Friday, June 17, 2016

যুব সমাজ : এদের মূল্যায়ন হউক

যুব সমাজ : এদের মূল্যায়ন হউক
আলী ফোরকান
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩২ ভাগ যুবশক্তি। এই যুবশক্তির বিপুল অংশ আজ কর্মহীন। দিন যতই যাচ্ছে। ততই ক্রমবর্ধমান হারে কর্মহীন যুবকের সংখ্যা বেড়ে চলছে। যুব সমাজের একটা বড় অংশ তাদের কর্মদক্ষতা, সৃজনশীলতা, একনিষ্ঠতা দিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশংসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তুলনামূলক বিচারে তার বিপরীতে যুব সমাজের বিরাট অংশের কর্মহীন থাকা। সামাজিক অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এসব কারণে যুব সমাজের সার্বিকভাবে পিছিয়ে পড়ার বিষয়টিই চোখে পড়ে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারের যুব সদস্যরা এখন সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থানে রয়েছে বললে ভুল হবে না।
অবশ্য এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে। বিশেষ করে তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন পেশায় যুবকরা খুবই ভালো করছে। কর্মে যোগ্যতা ও অসম্ভব রকম দক্ষতার পরিচয় দিয়ে বিশ্বব্যাপী অনেকেই স্বীকৃতি লাভ করতেও সক্ষম হয়েছে। আমাদের চার পাশে তাকালে এখন যেমন তুখোড়, মেধাবী, দক্ষ, সৃষ্টিশীল যুবকের দেখা পাওয়া যায়। তেমনি আবার দেখতে পাওয়া যায় বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত অনেক যুবককে। জীবনের অন্যরকম এক নিয়তির কাছে যারা আত্মসমর্পণ করে বসে আছে। এ ধরনের যুবকের সংখ্যা গুনে শেষ করবার নয়। হাজার লক্ষ পেরিয়ে এই সংখ্যা আরও সামনে এগোচ্ছে। এসব যুবকের অনেকেই বেকার। মাদকাসক্ত, মূল্যবোধহীন, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী। আরও নানা বিশেষণে তাদের বিশেষায়িত করা যায়। মূলত রাজনৈতিক কুসংস্কৃতি এবং দরিদ্রতার কারণেই এমনটি হয়েছে।
তবে আশা-জাগানিয়া খবরও আছে অনেক। এখন পত্রিকা খুললে দেখতে পাই আমাদের যুবকরা নতুন নতুন সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।
অনেকেই নির্বিবাদে বেছে নিচ্ছে চ্যালেঞ্জিং সব পেশা। ব্যবসাসহ বিভিন্ন খাতে অসংখ্য যুবক খুবই দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। দেশের জন্য সুনাম বয়ে নিয়ে আসছে। হালে কৃষি, পোল্ট্রি, মৎস্য এবং অপরাপর বিভিন্ন সমবায় খাতে শিক্ষিত যুবকরা যেভাবে নিজেদের জড়িয়েছে। সেটাও খুবই প্রশংসনীয়। এসবের বাইরে আমাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ যুবসংবাদ হলো অভিবাসী যুবকরা। যারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। প্রতিবছর কয়েক লাখ অভিবাসী শ্রমিক তাদের গায়ের রক্ত পানি করে শত শত কোটি টাকা বিদেশ থেকে দেশে নিয়ে আসছে। হালে আমাদের জন্য আরও উদ্দীপ্ত হওয়ার মতো অনেক সংবাদই নিয়ে আসছে আমাদের যুবকরা। হিমালয় পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে ওঠার জন্য আমাদের একদল তরুণ-তরুণী প্রস্তুতি নিচ্ছে। টেকনাফ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছে অনেক যুবক-যুবতী। দেশের সবচেয়ে উঁচু কেওক্রাডং, তাজিনডংয়ের চূড়াও ছুঁয়ে এসেছে আমাদের যুবকরা। অথচ একসময় আমাদের যুব সমাজ এসব নিয়ে খুব একটা ভেবেছে বলে মনে হয়নি।
আমাদের দেশে মূলত যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। মূলত তাদের যুবক বলা হয়। অবশ্য পৃথিবীর সব দেশে যুবককে একভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। একেক দেশে যুবকের সংজ্ঞা একেক রকম। যেমন জাতিসংঘের ভাষায় তারাই হলো যুবক। যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। আবার আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ১৫ থেকে ৩৪ বছর যাদের বয়স। তাদের যুবক বলা হয়। মালয়েশিয়াতে অবশ্য এই বয়সসীমা ৪০ বছর পর্যন্ত। যে বয়সসীমাকে ধরে যুবকের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত ধরলে আমাদের দেশে মোট যুব জনসংখ্যা সাড়ে চার কোটির মতো। অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের মতে, আমাদের দেশে প্রতি তিনজনে একজন যুবক। যা ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের মোট ১৭টি দেশের সমান। যা হিসাব করলে অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি। শুধু এই নয়, আলজেরিয়া, সুদান, নে, দক্ষিণ আফ্রিকা, তাঞ্জানিয়া, কানাডা, আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া, ইরাক, মালয়েশিয়াÑএসব দেশের মোট জনসংখ্যারও বেশি।
