Monday, June 13, 2016

সড়ক দুর্ঘটনা কেন হয় ঃ চিহ্নিত করা সহজ ব্যাপার

সড়ক দুর্ঘটনা কেন হয় ঃ চিহ্নিত করা সহজ ব্যাপার
আলী ফোরকান
বাংলাদেশে এখন সড়ক দুর্ঘটনা হলো নিয়মিত খবর। সংবাদপত্র রিপোর্ট অনুযায়ী ১০-১৫ জন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন নিহত হন। এ হিসাবে এই মৃত্যুর সংখ্যা বছরে দাঁড়ায় চার-পাঁচ হাজার। অন্য রিপোর্ট থেকে জানা যায়, প্রকৃতপক্ষে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা আরও অনেক বেশি। সকালে উঠে খবরের কাগজ পড়া এখন স্বাস্থ্যের জন্য এক বড় রকম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে এখন ভালো খবর বলতে কিছু নেই বললেই চলে। এটা বললে কমই বলা হয়। কারণ এত রকম খারাপ খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, যা একটি সমাজ ও দেশের জন্য অভিশাপের মতো। এ অবস্থার দিকে তাকিয়ে কেউ অভিশাপে বিশ্বাস না করলেও এর শোচনীয় দিকটিকে বোঝানোর জন্যই অভিশাপের কথা বলতে হয়। এ অভিশাপ কোনো অতিলৌকিক ব্যাপার নয়। এটা হলো এ দেশে নানা ধরনের পুঞ্জীভূত ঘটনা ও প্রক্রিয়ার। বিশেষ করে সমাজের ক্রিমিনালাইজেশন বা অপরাধীকীকরণের পরিণতি। ১৯৭২ সাল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ নামে এ রাষ্ট্রে কোন পরিবর্তনটি সব থেকে লক্ষণীয় এবং উল্লেখযোগ্য, এ প্রশ্নের জবাবে নিদ্বর্ধিায় বলা চলে এটা হলো, সমাজের উত্তরোত্তর ক্রিমিনালাইজেশন। কেন এই দশা হলো বাংলাদেশের অর্থাৎ এর মূল কারণ কী? এ প্রশ্নের এক কথায় জবাব হলো, অপরাধীদের শাস্তির কোনো ব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে না থাকা। শাসন ব্যবস্থার শীর্ষে যারা অবস্থান করেন তারা থেকে শুরু করে নিম্নতর কোনো পর্যায়েই কারও ক্ষেত্রে আইনের কার্যকারিতা বলে কিছু নেই। এ দেশে শাসকশ্রেণীর বিভিন্ন অংশ, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলই সবসময় অপরাধীদের অপরাধ করার সুযোগ দেয়। তাদের রক্ষা করে। দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করলেও কোনো শাস্তি হয় না। এখানে আইন প্রয়োগের অবস্থা এমন যে, আইনগতভাবে নিরপরাধ হলেও তাদের অপরাধী কাজকর্ম আগের মতোই জারি থাকে। তারা আগের মতো নিজেরাই যে শুধু সব সম্ভাব্য ধরনের অপরাধ করে তা-ই নয়। তারা নিজেদের অপরাধী সাঙ্গপাঙ্গ ও দলীয় লোকদের অপরাধের সুযোগ-স্রষ্টা এবং অপরাধীদের রক্ষাকর্তা। কাজেই অপরাধ করে এরা অপরাধী হিসেবে শুধু নিজেদেরই আইনের আওতার বাইরে রেখে রক্ষা করে না তারা রক্ষা করে অন্য অপরাধীদেরও। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এখন পরিণত হয়েছে অপরাধীদের এক অভয়ারণ্যে। এ অভয়ারণ্যেই শাসকশ্রেণী, সরকারি দল এবং তাদের শীর্ষ নেতা-নেত্রী থেকে নিয়ে সর্বস্তরের অপরাধীরা অবাধে বিচরণ করে।
আগের কথায় ফিরে গিয়ে বলা যায়, প্রতিদিন সকালে সংবাদপত্রের পাতায় যা দেখা যায় তা হলো, অতি হোমরা-চোমরা থেকে নিয়ে অতি নিম্নপর্যায়ের ক্রিমিনালদের নানাবিধ অপরাধের খবর। অনেক লোমহর্ষক অপরাধের সচিত্র প্রতিবেদন। যত রকম অপরাধের বিবরণ সংবাদপত্রে থাকে তার সবগুলোর ওপর আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। এখানে অপরাধের একটি ক্ষেত্র নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার।
আজকের সংবাদপত্রগুলোতে বিভিন্ন জায়গার সড়ক দুর্ঘটনার খবর আছে। তবে একটি খবর উল্লেখ নকরলাম। রিকশাভ্যানে চড়ে এক মহিলা তার দুই ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার সময় একটি হিউম্যানহলার ভ্যানটিকে প্রচন্ড বেগে ধাক্কা দেওয়ায় মহিলা ও ভ্যানচালক গুরুতর আহত হন এবং মহিলার দুই ছেলেই এই দুর্ঘটনায় নিহত হয়। স্বামী পরিত্যক্ত এই দরিদ্র মহিলা তার ১২ এবং ৮ বছরের দুই ছেলেকে নিয়ে অল্প পুঁজি খাটিয়ে মুরগি, কবুতর ইত্যাদি কেনাবেচা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি কিছু মুরগি ও কবুতর কিনে দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে রিকশাভ্যানে চড়ে সেগুলো