ সম্পদ ধ্বংস উল্লেখযোগ্য। এটি এই পরিবর্তনের জন্য প্রায় এক-চতুর্থাংশ দায়ী। বনের এই ধ্বংসযজ্ঞ যদি আমরা থামাতে পারি এবং বনকে মোটামুটি আগের একটা ভালো অবস্থানে পুনর্বাসিত করতে পারি। তাহলে আমরা কমপক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের এক-চতুর্থাংশ থামাতে পারব। তাছাড়া এর উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও বর্ধিতাংশে ঠেকানো সম্ভব হবে। বন এমন ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ, যা শুধু জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতেই কাজ করে না, বরং বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাককে সহনশীল মাত্রায় রাখতেও সহযোগিতা করে। সুতরাং ধ্বংসপ্রাপ্ত বনজ সম্পদকে পুনর্বাসন করার কোনো বিকল্প নেই। আর এ কাজটি করার জন্য এ বিষয়ক রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা সৃষ্টিরও কোনো বিকল্প নেই।
ব্রিটিশ আমলে এই ভারত উপমহাদেশের বন ব্যবস্থাপনার মূল উদ্দেশ্য ছিল বন থেকে তক্তা সংগ্রহ করা। তক্তা ছাড়া বনের অন্যান্য যে পরিবেশগত উপযোগী আছে, তা হিসাব করার কোনো প্রয়োজনীয়তা তখনকার প্রশাসকরা ভাবেননি। আমাদের দেশীয় নেতারাও সেটি গুরুত্বসহকারে নজরে আনেননি। এজন্য বন সংরক্ষণে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনও তৈরি হয়নি। আজকে অমার পরিবেশের এমন একটি ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে আছি। যখন আমাদের বিশুদ্ধ খাবার পানি ও কৃষিতে সেচের জন্য পানির কথা ভাবতে হচ্ছে। একটি পূর্ণাঙ্গ বনজ ইকোসিস্টেমের সঙ্গে মানব সভ্যতার সৃষ্টি এবং টিকে থাকার যে একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্কের ব্যাঘাত ঘটাতে যে আমাদের সভ্যতা টিকে থাকার উপড়ে হুমকি আসছে, সেগুলো নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় পড়েছি। আমরা বাধ্য হয়েছি বনজ সম্পদ সম্পর্কিত স্থূল চিন্তাভাবনা থেকে সূক্ষ্ম ভাবনার দিকে অগ্রসর হতে। পৃথিবীর যে কোনো অঞ্চলের বনজ ইকোসিস্টেমের উপযোগিতার অর্থনৈতিক আধুনিক হিসেবে দেখা যায়। একটি অঞ্চলের বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক যে লাভ পাওয়া যায়। সে বনকে সংরক্ষণ করলে পানি সংরক্ষণ, মাটি সংরক্ষণ, কার্বন সংবন্ধন, অক্সিজেন প্রবাহ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, বনভিত্তিক পর্যটনসহ পরিবেশের বিভিন্ন বিশুদ্ধতা রক্ষার মাধ্যমে যে অঞ্চলের জন্য যে অর্থনৈতিক লাভ পাওয়া যায়, তা হাজার-লক্ষ গুণে বেশি। তাহলে আমাদের বনকে সংরক্ষণ করাই তো সমীচীন। পৃথিবীর অনেক দেশেই বন সংরক্ষণের এই সূক্ষ্ম লাভজনক হিসাব বেশ কয়েক দশক আগে থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য তারা যথাযথ ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে। এশিয়ায় দক্ষিণ কোরিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে ৫০ বছর আগে কোরিয়ান যুদ্ধে প্রায় সব বন ধ্বংস হয়ে যায়। ষাটের দশকের প্রথম দিকে প্রেসিডেন্ট পার্ক চুং হিয়ের নেতৃত্বে ও অনুপ্রেরণায় কোরিয়ান সরকার বড় ধরনের বন পুনঃসৃজনের কর্মসূচি হাতে নেয়। গ্রামীণ সমবায় গঠনের মাধ্যমে হাজার হাজার খালি পাহাড়গুলোতে গাছ লাগানো শুরু করে। বর্তমানে সেখানে প্রায় ৬৫ ভাগ জায়গা বনে আবৃত। যা প্রায় ৬ মিলিয়ন হেক্টরের সামন। নতুন করে গাছ লাগানোর জন্য এখন সেখানে কোনো জায়গা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দক্ষিণ কোরিয়ায় বন সংরক্ষণের উপযোগিতা এত বড় হয়ে দেখা হয় যে, দেশটিতে ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে কাঠজাত দ্রব্যের বিকল্প উদ্ভাবনে পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম। বনের ওপর নির্ভরশীল লোকদের বিকল্প জীবিকা উদ্ভাবনেও দক্ষিণ কোরিয়া ব্যাপকভাবে সফল হয়েছে। ফলে সেখানে বনের ওপর চাপ কমেছে।