এই অর্থনীতিবিদ তার গবেষণায় আরও বলেছেন, দেশের যে সাড়ে চার কোটি যুবক রয়েছে তার মধ্যে ৮০ শতাংশ গ্রামে বসবাস করে। আর এই যুব জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি মহিলা। তিনি আরও একটি প্রক্ষেপণে বলেছেন, আগামী ২০২০ সালে আরও ৮৫ লাখ যুবকের নব সংযোজন ঘটবে।
তবে আমাদের দেশে মোট শ্রমশক্তির ৮০ শতাংশ যুবক। এর মধ্যে মোট বেকারের ৮৬ শতাংশ আবার তারাই। মুক্ত বেকারের সংখ্যা আরও ব্যাপক। এই পরিসংখ্যানগুলো দেখেই আমরা সামনের দিনগুলোর ভয়াবহতা আঁচ করতে পারি। বলা হয়ে থাকে, যুবকরা দেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
এভাবে বলার কারণও আছে। আমরা দেখেছি সেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানসহ সব আন্দোলন-সংগ্রামেই আমাদের যুবকরা সবচেয়ে গৌরবময় ভূমিকা রেখেছে। আবার দেশের যে কোনো দুর্যোগের সময় যুবকরা অবারিত চিত্তে অসহায়, দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু একথা মানতেই হবে যে, আমাদের যুব সমাজের আরও যতটা আলোকিত হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। এখন যেভাবে আমরা পরিকল্পনাহীনভাবে অগ্রসর হচ্ছি। তাতে আগামী দিনে আমাদের যুব সমাজের জন্য খুব ভালো একটা পৃথিবী তৈরি করা খুবই কঠিন বিষয়। আমরা যদি সত্যিই অনুভব করি যে আমাদের যুব সমাজকে আরও দক্ষ, যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে, যুবকদের দক্ষ মানবসদে পরিণত করতে হবে, তাহলে অবশ্যই আমাদের সামনে সবার আগে একটা জাতীয় যুব উন্নয়ন পরিকল্পনা থাকতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের কিছু বিষয় অগ্রাধিকার দিয়ে দেখতে হবে। যেমনÑ প্রথমত, সারাদেশের যুবকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে হবে। এর জন্য জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে। উল্লেখ্য, সর্বশেষ জাতীয় বাজেটে যুব উন্নযন খাতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের মাত্র ০.৪২ ভাগ।
দ্বিতীয়ত, যুব সমাজকে রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে দল-মত নির্বিশেষে ব্যবহার সম্পূণরুপে বন্ধ করতে হবে। সারাদেশের যুবকদের মাঝে ‘ইয়ুথ লিডারশিপ’ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রাম পর্যায়ের যুবকদের উদ্দীপ্ত করতে বিভিন্ন ধরনের আদর্শভিত্তিক উদ্যোগ নিতে হবে।
তৃতীয়ত, ব্যাপক সংখ্যক যুবককে প্রশিক্ষণ প্রদান করে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, লিবিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানোর জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণ প্রদান করে সরকারের পক্ষ থেকে সহজতর ব্যবস্থা নিতে হবে। অদক্ষ যুবকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। অভিবাসী যুব শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।
চতুর্থত, দক্ষ মানবসদ তৈরির লক্ষ্যে গ্রাম ও শহরের বেকার যুবকদের মাঝে ব্যাপক চাহিদাভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে বাবসা-বাণিজ্য এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্র উদ্যোগকে সহায়তা করতে ব্যাপক ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
পঞ্চমত, যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্কুল-কলেজগুলোতে গার্ল গাইডস, স্কাউট আন্দোলন, বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড আরও ব্যাপকভাবে চালু করতে হবে।
ষষ্ঠত, বেকার যুবকদের দাবিগুলোকে অধিকারের জায়গা থেকে দেখতে হবে। যুব মহিলাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণমূলক কাজকর্ম হাতে নিতে হবে।
সপ্তমত, সারাদেশে ব্যাপকসংখ্যক যুব ক্লাব গড়ে তুলতে হবে। এসব ক্লাবের মাধ্যমে যুবশক্তির মাঝে নৈতিক মূল্যবোধ বাড়াতে হবে। যুব উদ্যোক্তাদের ঋণ সুবিধা প্রদান আরও সহজ করতে হবে।
অষ্টমত, যুবকদের শ্রমভিত্তিক বিভিন্ন কাজকে অনুপ্রাণিত করার জন্য এবং তাদের কাজের স্বীকৃতি দিতে জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন ধরনের পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে।
নবমত, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ব্যবসা, কৃষিসহ বিভিন্ন পেশায় যুবকদের বিভিন্ন ধরনের সাফল্যকে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
দশমত, ২০৪১ সালকে সামনে রেখে সবার অংশগ্রহণে একটি সুন্দর ‘জাতীয় যুব নীতিমালা’ প্রণয়ন করতে হবে।
যুব সমাজ মানেই এক প্রচন্ড শক্তি। কিন্তু এই শক্তিকে আমরা যথার্থ মানবসম্পদে পরিণত করতে না পারলে দেশের প্রত্যাশিত উন্নয়ন ব্যাহত হবে।

0 comments:

Post a Comment