পরিবেশ: জনসংখ্যা ভারাক্রান্ত, অপরিচ্ছন্ন ও যানযটপূর্ণ ঢাকা
আলী ফোরকান
ঐতিহ্য ও আধুনিকতায় মেশানো আমাদের প্রিয় ঢাকা। আজ জনসংখ্যা ভারাক্রান্ত, অপরিচ্ছন্ন ও যানযটপূর্ণ। দূষিত এর পরিবেশ। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে ঢাকা মহানগরীর পরিবেশ ভারসাম্যহীন। বাংলাদেশের যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যথা বন্যা, নদীভাঙ্গন, সাইক্লোন, সিডর, আইলা, মঙ্গা প্রভৃতিতে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন খাদ্য, কর্ম ও আশ্রয়ের জন্য পাড়ি জমান রাজধানীতে। কিন্তু কাক্ষিত কাজ, খাদ্য বা বাসস্থান তারা পান না। রাজধানীতে এসে এক দক্ষ কৃষক হয়ে যান এক অদক্ষ রিকশাচালক, গ্রহণ করেন নিম্নমানের খাদ্য এবং আশ্রয় মেলে অস্বাস্থ্যকর অবৈধ স্থানে। এদের সংখ্যা এত অধিক যে তারা নষ্ট করেন পরিবেশ, তৈরি করেন যানযট এবং সৃষ্টি করেন অসুস্থ প্রজন্ম। এতে অপরাধ প্রবণতার মাত্রাও বেড়ে যায়। দুর্যোগ উত্তরকালে সরকার, এনজিও বৈদেশিক রাষ্ট্র, সাহায্যসংস্থা ও দেশের বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গ বিচ্ছিন্নভাবে সাহায্যের হাত বাড়ান। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতার কারণে ঢাকামুখী দুর্যোগকবলিত জনসংখ্যাকে ঠেকানো যায় না। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ে তুলতে হলে ঢাকায় ধারন ক্ষমতার অতিরিক্ত জনবসতির সুযোগ দেয়া যাবে না। পরিকল্পিত ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এ নগরীর জনসংখ্যা নির্ধারিত হবে। ঢাকামুখী জনস্রোত ঠেকানোর সাথে সাথে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে দেশের অন্যত্র পুনর্বাসিত করতে হবে। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে বিপুল সম্ভাবনাময় কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তুলতে হবে। ঢাকাকে সুস্থ রাখতে হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ শিল্প গড়ে তুলে দুর্গতদের কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসিত করতে হবে। সর্বাগ্রে পূর্বাহ্নেই দুর্যোগ মোকাবেলায় সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, ঢাকার বাইরে গার্মেন্টসপল্লী স্থাপন, চামড়া শিল্প-কারখানা স্থানান্তর প্রভৃতি পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। ঢাকা শহরে অপরিকল্পিতভাবে স্বল্পপরিসরে বাসস্থান, শিল্প-কারখানা, দোকানপাট, ব্যবসাকেন্দ্র ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। পার্শ্ববর্তী অঞ্চল নিয়ে ঢাকা মহানগরীর আশু সম্প্রসারণ প্রয়োজন। সম্প্রসারিত অংশসহ ঢাকাকে অঞ্চল-১ ও অঞ্চল-২ নামে দু’ভাগে ভাগ করে অঞ্চল-১ এ কোন নতুন শিল্প-কারখানা করার অনুমতি দেয়া যাবে না। এ অঞ্চলের বর্তমান শিল্প-কারখানাসমূহ পর্যায়ক্রমে অঞ্চল-২ এ স্থানান্তরিত করা হবে। দুই অঞ্চলের যোগাযোগ উন্নত ও আধুনিক করার ব্যবস্থা জরুরীভিত্তিতে গ্রহণ করতে হবে। ঢাকা মহানগরীর সেবা মূল্য কে দেশের অন্যান্য অংশের চেয়ে বেশি নির্ধারণ করে এটাকে ব্যয়বহুল হিসেবে নগরী গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করলে ঢাকাকে কাঙিক্ষত জনসংখ্যার নগরীতে পরিণত করা সহজ হবে।
