পরিবেশ: বন ও প্যারাবন ধ্বংসে বাড়ছে দুর্যোগ ঝুঁকি
আলী ফোরকান
দেশের একমাত্র ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। এখানে মানুষের কালো থাবায় এ বনটি এখন বির্পযস্ত। এই বনটি দেশের উপকূলীয় এলাকার মানুষের রক্ষা কবচ। অব্যাহতভাবে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট (প্যারাবন) ধ্বংসের কারণে দুর্যোগ ঝুঁকি বাড়ছে সেখানকার জনপদগুলোতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক দশক ধরে দেশে অস্বাভাবিক নিয়মে আঘাত হানছে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলে প্রতিরক্ষাব্যুহ হয়ে জনপদ রক্ষাকারী প্যারাবন এখন হুমকির মুখে। এরই মধ্যে বিস্তীর্ণ এলাকার প্যারাবন পুরোপুরি উজাড় হয়ে গেছে। বাকি এলাকাতেও চলছে বননিধনের প্রক্রিয়া। ফলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে হুমকির মুখে আছে খুলনার শ্যামনগর থেকে কক্সবাজারের উখিয়া পর্যন্ত ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলের প্রায় ৩ কোটি মানুষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের উপকূলীয় এলাকায় ১৫৮৪ থেকে মে-এপ্রিল ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত অস্বাভাবিক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সংখ্যা ২৭টি। সমসংখ্যক অস্বাভাবিক দুর্যোগ রেকর্ড হয়েছে মে-১৯৭০ থেকে মে-১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। এরপর ২০০৭ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। গত ৪ দশকে ২৫টি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্রায় ৭ লক্ষাধিক লোক মারা গেছে। গড়ে প্রতি বছর ১৭ হাজার ৫০০ লোক প্রাণ হারায়। এরমধ্যে ১৯৭০ এবং ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে যথাক্রমে ৫ লাখ ও ১ লাখ ৪০ হাজার (সরকারিভাবে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮১ ) এবং ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের ‘সিডর’ ঘূর্ণিঝড়ে তিন সহস্রাধিক লোক মৃত্যুবরণ করে। আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যমতে, ১৮৭৭ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে ৩৬৫টি ঘূর্ণিঝড় রেকর্ড আছে। যা মূল ভূখ-ে আঘাত হানার আগে দুর্বল হয়ে যায়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামীতে এরকম ঘূর্ণিঝড় মূল ভূখ-ে আঘাত হানতে পারে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন ন্যাচারের (আইইউসিএন) আবাসিক প্রতিনিধি ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘গত কয়েক দশকে প্রভাবশালীদের অবৈধ হস্তক্ষেপে উপকূলীয় প্যারাবন উজাড় হয়েছে। সেখানে চিংড়ি চাষের বিস্তার ঘটায় হুমকির মুখে পড়ছে পুরো জনপদ। চকরিয়া সুন্দরবন এরইমধ্যে বিলীন হয়েছে। হুমকির মুখে রয়েছে বরগুনা-পটুয়াখালী-পিরোজপুর-নোয়াখালী, ভোলা, হাতিয়া-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চল।’ বিশ্বের অন্যান্য ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের নদী-নালায় চলা যন্ত্রচালিত নৌকার বর্জ্য প্রতিবেশের জন্য বড় ধরনের হুমকি বলে জানান তিনি। প্যারাবন উজাড়ের প্রক্রিয়া ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে শুরু হয় জানিয়ে আইনুন নিশাত বলেন, ‘জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলবাসীকে রক্ষা করতে বন ধ্বংসের প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। সুন্দরবনের মোহনা থেকে তেঁতুলিয়ার মোহনা পর্যন্ত ঘনসবুজ বেষ্টনী তৈরি করতে হবে। অন্য উপকূলেও এ ধরনের পদক্ষেপ কার্যকর করতে হবে।’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক ড. কামাল হোসাইন বলেন, ‘সুন্দরবন ছাড়াও দেশের আরও প্রায় ৬০ হাজার একর প্যারাবন ধ্বংস হয়ে গেছে। ওইসব এলাকায় নতুন করে বনায়ন না হলে ভবিষ্যতে সুনামি, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগে ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনসহ উপকূলীয় এলাকায় দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে প্যারাবনই একমাত্র ভরসা। বনাঞ্চল রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে এ দুর্যোগ মোকাবিলা অসম্ভব হয়ে পড়বে। বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন ধারার প্রধান আমিনুর রসুল বাবুল বলেন, ‘শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় নয়, প্যারাবন উপকূলে ভাঙন রোধেও ভূমিকা রাখে। এই বন উজাড়ের কারণে অনেক এলাকায় বেড়িবাঁধ উপচে লবণাক্ত জল ঢুকছে। বন ধ্বংসের প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আগামী ৪০ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে কয়েকটি দ্বীপ সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে।’
0 comments:
Post a Comment