বাজারে বিক্রির জন্য যাচ্ছিলেন। এমন সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে। মহিলা নিজে এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন। তিনি এখনও জানেন না, তার দুই সন্তানই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। এ সংবাদ বর্তমান অবস্থায় যে তারও মৃত্যু ঘটাতে পারে এই আশঙ্কায় তাকে তার সন্তানদের মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়নি। কিন্তু এ খবর এখন দেওয়া হোক আর না-ই হোক, তিনি কিছুটা সেরে উঠলে এ খবর তাকে দিতেই হবে। তখন তার কী অবস্থা দাঁড়াবে এটি ভাবলে যে কোনো সংবেদনশীল মানুষের মনের অবস্থা কী হবে এটি বুঝিয়ে বলার দরকার হয় না।
প্রাচীন ভারতে যে কোনো অঘটন, দুর্ঘটনা, জনগণের ক্ষতি হলে তার জন্য রাজাকেই দায়ী করা হতো। এখনও এসবের জন্য সব দেশেই সাধারণভাবে সরকারকে দায়ী করা হয়। কোনো দুর্ঘটনা বা অঘটন যে বিশেষ ক্ষেত্রে ঘটে সে ক্ষেত্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বা সরকারি কর্মকর্তা, সরকারপ্রধানকে এর জন্য দায়ী সাব্যস্ত করা হয়। অনেক দেশে ঘটনার দায়-দায়িত্ব নৈতিকভাবে স্বীকার করে নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী পদত্যাগও করে থাকেন। বাংলাদেশে এটি এক অচিন্তনীয় ব্যাপার। এ দেশে ভোটে জয়লাভের অর্থ দায়িত্ব ঘাড়ে পড়া নয়। এর অর্থ হলো যথেচ্ছ কাজ কারবার করার লাইসেন্স। এভাবে লাইসেন্সপ্রাপ্ত হয়ে এরা জনগণকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেদের পকেট ভর্তি ও ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করে। এটা যদি না হতো তাহলে বাংলাদেশে যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় সাধারণ মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু অগণিত সংখ্যায় নিয়মিত হচ্ছে। সেদিকে দৃষ্টিপাত করে এর প্রতিকারের চেষ্টা তারা করত। কয়েকদিন আগে ঢাকায় বুয়েটের এক ছাত্রকে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করে এক বাস ড্রাইভার মেরে ফেলে। দেখা যায় এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বাস ড্রাইভার ও তার হেলপাররা সঙ্গে সঙ্গে লোকজনের মধ্যে থেকে উধাও হয়। নাম-ঠিকানা জানা সত্ত্বেও তাদের অল্প সংখ্যককেই ধরা যায়। এরা যে সরকারি দলের লোক এমন নয়। এরা অপরাধ করে নিরাপদে থাকার কারণ সরকারের মধ্যে এমন কোনো তাগিদ নেই, যাতে উপযুক্ত গুরুত্বের সঙ্গে এই অপরাধীদের ধরার ব্যবস্থা হতে পারে। এই তাগিদ না থাকার কারণে এভাবে যা কিছু ঘটে তার দায়-দায়িত্ব কোনোভাবে সরকারের আছে এটি তারা মনে করে না। ঠিক এ কারণেই দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে প্রতিদিনের ঘটনা হলেও এ ব্যাপারে পরিবহনমন্ত্রী বা তাদের মন্ত্রণালয়ের বিশেষ কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া যায় না। পুলিশের পক্ষ থেকে এ নিয়ে কিছু রুটিন কথা বলা হলেও সরকার এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকাই পালন করে থাকে। সরকারের এই ভূমিকা পুলিশকেও অনেকখানি নিষ্ক্রিয় করে রাখে। যেভাবে এসব বিষয়ে তাদের তৎপর হওয়ার কথা সেভাবে তারা তৎপর হয় না।
বাংলাদেশে এখন সড়ক দুর্ঘটনা হলো নিয়মিত খবর। আবার অনেক সময় সব দুর্ঘটনার রিপোর্ট, বিশেষ করে ঢাকার বাইরের দুর্ঘটনার রিপোর্ট সংবাদপত্রে ওঠে না। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের এই সংখ্যা থেকে দেখা যায়, ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধে বছরে যত লোকের মৃত্যু হয় তার থেকেও বেশি লোকের মৃত্যু হয় বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায়।
