Thursday, June 16, 2016

মার্ক জাকারবার্গ ও সাইবার দুনিয়ায় সামাজিক যোগাযোগ

মার্ক জাকারবার্গ ও সাইবার দুনিয়ায় সামাজিক যোগাযোগ
আলী ফোরকান
ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক। বিশ^ ব্যাপী গড়ে উঠেছে সামাজিক সম্পর্কের শক্তিশালী এক নেটওয়ার্ক। যে নেটওয়ার্কে বসে হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা আপন মানুষটির সঙ্গে মনের কথা বলা যায়। খুঁজে বের করা যায় হারিয়ে যাওয়া পুরোনো বন্ধুটিকে। সাইবার দুনিয়ায় সামাজিক যোগাযোগের সর্ববৃহৎ এই নেটওয়ার্কের নাম ফেসবুক। ফেসবুকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মার্ক এলিয়ট জাকারবার্গ। মাত্র ২৬ বছরের টগবগে এক মার্কিন তরুণ। সফল একজন ব্যবসায়ী। বিশ্বের সবচেয়ে কমবয়সী বিলিয়নিয়ার। যিনি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে এক সুতোয় গেঁথেছেন। বিশ্বখ্যাত টাইম সাময়িকীর দৃষ্টিতে মার্ক জাকারবার্গ হয়েছেন ২০১০ সালের ‘পারসন অব দি ইয়ার’।
আজ থেকে দশক চারেক আগে বিজ্ঞানীরা জাতপাতহীন এক ও অভিন্ন বিশ্বের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই দশকের মাঝামাঝি ওই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয় কৈশোর উত্তীর্ণ জাকারবার্গের হাত ধরে। ফেসবুক এখন যেন জাতপাতহীন এক ভার্চুয়াল দুনিয়া।
শৈশব ও কৈশোর: ১৯৮৪ সালের ১৪ মে নিউইয়র্কের হোয়াইট প্লেইনস গ্রামে জন্ম মার্কের। বাবা এডওয়ার্ড দন্ত চিকিৎসক। মা কারেন একজন মনোরোগ চিকিৎসক। মার্ক ছাড়াও এডওয়ার্ড-কারেন দম্পতির ঘরে আছে তিন মেয়ে র‌্যান্ডি, ডোনা ও এরিলি। ছেলেমেয়েদের লালন-পালন করেছেন গাঁয়ে। নিউইয়র্কের ডোবস ফেরিতে। শৈশব থেকেই মার্ক পড়াশোনা ও কাজকর্মে ছিলেন চৌকস।
কৈশোরেই ইংরেজির পাশাপাশি ফরাসি, হিব্রু, লাতিন ও প্রাচীন গ্রিক ভাষায় কথা বলা ও লেখা শিখে যান মার্ক। কম্পিউটারের প্রতি ঝোঁক দেখে ছেলেকে নিজেই প্রোগ্রামিং শেখানো শুরু করেন এডওয়ার্ড। সে ১৯৯০ সালের কথা। মার্ক তখন ছয় বছরের শিশু। তখনই তাঁকে আটারি বেসিক প্রোগ্রামিংয়ের ওপর পড়ানো শুরু করেন এডওয়ার্ড। পরে একজন গৃহশিক্ষক (সফটওয়্যার নির্মাতা) রেখে দেন। ডেভিড নিউম্যান নামের ওই শিক্ষক জাকারবার্গকে ‘বিস্ময় বালক’ স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি।
যেন আজন্ম প্রোগ্রামার: যোগাযোগের কম্পিউটার প্রোগ্রাম এবং ভিডিও গেম নিয়ে আগ্রহ ছিল জাকারবার্গের। বাবার রোগী দেখার চেম্বার আর বাড়ির গুটিকতক কম্পিউটারের জন্য একটি প্রোগ্রাম বানান জাকারবার্গ। নাম দেন ‘জাকনেট’। এর সাহায্যে ব্যবহারকারীরা সহজেই একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন। মাধ্যমিকে পড়ার সময় ‘সিনাপস মিডিয়া প্লেয়ার’ নামের একটি মিউজিক প্লেয়ার বানান খুদে এই প্রতিভা। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারী বা শ্রোতার রুচি সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যেত। মাইক্রোসফট ও এওল সফটওয়্যারটি কেনার আগ্রহ দেখায়। মার্ককে চাকরিরও প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মার্ক সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং সফটওয়্যারটি আরও উন্নত করতে স্কুল পর্যন্ত ছেড়ে দেন। পরে পড়াশোনা করতে চলে যান হার্ভার্ডে।
