Saturday, June 18, 2016

খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি প্রযুক্তি

খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি প্রযুক্তি
আলী ফোরকান
উনিশ শতকের ষাটের দশকে চীন যখন সে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা দিতে পারছিল না। তখন চীনের প্রফেসর ড. লং পিং ইউয়ান যাকে হাইব্রিড রাইসের প্রবক্তা বা জনক বলা হয়। ১৯৬৪ সালে গবেষণা শুরু করেন ধান উৎপাদনে হেটারোসিস পদ্ধতির প্রয়োগ নিয়ে। ১৯৭০ সালে সর্বপ্রথম চীনের হাইনান দ্বীপে মেইল স্টেরাইল লাইন আবিষ্কৃত হয়। ১৯৭২ সালে ইরি হাইব্রিড রাইস প্রোগ্রামের অধীনে গবেষণা করে রেস্টোরার লাইন আবিষ্কার করে; কিন্তু পরে ইরি’র এ কর্মসূচিকে বাতিল করা হয়। ইতোমধ্যে ১৯৭৬ সালে ড. ইউয়ানের প্রচেষ্টায় হাইব্রিড ধানকে চীনে বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়। পরে ইরি ১৯৭৯ সালে পুনরায় হাইব্রিড রাইস প্রোগ্রাম শুরু করে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে চীনে হাইব্রিড ধানের চাষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সে দেশের সরকারের সরাসরি প্রচেষ্টায়। ১৯৯৪ সালে ইরি হাইব্রিড রাইস প্রবর্তন করে এর বাণিজ্যিক চাষের জন্য অনুমোদন দেয়। ১৯৯৫ সালে চীনে ২টি লাইন বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়। এরপর ২০০৪ সালে প্রফেসর ড. লং পিং ইউয়ানস বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৮ সালে ইরি একটি কনসোর্টিয়াম গঠন করে বিশ্বের ২০ মিলিয়ন হেক্টর জমি হাইব্রিড ধান চাষের আওতায় আনার জন্য। ফাও এর তথ্য অনুযায়ী চীন বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধান উৎপাদনকারী দেশ। চীনের মোট ধান উৎপাদনের পরিমাণ ১৯৩ মিলিয়ন টন। যা বিশ্বের মোট ধান উৎপাদনের ৩৫ শতাংশ। হাইব্রিড ধান চাষের বদৌলতে চীন তার ১৩৫ কোটি মানুষের খাবার জোগান দিতে সমর্থ হয়েছে। যা কোন আমদানি ছাড়াই। হাইব্রিড রাইস প্রোগ্রামের কারণেই চীন আজ বিশ্ব অর্থনীতিতে এক উদীয়মান নক্ষত্র। খাদ্য উৎপাদনে হাইব্রিড রাইস প্রবর্তনের মাধ্যমে চীন যে সাফল্য দেখিয়েছে তা দেখে অনেক দেশই হাইব্রিড ধানের চাষ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে। ২০০৪ সাল থেকে ভারতে হাইব্রিড ধান জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। প্রচলিত জাত থেকে ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ ফলন বেশি পাওয়ায়।
বিশ্বের কয়েকটি দেশের হাইব্রিড ধান চাষের আওতায় জমির পরিমাণ (এফএও, এর তথ্য অনুসারে)
ইতোমধ্যে ভারত সরকার একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে হাইব্রিড ধানকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য। যাতে ২০৪০ সালের মধ্যে ৪ থেকে ৫ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে এর চাষ সম্প্রসারণ করা যায়।
বাংলাদেশে ধান চাষের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, উনিশ শতকের ষাটের দশকে ইরি-৮ নামে খাটো জাতের উচ্চফলনশীল ধান দেশে চাষ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত যে অবস্থা ছিল তা হলো প্রচলিত জাতের বোরো। আমন ও আউশ ধানের চাষাবাদ করা হতো। যাদের ফলন ছিল হেক্টর প্রতি যথাক্রমে ১ দশমিক ৫ থেকে ২ টন। ১ থেকে ১ দশমিক ৫ টন ও ১ থেকে ১ দশমিক ২৫ টন। প্রচলিত এ জাতগুলো ছিল আলোর প্রতি সংবেদনশীল অর্থাৎ নির্দিষ্ট জাত নির্দিষ্ট মৌসুমেই চাষ করা যেত। এভাবে প্রচলিত জাতগুলো যখন বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারছিল না তখন আস্তে আস্তে ইরি কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাত ইরি-৮ জনপ্রিয় হতে থাকল এবং এর চাষ সম্প্রসারিত হতে লাগল। পরে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট একে একে নতুন নতুন উচ্চফলনশীল ধানের জাত বিভিন্ন মৌসুমের জন্য উদ্ভাবন করতে থাকে।  