পরিবেশ:স্বাস্থ্যহানি ও নৈসর্গিক বিপর্যয়ের আশংকা বাড়বে
আলী ফোরকান
অতিরিক্ত কয়লা এবং অন্যান্য জ্বালানি ব্যবহারের কারণে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ সারা বিশ্বে বাড়ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত একপ্রতিবেদনে জানা গেছে, পৃথিবীতে গড় কয়লা ব্যবহার বেড়েছে ১০ কোটি ৭০ লক্ষ টন। এ বৃদ্ধির হার ৬ কোটি ৩০ লক্ষ টন। উন্নয়নশীল বিশ্বে শিল্পে মাত্রাতিরিক্ত কয়লার ব্যবহার প্রায় শতকরা ১.৫ হারে বেড়েছে। তার মানে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে আনুপাতিক হারে। ১৯৫০ সাল থেকে বিচার করলে কয়লার অধিক ব্যবহারজনিত কারণে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পশ্চিমী দেশসমূহে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হার শতকরা ৫০ থেকে কমে সাম্প্রতিককালে শতকরা ৪৫-এ দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীতে সর্বাধিক কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ সংঘটিত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, যার হার শতকরা ২৩ ভাগ। ১৯৯৬ সালে এ হার প্রায় শতকরা ৩.৫ বেড়েছে। এ কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখনো অব্যাহত আছে। জাপানের ক্ষেত্রে এ হার গত ছয় বছরে প্রায় শতকরা ১২.৬ হারে বেড়েছে এবং অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে এ বৃদ্ধির হার শতকরা ৯.৬। ১৯৯০ সালের পরে ১৯২০ সাল পর্যন্ত পৃথিবীতে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হার বেড়েছে শতকরা এক হারে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে কয়লার ব্যবহার সামান্য হ্রাস পাবার কারণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ যথেষ্ট কমেছে। জার্মানি, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে কয়লা ব্যবহার কমে যাওয়ায় বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ যথাক্রমে শতকরা ৭.৬, ২ ও ১.১ হারে হ্রাস পেয়েছে। ১৯৫০ সাল থেকে পূর্ব ইউরোপে ও পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ শতকরা ২১ থেকে কমে সাম্প্রতিককালে শতকরা ১৫-তে দাঁড়িয়েছে। গত এক দশকে শিল্পে কয়লার ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। তবে শুধু রাশিয়া বিশ্বের বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। রাশিয়ার এ নিঃসরণের পরিমাণ হল শতকরা ৩৮। শুধুমাত্র ইউক্রেনে শিল্পে কয়লার অধিক ব্যবহারের কারণে বাতাসে এ ক্ষতিকারক গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ প্রায় শতকরা ৫৬। তবে পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নতির কারণে কয়লার ব্যবহার কম হওয়ায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কম হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। উন্নতশীল দেশসমূহে কয়লার বহুল ব্যবহারের জন্য ১৯৫০ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত শতকরা ২৪ হারে বেড়েছে। এ নিঃসরণ বৃদ্ধির শতকরা হার হল ৪০। চীনে কয়লা বেশী ব্যবহারের কারণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের ক্ষেত্রে বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এ নিঃসরণ বৃদ্ধির হার শতকরা ১৪। ১৯৯০ সালের সমীক্ষার পরে চীনের বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হার আজ পর্যন্ত শতকরা ২৯ হারে বেড়েছে। বাংলাদেশে কয়লার ব্যবহারজনিত কারণে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হার বেড়েছে শতকরা ৩৮ হারে। ইন্দোনেশিয়ায় এ নিঃসরণ বৃদ্ধির শতকরা হার ৪৭। তবে উন্নয়নশীল বিশ্বের তুলনায় উন্নত বিশ্বে কয়লা অধিক ব্যবহারের কারণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হার আনুপাতিক হারে বেশী। বাংলাদেশের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হার বেশী। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে কয়লার অধিক ব্যবহারজনিত কারণে স্বাভাবিকভাবে বায়ু দূষণের হার অধিক। বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধির জন্যে মানুষের দায়িত্ব বেশী। বাতাসে গ্রীনহাউস প্রতিক্রিয়ার কারণে বায়ু দূষণের মাত্রা শতকরা ৬৪। আবহাওয়ায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধির মোট পরিমাণ এখন ৩৬৩.৬ ভাগ প্রতি লক্ষ পিপিএমে। এক সমীক্ষায় জানা গেছে, বর্তমানে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধি গত এক লক্ষ বছরের তুলনায় বেশী। পরিবেশ ভারসাম্যহানির ব্যাপারে এ ক্ষতিকারক গ্যাস বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়ে ৫৫০ পিপিএমে এসে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষতিকারক গ্যাসে বায়ু দূষিত হয়ে পৃথিবীর উত্তাপ বৃদ্ধি করেছে ৩ থেকে প্রায় ৩.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ উত্তাপ বৃদ্ধি পেতে থাকলে একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের জন্যে অনেক পরিবেশগত বিপর্যয় ছাড়াও উত্তাপ বৃদ্ধির কারণে পূর্বে যেসব স্থানে মশাবাহিত রোগ কম ছিল সেখানে মশা বৃদ্ধির জন্য মশাবাহিত রোগের আশংকা দ্রুত হারে বাড়ছে। এ উত্তাপ বৃদ্ধির হার চলতে থাকলে মানুষের স্বাস্থ্যহানি ও নৈসর্গিক বিপর্যয়ের আশংকা বাড়তে থাকবে। বিশ্ব আবহাওয়াবিদদের সংগঠন আইপিপিসি তাই স্থির করেছে ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের উৎস প্রায় ২০ কোটি টন কমাবে। সংঘটিত প্রচেষ্টায় এ ক্ষতিকারক গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ ৩৫০ পিপিএম লেভেলে আসবে। এভাবে বায়ু দূষণের পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পেলে পৃথিবীর উত্তাপ গত দু’লক্ষ বছরের লেভেলে নিয়ন্ত্রিত হবে। গত পরপর পরিবেশ সম্মেলনে স্থির হয়েছে পৃথিবীর শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহে কয়লার ব্যবহার দ্রুত হারে কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালানো হবে। সম্মেলনে ঘোষণাপত্র প্রণয়নে বিশ্বের ১৭১টি দেশ অংশ নিয়েছিল। এ প্রচেষ্টার ফল মিলছে বর্তমানকালে। এ মূহূর্তে ক্ষতিকারক গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ১৯৯০ সালের তুলনায় অনেক কমে গেছে। পৃথিবীর আবহাওয়ায় এ ক্ষতিকারক গ্যাস হ্রাসের পরিমাণ স্থির হয়েছে শতকরা ৫.২। সম্মেলনে বলা হয়েছিল যে বর্তমান বায়ু দূষণের পরিমাণ শতকরা ২.৯ হারে কমাতে পারলে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো যাবে। সম্মেলনে স্বাক্ষরকারী দেশসমূহে ১৯৯০ সালের তুলনায় ইতিমধ্যে এ ক্ষতিকারক গ্যাস হ্রাস পেয়েছে শতকরা ২.৩ ভাগ। তবে ক্ষতিকারক গ্রীনহাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর দায়িত্ব বেশী। কারণ উন্নত দেশগুলোর জন্য বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেড়ে পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে।
0 comments:
Post a Comment