পরিচ্ছন্নতা:
পরিবেশ রক্ষার পূর্বশর্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। মহানগর পরিচ্ছন্ন রাখার দাপ্তরিক দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের এবং এর জন্য রয়েছে তাদের কর্মীবাহিনী, যারা ব্যক্তিগতভাবে খুবই অপরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করে। প্রয়োজনের তুলনায় লোকবলের অভাব ছাড়াও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের দক্ষতা, প্রশিক্ষণ, আন্তরিকতা, প্রণোদনা কার্যাবেক্ষণ, উপকরণসহ অনেক কিছুর অভাবে নগরীর পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, কর্পোরেশন বলে অর্থের অভাব এবং কর্মী বলে ন্যায্য পারিতোষিকের অভাব। ময়লা নিষ্কাশনের ড্রেন সঠিকভাবে নির্মাণ, সময়মত সংস্কার ও মেরামত, ডাস্টবিনের যথাযথ ব্যবহার না করা পরিবেশকে অনেকাংশে দূষিত করে। পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনার জন্য সিটি কর্পোরেশনের যে বাড়তি অর্থের প্রয়োজন তা সেবামূল্য হিসাবে নগরবাসীদেরকে যোগান দিতে হবে। বাড়তি অর্থ আদায়ের জন্য নগরীর প্রতি হোল্ডিং মালিকদের নিজস্ব হোল্ডিং-এর বিপরীতে বার্ষিক ফি প্রদানপূর্বক নবায়নযোগ্য বাধ্যতামূলক ‘পরিচ্ছন্নতা নিবন্ধন’ গ্রহণের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। হোল্ডিং এবং এলাকা অনুযায়ী ফি-এর পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। সেবা মূল্য গ্রহণের মাধ্যমে সেবার মান নিশ্চিত করতে হবে। শক্তিশালী স্বতন্ত্র পরিচ্ছন্নতা ও পরিবেশ বিভাগ গঠন, প্রয়োজনীয় সংখ্যায় পরিচ্ছন্ন কর্মী নিয়োগ, তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, দক্ষতা অনুযায়ী পারিশ্রমিক বৃদ্ধি, কাজের মূল্যায়ন, উদ্ভুদ্ধকরণ, গণ সচেতনা সৃষ্টি প্রভৃতি কার্যক্রমের মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশন পরিচ্ছন্ন ঢাকা গড়ে তোলায় অনেক ধাপ এগিয়ে যাবে। অফিস বিল্ডিং, মার্কেট, হাসপাতাল, কারখানা ইত্যাদি পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব সংশ্লিষ্টদেরকে নিতে হবে। বর্জ্য রাসায়নিক দ্রব্য ও অন্যান্য জনস্বাস্থ্যের ক্ষতিকর পদার্থের প্রভাব সম্পর্কে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টরা সিটি কর্পোরেশনের সহায়তা নিতে পারে। জলাবদ্ধতা ও নদী দূষণ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবাই অবগত আছে এবং সমস্যা সমাধানে তাদের কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
বর্জ্য-পলিথিন/প্লাস্টিক:
অতীতে পরিবেশের স্বার্থে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার কার্যক্রম অনেকের প্রশংসা অর্জন করে। কিন্তু ইহা সময়োপযোগী কিনা এ ব্যপারটি কেউ চিন্তা করেনি। সহজলভ্য, স্বল্প ব্যয় ও সুবিধাজনক ব্যবহার উপযোগী পণ্যটি নিষিদ্ধ করার পূর্বে বিকল্প ব্যবস্থার কথা চিন্তা করা হয়নি। তাত্ত্বিকভাবে বিকল্প হিসাবে কাগজ/চটের ব্যাগ-এর কথা বলা হয়েছে যা বাস্তবভিত্তিক নয় বিধায় ব্যর্থ হয়েছে। এখন অন্য ফর্মে পলিথিন ফিরে এসেছে যা পূর্বের চেয়ে কম ক্ষতিকর নয়। সাথে অন্যান্য প্লাস্টিক বর্জ্য তো