Saturday, June 11, 2016

রাসায়নিক মিশ্রিত ফলমূলে স্লো পয়জন

রাসায়নিক মিশ্রিত ফলমূলে স্লো পয়জন
আলী ফোরকান
আজও স্কুলে যায়নি অপু। স্কুলে না যাওয়ার কারণ পেট ব্যথা। আজকাল প্রায় অপুর পেট ব্যথা। সাথে বমি বমি লাগছে বলে অভিযোগ করে। প্রথম প্রথম অপুর মা জিন্নাতুল হামিদা গুরুত্ব দেননি। ভেবেছেন সেরে যাবে। কিন্তু দীর্ঘদিন এই শারীরিক অসুবিধাটি সেরে উঠছিলোনা। বিধায় অপুর বাবা ১৪ বছরের ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া পুত্রসন্তানের শারীরিক এ অসুস্থতার কারণে রীতিমতো অস্থির হয়ে পড়েন। ওইদিন তিনি তাকে শহরের বড়ো শিশু-কিশোর বিশেষজ্ঞের শরনাপন্ন হন। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানান, অপুর ভাইরাস জনিত কারণে পেটের পীড়ায় ভুগছে। সময়মতো এর চিকিৎসা না করালে হয়তো মারাত্মক কিছু হয়ে যেতেও পারতো।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের জেলা শহর ও উপজেলার বাজারগুলোতে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে ফরমালিন। ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথাইলিন, ইথরিল স্প্রে দিয়ে পাকানো ফলমূল। এখন আপেল, আঙ্গুর, কলা, আম, নাশপাতি, কমলালেবুসহ দেশের বাইরে থেকে আসা বেশির ভাগ ফলই ঘরে রাখলে সহজে নষ্ট বা পঁচন ধরে না। এর কারণ উদঘাটন করতে গিয়ে জানা যায় আঙ্গুর, আপেল নাশপাতি, কমলালেবুসহ দেশের বাইরে থেকে আসা বেশির ভাগ ফলে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন। আর দেশে উৎপাদিত অপরিপক্ক ফল পাকানোর জন্য কার্বাইড কিংবা দেয়া হয় আগুনের তাপ। এ কারণে ফলের আসল স্বাদ যেমন পাওয়া যায় না তেমন উপকারের বদলে দেখা দেয় মারাত্মক রোগব্যাধি।
এ ব্যাপারে দেশের একজন বিশিষ্ট ফল ব্যবসায়ী জানান-“বিদেশ থেকে অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র, চীন, আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ব্রাজিল, পাকিস্তান, ভারত ও মিশর থেকে আসে বেশির ভাগ ফল। দেশের বাইরে থেকে কন্টেইনারে নিয়ে আসা হয় যার মধ্যে আলো বাতাস প্রবেশ করতে পারে না। যে কারণে ওই সময়ে এতে ফরমালিন দেয়ার প্রয়োজন হয় না। তিনি আরো জানান, কন্টেইনার থেকে বের করে খোলা অবস্থায় রাখলে এসব ফল ২ থেকে ৩ দিনের বেশি থাকে না। যে কারণে অনেক সময় ফরমালিন মিশ্রিত পানির মধ্যে ডুবিয়ে কার্টুন করে তা বাজারজাত করতে হয়। এক গ্রাম ফরমালিন মিশ্রিত পানির মধ্যে ১০ থেকে ১২ কেজি আঙ্গুর বা নাশপাতি ভিজানো হয় আর আপেল ও কমলা লেবুতে দেয়া হয় ছিটিয়ে। যে কারণে ৩-৪ সপ্তাহ রাখলেও নষ্ট হয় না। তবে ফরমালিনের ক্রিয়া নষ্ট হয়ে গেলে ওই ফল তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়।”
আমদানিকারক বা পাইকারি ব্যবসায়ী ফল আমদানির দু-এক দিনের মধ্যে তা বিক্রি হয়ে যায়। যে কারণে ফরমালিন দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে খুচরা বিক্রেতাদের বিক্রি করতে দেরি হলে তারা ফরমালিন দিতে পারেন। এখন আর গাছে পাকা ফল তেমন পাওয়া যায় না বাজারে। কারণ সবকিছুই বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করণের লক্ষ্যে যত আগে বাজারে আনা যায়, ততই মুনাফা। তাছাড়া চাষকৃত ফল বেশিদিন ক্ষেতে রাখা মানে পরবর্তী ফসলের চাষ ব্যাহত হওয়া। তাই ফল কোনরকমে একটু পরিপক্ক হলেই তাতে গাছ থেকেই নানা রাসায়নিক প্রয়োগ শুরু করা হয়। আর গাছ থেকে নামিয়ে স্থানীয় বাজারে যখন আসে, সেখানে তরতাজা দেখানোর জন্য আরেক দফা প্রয়োগ করা হয় রাসায়নিক ও রং। সবশেষে তা যখন খুচরা ক্রেতাদের হাতে আসে এবং বাজারজাত হয়, তখনই প্রয়োগ করা হয় রং ও রাসায়নিক। যাতে ফলের রং তকতকে ও সুন্দর দেখা যায়।