এটা আসলে স্তম্ভিত হওয়ার মতো ব্যাপার হলেও এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কোনো ভ্রূক্ষেপই নেই। কেন এসব দুর্ঘটনা এত বড় আকারে নিয়মিত হচ্ছে। এ নিয়ে তাদের কোনো অনুসন্ধান নেই, অনুসন্ধানলব্ধ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এর প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। এর একটি বড় কারণ শাসকশ্রেণী ও সরকারের লোকরাই বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাস-ট্রাকের মালিক। তারা সড়ক যাতায়াতের অযোগ্য গাড়ি রাস্তায় রাখে। অল্প পয়সায় এমন সব ড্রাইভারকে গাড়ি চালানোর জন্য নিযুক্ত রাখে যাদের কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। যেসব লাইসেন্স তাদের থাকে সেগুলো তারা ঘুষ দিয়ে কর্তৃপক্ষের থেকে সংগ্রহ করে। এই লাইসেন্স দানকারী সরকারি সংস্থা এখন দুর্নীতির এক বিপজ্জনক আখড়ায় পরিণত হয়েছে। তাদের ঘুষ দিলেই যে কোনো লোককে তারা ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়। সরকার সামান্য চেষ্টাতেই এই ঘুষখোরদের শনাক্ত করে শাস্তি দিতে পারে। যথাযথভাবে ড্রাইভিং লাইসেন্স যাতে দেওয়া হয় তার ব্যবস্থা করতে পারে; কিন্তু এরা কিছুই করে না। দেশের হাজার হাজার লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যুর কবলে পড়লেও এদের কিছু যায়-আসে না। এরা নিজেরা অপরাধী এবং সেই হিসেবে এরা অপরাধীদের রক্ষক। শুধু রক্ষকই নয়, পৃষ্ঠপোষকও। তাছাড়া আগেই বলা হয়েছে, এরা নিজেরাও এসব বাস-ট্রাকের মালিক। এদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও দলীয় লোকরা এর মালিক। এদের কাছে সাধারণ লোকদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। এই ধান্ধাবাজদের একমাত্র বা সব থেকে বড় ধান্ধা হচ্ছে জনগণের পকেট মেরে, চুরি-দুর্নীতি করে নিজেদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করা। এদের কাছে এটাই হলো ক্ষমতায় থাকার অর্থ। সড়ক দুর্ঘটনা কেন হয় তার কারণ চিহ্নিত করা সহজ ব্যাপার। চালকদের গাড়ি চালানোর কোনো যোগ্যতা না থাকা, ঘুষ দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স হস্তগত করা, চলাচলের অযোগ্য গাড়ি রাস্তায় চালানো, গাড়িগুলোর কোনো ফিটনেস পরীক্ষা না হওয়া, দুর্ঘটনার জন্য অপরাধীদের গ্রেফতার করার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ইত্যাদি কারণ একত্রিত হয়েই বাংলাদেশে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা এখন জনগণের জন্য এক অতি বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি করে রেখেছে। এক্ষেত্রে যে অপরাধীকীকরণ হয়েছে তার মূল দায়িত্ব হচ্ছে বিদ্যমান সরকার। তাদের মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আমলাদের। তারাই হলো প্রকৃতপক্ষে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। তারাই হলো বাস-ট্রাক মালিকদের রক্ষক ও পৃষ্ঠপোষক। এদের অপরাধমূলক কাজ-কারবার এবং সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো প্রকৃত উদ্যোগ গ্রহণ না করাই হলো এর জন্য দায়ী। এদিক দিয়ে বলা চলে, সরকারই হলো সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হাজার হাজার শিশু, নারী-পুরুষের হত্যাকারী।
বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে এখন মনে হয়, উন্নতির সব রকম দেশি-বিদেশি সূচক, বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক বিদেশি মতলববাজের নানা ধরনের গালভরা কথাবার্তা এবং নিজের অর্জন সম্পর্কে বিদ্যমান সরকারের অনেক ঢেঁড়ি পেটানো সত্ত্বেও বাংলাদেশের বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থা ভেতর থেকেই ভেঙে পড়ছে। ক্রমেই ও দ্রুত এই ভাঙন দেশে ইতিমধ্যেই এক নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে এবং ভবিষ্যতে এই নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণ করা কারও পক্ষে সম্ভব হবে না। যদি না এর বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন দ্রুত সংগঠিত না হয়। কারণ যে পরিস্থিতি এখন সর্বক্ষেত্রে বিরাজ করছে এর সমাধান একমাত্র মৌলিক সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই সম্ভব। যে পরিবর্তন আবার অর্জিত হতে পারে একমাত্র জনগণের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে।


0 comments:

Post a Comment