Tuesday, June 14, 2016

পুঁথিগত শিক্ষা ও রাজনীতি

পুঁথিগত শিক্ষা ও রাজনীতি 
আলী ফোরকান
শিক্ষা শব্দটিকে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা যায়। সে বিশ্লেষণে যেতে চাই না। সহজ অর্থে শিক্ষা শব্দটির দুটো ধারা বিদ্যমান। একটি আক্ষরিক শিক্ষা, অপরটি অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষা। অক্ষরজ্ঞান না থাকলে সে নিরক্ষর। তবে তাকে অশিক্ষিত বলা চলে না। আক্ষরিক বা পুঁথিগত শিক্ষা ছাড়াও আপন পরিমন্ডলে বহু লোক বহু ধারায় শিক্ষাগ্রহণ নিয়ে থাকে। বহু নিরক্ষর লোক শিল্পকলায় ও স্থাপত্য শিল্পে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। মোগল বাদশাহরা শিল্পানুরাগী ছিলেন। তাদের শিল্পে ভারতীয় ও পারসিক স্থাপত্য-চিত্রকলার সংমিশ্রণ ঘটে। মোগল সম্রাট শাহজাহানের আমলে স্থাপত্য শিল্পের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। শাহজাহানের প্রিয়তমা মহিষীর স্মরণে আগ্রায় ‘তাজমহল’ নির্মাণ করা হয়। এটা একটি বিশ্বনন্দিত স্থাপত্যশিল্প। সৌন্দর্য বর্ণনায় কবি বলেন, 
‘হীরা মুক্তা মানিক্যের ঘটা 
যেন শূন্য দিগন্তের 
ইন্দ্রজাল ইন্দ্র ধনুচ্ছটা’। 
এই স্থাপত্যের স্থপতি ওস্তাদ ঈসার পুঁথিগত শিক্ষার চেয়ে মেধা, সাধনা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল মূল সম্বল। ইতিহাস থেকে জানা যায় নিরক্ষর হয়েও সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি যোগ্যতার সাথে দেশ চালিয়েছেন। ড. ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, ‘তিনি ছিলেন মধ্যযুগীয় ইতিহাসে একজন সুদক্ষ শাসক এবং সার্থক সামরিক সংগঠক, যার তুলনা বিরল।’ মোগল বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট আকবর ছিলেন নিরক্ষর। অথচ তিনি রাজ্যবিস্তার, রাজ্যশাসন ব্যবস্থা, সীমান্ত নীতি, কেন্দ্রীয় শাসন, বিচার, প্রাদেশিক শাসন, কৃষি ও রাজস্ব ক্ষেত্রে আশাতীত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ছত্রপতি শিবাজী ও শিখনেতা রণজিত নিরক্ষর হয়েও বিশাল ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন। 
আবার সার্টিফিকেটধারী বা ডিগ্রিপ্রাপ্ত না হয়েও অসংখ্য কবি, লেখকের সাহিত্যিক অবদান আমাদের জানা আছে। এদের মধ্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের নাম জানা নেই এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুস্কর। 
প্রসঙ্গত সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ‘সাক্ষরতার পরীক্ষা’র ঘটনা সম্পর্কে উল্লেখ করছি। ব্রাজিলের সংসদ নির্বাচনে কৌতুক অভিনেতা ফ্রাসিস অলিভিয়োরা (টিরিরিকা) নির্বাচিত হওয়ায় অভিযোগ ওঠে তিনি নিরক্ষর। যেহেতু সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়নের জন্য অক্ষরজ্ঞান দরকার এ জন্য আদালতের নির্দেশে তাকে সাক্ষরতার পরীক্ষা দিতে হয়েছিল এবং পরীক্ষায় তিনি উতরে যান। কিছু ডিগ্রিধারী নেতানেত্রী বলেন, কম শিক্ষিত প্রশাসক দেশে শিক্ষা বিস্তার ঘটাতে ব্যর্থ হবেন। ইতিহাসের অসংখ্য উদাহরণ থেকে শুধু একটা উদাহরণ তুলে ধরছি। সম্রাট আলাউদ্দিন নিরক্ষর হয়েও কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ‘তারিখ-ই-আলাই’ গ্রন্থের লেখক আমীর খসরু এবং কবি হাসান নিযামী তার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। কবি হাসান খ্যাতনামা বুজুর্গ ব্যক্তিত্ব নিজামউদ্দিন আউলিয়ার জীবনী প্রণয়নে আলাউদ্দিন খিলজির পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিপক্ষ থাকবে। গঠনমূলক সমালোচনাও থাকবে। কোনো নেতা পরীক্ষায় কেমন ফলাফল করেছিলেন এসব ব্যক্তিগত পর্যায়ে সমালোচনা সহ-অবস্থানের রাজনীতি নয়, সংঘর্ষের রাজনীতি। আমি আলোচনায় একটা বিষয় তুলে ধরেছি যে পুঁথিগত শিক্ষা এককভাবে বিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যোগ্যতা অর্জনের প্রধান অবলম্বন নয়। 