ফেসবুকের জন্ম: হার্ভার্ডে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের ওপর পড়াশোনা শুরু করেন জাকারবার্গ। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় সহায়ক ‘কোর্সম্যাচ’ নামের একটি সফটওয়্যার তৈরি করেন। কলেজের সুদর্শন তরুণ-তরুণী বাছাই করতে অল্পদিনের মাথায় ‘ফেসম্যাশ’ নামের আরেকটি সফটওয়্যার বানান মার্ক। ছবি দেখে আবেদনময় তরুণ-তরুণী বাছাইয়ের হিড়িক পড়ে যায় গোটা কলেজে। এতে কলেজের ওয়েব সার্ভারে বাড়তি চাপ পড়ে। কর্তৃপক্ষ সাইটটি বন্ধ করে দেয়। শিক্ষার্থীরা দাবি তুললেন, ওই রকম একটি ওয়েবসাইট তাঁদের চাই। যেখানে শিক্ষার্থীদের নাম, ঠিকানা, ছবি ও তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের বিস্তারিত তথ্য থাকবে। এ কথা শুনে মার্ক প্রতিজ্ঞা করেন, কলেজ কর্তৃপক্ষ করে না দিলে তিনি নিজে শিক্ষার্থীদের জন্য এমন একটি ওয়েবসাইট তৈরি করবেন। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে গিয়েই জাকারবার্গের হাতে জন্ম নেয় পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বৃহত্তম সামাজিক যোগাযোগের সাইটটি। ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হার্ভার্ডের ডরমিটরিতে ফেসবুকের উদ্বোধন করেন জাকারবার্গ। গোটা দুনিয়ায় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন ৫৫ কোটি।
ফেসবুক কার্যালয়: ক্যালিফোর্নিয়ার প্যালো আল্টোতে ফেসবুকের বিশাল কার্যালয়। টাইম ম্যাগাজিনের এক সাংবাদিক সেখানে গিয়েছিলেন জাকারবার্গের সাক্ষাৎকার নিতে। তাঁর বর্ণনা এমনস্তঅ্যাকুরিয়ামে (সম্মেলনকক্ষটির এমনই নাম দেওয়া হয়েছে) সহকর্মীদের নিয়ে বৈঠকে বসেছেন মার্ক। সামনে কাগজপত্র নেই। হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছেন। তিন দিকে কাচ দিয়ে ঘেরা বিশাল কক্ষটি গোটা অফিসে তাঁদের গোপনীয়তা রক্ষার একমাত্র স্থান। কারণ অফিসটা একেবারে খোলামেলা। পর্দা ও দেয়ালহীন একটি অফিস। কর্মীরা যেন একজন আরেকজনকে সহজে দেখতে পান। পারস্পরিক ভাব বিনিময় করতে পারেন এ জন্যই এমন ব্যবস্থা। সবার জন্য একই ধাঁচের কম্পিউটার ও আসবাব। এমনকি মার্কের জন্য আলাদা বসার কোনো কামরা নেই। অফিসের ছাদ থেকে ঝুলছে বাহারি রঙের শোপিস। না অফিস, না বাড়ি-এমনই একটি আবহ বিরাজ করছে অফিসজুড়ে। সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, মার্ককে তাঁরা প্রচন্ড ভালোবাসেন।
প্রেম: পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি উচ্চতার জাকারবার্গের মুখের ওপর নাকটা রোমান ধাঁচের। কোঁকড়া বাদামি চুলে ঢাকা মাথা। জিনস আর টি-শার্ট তাঁর পছন্দের পোশাক। আর দশটা তরুণের মতো মার্কের জীবনেও প্রেম এসেছে। তাঁর প্রেমিকার নাম প্রিসিলা চ্যান। হার্ভার্ডে পড়ার সময় ২০০৪ সালে প্রিসিলার সঙ্গে পরিচয় মার্কের। সেই পরিচয় থেকে প্রণয়। বর্তমানে দুজন এক সঙ্গে থাকছেন।
উদার হূদয়ের এক তরুণ: এত অল্প বয়সে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ মাথা ঘুরিয়ে দেয়নি মার্কের। উচ্চাভিলাষী কোনো চিন্তাভাবনা নেই তাঁর। হতে চান একজন সাদাসিধা মানুষ। সুযোগ পেলে মা-বাবা, ভাই-বোনকে নিয়ে ঘুরতে বের হন। বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেটের মতো ধনকুবেরদের সঙ্গে মিলে তরুণ এই প্রযুক্তিবিদ একটি চুক্তি সই করেছেন। নৈতিক ওই চুক্তিতে মার্ক জাকারবার্গ তাঁর জীবনের অর্ধেক সম্পত্তি দাতব্য কাজে দান করে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। ফেসবুকের মতোই শ্রেণীবৈষম্যহীন এক বিশ্বের স্বপ্ন দেখেন জাকারবার্গ। যেখানে মানুষের মধ্যে মানবিক গুণগুলো আরও জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠবে।
তথ্যসুত্র: ইন্টারনেট

0 comments:

Post a Comment