তা মাঠপর্যায়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফলে দেশে ধান চাষের ক্ষেত্রে এক নীরব বিপ্লব ঘটে যায়। ১৯৬১ সালের তুলনায় ধানের উৎপাদন ৩ গুণ বাড়ানো সম্ভব হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত ধানের জাতগুলো অধিকাংশই আলোক অসংবেদনশীল হওয়ায় একই জাত বছরের বিভিন্ন সময় চাষ করা সম্ভব হয়। এভাবে একই জমি থেকে বছরে ২ থেকে ৩টি ধান ফসল বর্তমানে পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। দেশে বর্তমানে বোরো মৌসুমে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত ২টি জনপ্রিয় জাত ব্রিধান-২৮ ও ব্রিধান-২৯ এর চাষ হচ্ছে। ব্রিধান ২৮-এর ফলন কিছুটা কম হলেও জীবনকাল তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় নিচু এলাকার জন্য জাতটি বেশ জনপ্রিয়। অন্যদিকে ব্রিধান-২৯ এর ফলন বেশি; কিন্তু এর জীবনকাল ১৬০ থেকে ১৭০ দিন হওয়ায় ধান কর্তনের আগ দিয়ে আগাম বন্যায় ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। অন্যান্য ধান উৎপাদনকারী দেশে একই মৌসুমে চাষের জন্য রয়েছে একাধিক উচ্চফলনশীল জাত। এর একটি সুবিধা হলো, যে কোন কারণে একটি ফসলের ফলনে নেতিবাচক প্রভাব পড়লে অন্যটির মাধ্যমে তা পূরণ করা যায়। এদিক দিয়ে আমরা একটু সমস্যায়ই রয়েছি। কারণ দেশের কৃষকরা এ দুটি জাতের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এখন কথা হচ্ছে, বাংলাদেশকে হাইব্রিড রাইস চাষের সম্প্রসাণে কোন প্রয়োজন আছে কিনা বা এর সম্ভাবনা কতটুকু রয়েছে। উন্নত জাত প্রবর্তনের ফলে দেশের ধানের উৎপাদন বেড়েছে। তবে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে সে হারে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো দুষ্কর হয়ে পড়েছে। কারণ ইচ্ছে করলেই দেশে ধানের জমি বাড়িয়ে ফলন বাড়ানো সম্ভব নয়। পাশাপাশি বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য প্রতি বছর অতিরিক্ত ধানের উৎপাদন করা দরকার ৫ লাখ টন। তাই এখন নজর দিতে হবে সীমিত পরিমাণ জমি থেকেই চাহিদার প্রয়োজনীয় ফসল উৎপাদনের। পরিবর্তিত প্রয়োজনের কারণেই মানুষ নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে চলেছে। আর তা গ্রহণ করে মানুষের সভ্যতাও টিকে থাকছে। এরই ধারাবাহিকতায় বর্ধিত মানুষের খাবার জোগাড় করার জন্য মানুষ চালিয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন গবেষণা। এভাবেই চীনের প্রফেসর ড. লং পিং ইউয়ান উদ্ভাবন করেন হাইব্রিড ধানের। এ হাইব্রিড ধান চীনের ৬০ শতাংশ ধানের জমিতে চাষ হচ্ছে। যার ফলে চীনের জনবহুল ১৩৫ কোটি মানুষের খাদ্য চাহিদা মিটিয়েও প্রতি বছর ১২ থেকে ১৫ লাখ টন চাল দেশটি রপ্তানি করতে পারছে। চীনের বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনকে অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বে সমৃদ্ধ করার পেছনে অবদান রয়েছে এ হাইব্রিড ধানের। জনবহুল এ বাংলাদেশের জন্যও হাইব্রিড ধান হতে পারে একটি সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি। ইতোমধ্যে দেশে প্রাইভেট সেক্টরের উদ্যোগে চীন থেকে বেশ কয়েকটি জাতের হাইব্রিড ধান এসেছে । যাদের জীবনকাল ১১০ থেকে ১২০ দিন এবং হেক্টর প্রতি ফলন দেয়ার ক্ষমতা ১০ থেকে ১২ টন পর্যন্ত। কাজেই আগামী দিনে আমরা যদি দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেখতে চাই। বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মোতাবেক ফসল উৎপাদন করতে চাই। তাহলে হাইব্রিড ধানের সম্প্রসারণ অত্যন্ত জরুরি। চীনের বিশেষজ্ঞ ড. জি’র মতে, চীনে ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে যেভাবে হাইব্রিড ধান জনপ্রিয় হয়েছে এবং এর চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে তার পেছনে ফোর্স হিসেবে কাজ করেছে চীনের সরকার। তাই আমরা আশা করব, ভারত ও চীনের মতো আমাদের সরকার হাইব্রিড ধান চাষ সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। যাতে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি।



0 comments:

Post a Comment