প্রায় সাত দশক আগের কথা। আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি গ্রামে মোড়ল, মাতব্বর, পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সালিস দরবার চলত। তাদের অনেকেরই অক্ষরজ্ঞান ছিল না। অথচ তারা যুক্তি নিয়ে কথা বলতেন এবং সমস্যার সমাধান দিতেন। বিচারিক কাজে অনেক সময় অনেক মাতব্বর, প্রভাবশালী ব্যক্তিকে জুরর নিয়োগ করা হতো। আমার পরম শ্রদ্বেয় নানা দীর্ঘকাল জুরর সভ্য ছিলেন। 
পৃথিবীর অনেক দেশে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে বিংশ শতাব্দীর মধ্যকাল (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর) থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতালাভের রেওয়াজ চলে আসছে। এটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আড়ালে একটা অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অবস্থান। ফলে রাজনীতিতে যোগ্য গুণসম্পন্ন ব্যক্তিদের উপস্থিতি কমছে। খয়ের খাঁ ও পেটোয়া বাহিনীর দাপট বেড়ে চলেছে। দেশ গড়ার জন্য যে সহনশীলতা ও উদারতার প্রয়োজন সর্বক্ষেত্রে তার অভাব বিদ্যমান। ফলে অনুন্নত এই দেশগুলোতে বিশৃ´খলা, অনৈতিকতা, হত্যা ও দলবাজি বেড়ে চলেছে। গণতন্ত্রের ছত্রছায়ায় ভিন্ন রাজনৈতিক দল বা বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতি আচরণ ‘ভিনডেকটিভ’। জাতীয় সংসদে দেশের উন্নয়নের জন্য আলোচনা না করে বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে হরহামেশাই নোংরা আক্রমণ চলে। অথচ উচিত ছিল সমঝোতা ও রসাত্মক আলোচনার মাধ্যমে সরকার বিরোধী দলকে জাতীয় স্বার্থসম্পৃক্ত বিষয়গুলোতে জড়িত করা। অনেক দিন আগে একটা গল্প শুনেছিলাম। কোথায় শুনেছিলাম সেটাও মনে নেই। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সরকারি দলের পুরুষ সদস্য দাঁড়িয়ে পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, (আমি মনে করি, আমি মনে করি, আমি মনে করি...” তৃতীয়বার  শব্দটি বলার পর তাৎক্ষণিকভাবে জনৈক মহিলা সদস্য দাঁড়িয়ে পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি রসিকতা করে বললেন, সংসদে এ ধরনের সরস আলোচনা উভয় পক্ষের দূরত্ব কমিয়ে দেয়। মজার হাস্যোদ্দীপক আলোচনায় সংসদকে প্রাণবন্ত করে তোলে। 
এখন নিজ দেশের কথা বলি। এখানে আলোচনার বিষয় হয় কোন কবরে কার লাশ ছিল। কার কিভাবে জানাজা হলো, কে কত বিদ্বান, এসব অপ্রাসঙ্গিক বক্তৃতা অনুর্বর আলাপচারিতায় বিরোধ, হিংসা ও প্রতিহিংসার আগুন জস্বালানো হয়। আমাদের দেশের আয়তন ছোট হওয়ার কারণে আমরা পরস্পরকে জানবার বেশি সুযোগ পাই। বিভিন্নভাবে আমরা সম্পর্কের বন্ধনে জড়িত। এমন একটি দেশে বিদ্বেষের আগুন ছড়িয়ে কি একচেটিয়া জনপ্রিয়তা অর্জন সম্ভব? বিদ্বেষ ছড়ানোর অনুক্রমিক ধারায় নেমে আসে প্রতিহিংসার রাজনীতি। এ দেশে উদার ও যৌক্তিক চিন্তাধারার রাজনীতির প্রতিষ্ঠা ছাড়া শান্তি ও প্রগতি আসতে পারে না। এখানে অপরের ত্রুটি ও দোষ জনসমক্ষে তুলে ধরা হয় নিজের দোষত্রুটির কোনো খবর থাকে না। আমরা আশাকরি আমাদের নতুন প্রজম্ম পেছনের আবর্জনা মাড়িয়ে আমাদের নতুন কিছু উপার দেবে। আমরা সে প্রত্যাশায়।

0 comments:

Post a Comment