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের মধ্যে পরিবর্তিত মাত্রার বৃষ্টিপাত এবং স্বাবাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সুস্পষ্টবাবে প্রভাব ফেলেছে। তবে তা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অবশ্যই বিভিন্ন রকম। বাংলাদেশে এই প্রভাবগুলো আজকে স্পষ্ট। সম্প্রতি আমরা দেখতে পেয়েছি, এই বর্ষাকালে যতটুকু বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা, তার চেয়ে অনেক কম বৃষ্টিপাত পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রতিবছর মৌসুমি বায়ুর প্রভাব যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা, তার চেয়ে অনেক কম বৃষ্টিপাত পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রতি বছর মৌসুমি বায়ুর প্রভাব যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা, এবার তার ব্যতিক্রম হয়ে গেছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে। ফলে বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলের মানুষ বৃষ্টির জন্য হাহাকার করেছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে বর্ষাকালেও এক ধরনের খারাপ ভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। অনেক জায়গায় কৃষির ফসল মার খেয়েছে। একটি অঞ্চলের ভূ-অভ্যন্তরের পানির পরিমাণ এবং গুণাগুণ বজায় রাখার জন্য প্রতি বছরের মোট বৃষ্টিপাত একটি বড় হওয়ার কথা। এবার তার ব্যতিক্রম হয়ে গেছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে। ফলে বাংলাদেশের অনেকে অঞ্চলের মানুষ বৃষ্টির জন্য হাহাকার করেছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে বর্ষাকালেও এক ধরনের খারাপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। অনেক জায়গায় কৃষির ফসল মার খেয়েছে। একটি অঞ্চলের ভূ-অভ্যন্তরের পানির পরিমাণ এবং গুণাগুণ বজায় রাখার জন্য প্রতিবছরের মোট বৃষ্টিপাত একটি বড় ভূমিকা পালন করে। বৃষ্টিপাত কম হলে এবং তাপমাত্রা বেশি থাকলে ভূ-অভ্যন্তরের পানির উপড়ে ব্যাপক প্রভাব পড়তে বাধ্য। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমরা দেখতে পেয়েছি, অনেক অঞ্চলে ভূ-অভ্যন্তরের পানির স্তর বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে অস্বাভাবিকভাবে নিচে চলে যাচ্ছে। এতে অনেক জায়গায় মরুকরণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে । কৃষি উৎপাদনের জন্য সেচ বাবদ খরচ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি আমরা বাংলাদেশের বেশ কিছু অঞ্চলে ভূ-অভ্যন্তরের পানিতে আর্সেনিক দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানি। আর এটি হয়েছে ভূ-অভ্যন্তরের পানির বার্ষিক মোট পরিমাণ কমে আর্সেনিকের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বেশকিছু জায়গায় ভূ-অভ্যন্তরের পানিতে ক্রমবর্ধমান হারে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর মূল কারণও কিন্তু ভূ-অভ্যন্তরের পানির বার্ষিক মোট পরিমাণ কমে যাওয়া। এতে ভূ-অভ্যন্তরের পানির স্তরে সমতা রক্ষার জন্য সমুদ্রের লবণাক্ত পানি ভূমির অভ্যন্তর দিয়ে প্রবেশ করছে। এতে প্রচলিত কৃষি উৎপাদন ও খাবার পানিসরবরাহে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের এই সংবেদনশীলতা, তা সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য বনজ ইকোস্টিমের কোনো বিকল্প নেই। একটি সুস্থ বনজ ইকোসিস্টেম বৃষ্টিপাতের পানি সংরক্ষণ করে সারাবছর ভূ-অভ্যন্তরের পানির পরিমাণ ও তার গুণাগুণকে বজায় রাখে। আর এর মাধ্যমে আমাদের সভ্যতা টিকে থাকার জন্য বেশ অনেকখানি চালিকাশক্তি অর্জন করে। বনজ ইকোসিস্টেম থেকে আমরা এর অজস্র প্রণোদনা পেয়ে থাকি। যা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য জরুরি এবং যা বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করার চেয়ে অনেক গুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
জলবায়ু পরিবর্তনর এবং বন ধ্বংসের এমন একটি পর্যায়ে এসে আমরা উপনীত হয়েছি। যেখানে আমাদের নিস্ক্রিয় হয়ে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। যদি আমাদের সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হয়। তাহলে বনজ ইকোসিস্টেমকে পুনর্বাসন করতেই হবে।পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর অন্যান্য বব্যবস্থাপনাও নিতে হবে। আর এজন্য চাই সুষ্ঠু রাজনীতি এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সুষ্ঠু রাজনীতিই উপযুক্ত রাষ্ট্রনীতি তৈরি করতে পারে। এজন্য রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা খুব জরুরি। যে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আমাদের দেশ থেকে দেশীয় প্রজাতির গাছ হারিয়ে যাচ্ছে বলে সত্যিকারভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন। পাখিদের বেঁচে থাকার উপযুক্ত পরিবেশ থাকছে না বলে হৃদয়ে আঘাত পান। মানুষের বেঁচে থাকার পাশাপাশি হরণি, বন্যশূকর, সাপসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীরও যে বেঁচে থাকার অধিকার আছেÑতা সত্যিকারভাবে অনুভব করেন। সে রকম ব্যক্তিত্ব আমাদের এখন খুব দরকার।

0 comments:

Post a Comment