আছেই। পৃথিবীর বহুদেশে পলিথিন/প্লাস্টিক ব্যাগ প্যাকেজিং ও পরিবহন কাজে ব্যবহৃত একটি জনপ্রিয় সামগ্রী। ব্যবহার পরবর্তী ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করার মধ্যেই আছে এর সহজ সমাধান। পৃথিবীর অনেক দেশের মত এখানে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যাগের রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রী গড়ে তোলে পুনঃ ব্যবহার করা যায়। এর জন্য দরকার বিনিয়োগ ও সরকারি সহযোগিতা। পরিচ্ছন্নকর্মীরা ব্যবহৃত ব্যাগ সংগ্রহ করবে এবং প্রয়োজনে একাজে ভ্রাম্যমাণ কর্মী নিয়োগ করা যেতে পারে।
যানজট ও সড়ক:
ঢাকা এখন যানজটের শহর। ইহার অন্যতম কারণ রাজপথে অসংখ্য রিকশা চলাচল, অনির্ধারিত স্থানে বাস থামানো, যত্রতত্র গাড়ী পার্কিং, বিপুলসংখ্যক ত্রুটিপূর্ণ গাড়ীর কালো ধোঁয়া শহরের পরিবেশকে প্রতিনিয়ত দূষিত করছে। দোকানদার/হকারদের রাস্তা ও ফুটপাত দখল, সরকারী রাস্তায় নির্মাণসামগ্রীসহ অন্যান্য জিনিসপত্র রাখা, প্ল্যান বহির্ভূত বাড়ী নির্মাণ, রাস্তার উপর বাড়ীর সিঁড়ি, বাড়ীর প্রবেশপথ নির্মাণ ইত্যাদি কারণে রাস্তায় স্বাভাবিক চলাচলে বিঘœ ঘটে। ঢাকার অভ্যন্তরে প্রধান সড়কে রিকশা চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। নির্ধারিত বাস স্টপেজে বাস থামানো, পার্কিং স্থানে গাড়ী পার্ক করা, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ী প্রত্যাহার, ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ, ট্রাফিক ব্যবস্থা আধুনিকায়ন প্রভৃতি কার্যক্রম যানজট অনেকাংশে কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে। পরিবেশের স্বার্থে ঢাকার সকল রাস্তা চলাচলের জন্য ঝামেলা ও দখলমুক্ত রাখতে হবে। ফুটপাত শুধুমাত্র পায়ে চলার পথ হিসাবে ব্যবহৃত হবে। রাস্তার পাশে স্থাপনাসমূহের (রাজউক প্ল্যানভিত্তিক নির্মিত) অবৈধ অংশ দ্রুত অপসারণের ব্যবস্থা নিতে হবে। তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী সকল রাস্তার বিবরণ (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ইত্যাদি) বিস্তারিত জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। ম্যাপসহ ঢাকার প্রত্যেকটি রাস্তার বিবরণ সর্বসাধারণের অবগতির জন্য গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হউক। স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার কার্যালয়ে ম্যাপসহ সকল তথ্য জনগণের অবগতির জন্য সংরক্ষণ করা যেতে পারে। জনগণ জানলে ইহা ইতিবাচক ফল দেবে এবং কর্তৃপক্ষের বদলে স্থাপনাকারী নিজেই অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলবে। প্রয়োজনে এক সংস্থা রাস্তা খুড়লে তা মেরামতের দায়িত্ব অন্য সংস্থার সমন্বয়হীনতার কারণে রাস্তা দীর্ঘদিন মেরামত হয় না এবং এর সমাধান পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় জরুরী। মহানগরীর পরিবেশ সমস্যা ও সমাধানের পথ নিয়ে মোটা দাগে আলোচনা করা গেলে। বিশেষজ্ঞগণ বিশ্লেষণ করে দিক-নির্দেশনা দেবেন এবং নীতি নির্ধারকগণ পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আমরা পাবো পরিবেশবান্ধব সুন্দর পরিচ্ছন্ন ঢাকা মহানগরী।
0 comments:
Post a Comment