এ ব্যাপারে বিএসটিআই এর পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলেন-“দেশের বিভিন্ন বাজারে আনা ফলগুলির অধিকাংশই কৃত্রিমভাবে অপরিপক্ক পাকানো ফল। বাণিজ্যিকভাবে কলাসহ সব ধরনের ফল পাকানোর জন্য বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ও রং ব্যবহার করা হচ্ছে। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় আনারস ১২-১৫ দিনের বেশি সংরক্ষণ করা যায় না।  কিন্তু ৫০০ পিপিএম এনএনএ বা ১০০ পিপিএম জিএ-৩ দ্বারা শোধন করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ৪১ দিন পর্যন্ত আনারসকে সংরক্ষণ করে রাখা যায়। এভাবে রাসায়নিক উপাদান প্রয়োগ করে সব ফলই স্বাভাবিক সময়ের আগেই পাকানো হচ্ছে।”
মূলত ঃ ইথাইলিন জাতীয় গ্যাস ও ইথরিল (এক ধরনের হরমোন) স্প্রে করে এবং ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করে ফলমূল পাকানো হয়। উল্লেখ্য, কিছু ফল যেমন আম, কলা, আপেল, পেঁপে, বাংগি, তরমুজ, কুল, টমেটো ইত্যাদি যখন পাকতে শুরু করে তখন নিজস্ব শারীরবৃত্তির মাধ্যমে স্বয়ং থেকেই এসব ফল ইথাইলিন গ্যাস নিঃসৃত করে। এগ্রিকালচারাল সায়েন্সে এসব ফলকে ক্লাইমেকটেরিক ফল বলা হয়। কিন্তু এসব ফল খুব তাড়াতাড়ি পাকানোর উদ্দেশ্যে অপরিপক্ক অবস্থায় গাছ থেকে সংগ্রহ করে ব্যবসায়ীরা ইথরিল কিনে স্প্রে করে। এতে ফলের গায়ে উজ্জ্বল হলুদ বর্ণ হয়। একই উদ্দেশ্যে ফলে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করা হয়। এই রাসায়নিক পদার্থটি ড্রামে দ্রবীভূত করা হয় এবং ওই পানিতে আম, কলার কাদি, পেঁপে, আনারস, কুল ডুবিয়ে তোলা হয়। ইথাইলিন বা ক্যালসিয়াম কার্বাইড প্রয়োগে ফল হলুদ রং ধারণ করাতে মনে হয় ফলগুলো পরিপূর্ণ পাকা, যা সহজেই ক্রেতার চোখকে ফাঁকি দেয়।
রাসায়নিক উপাদান যেমন ফরমালিন, ইথাইলিন জাতীয় গ্যাস ও ইথরিল স্প্রে করে এবং ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করে পাকানো ফল খেয়ে অনেক মানুষের অসুস্থ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে তাদের মধ্যে শিশু কিশোরদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। একটি স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ক বেসরকারি সংস্থার জরিপে দেখা গেছে গত দুই বছরে এই ধরণের রাসায়নিক মিশ্রিত ফলমূল খেয়ে শিশু কিশোরদের আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার। এরমধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা ২ হাজারের চেয়ে বেশি।
দিনদিন এসব রাসায়নিক উপাদান যুক্ত ফল খেয়ে মানুষের অসুস্থ হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া বাজার থেকে ক্রেতারা ফল কিনে বাসায় নিয়ে দেখছে ফলের ভিতর পোকা কিংবা ফলটি সম্পূর্ণই পঁচা। এখন এ ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। দেশের বিভিন্ন বাজারগুলোতে বিশেষ করে উপজেলা, উপশহর ও থানা বাজারে তরমুজ, বেল, আম, ইত্যাদি ফলে পোকা অথবা পঁচা থাকার বিষয়টি
অহরহ দেখা যাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্যরা, বলেন-“ফরমালিন যুক্ত ফল আর্সেনিকের চেয়েও ক্ষতিকারক। এতে লিভারের সমস্যাসহ ক্যান্সার হওয়ার অধিক ঝুঁকি থাকে। এছাড়া আগুনের তাপ বা কার্বাইড দিয়ে পাকানোর ফলে পুষ্টি উপাদান নষ্ট হয়ে তার স্বাদ এবং ফুড ভ্যালু কিছুই থাকে না।”
বিজ্ঞানীদের মতে, ফরমালিন এক ধরনের এসিড যা মানব দেহে বড় ধরণের স্বাস্থ্যহানি ঘটায়। বাজার ব্যবস্থাপনায় নির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় ব্যবসায়ীরা এভাবে খাদ্যে ভেজাল দেয়। অধিক মুনাফা লাভের আশায় তারা এটা করে থাকে। এজন্য বাজার ব্যবস্থাপনাকে নির্দিষ্ট নীতিমালা করে নিয়মিত, দেখভালের মধ্যে রাখলে মানুষ, বিশেষ করে শিশু কিশোররা দৈহিক ক্ষতির হাত থেকে বাঁচবে বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন। তাছাড়া এই ব্যাপারে অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে তাদের সন্তানদের খাবার-দাবারের প্রতি। তবেই সম্ভব আমাদের শিশুদের রাসায়নিক মিশ্রিত ফলের কারণে অসুস্থতা থেকে রক্ষা করা।

0 comments:

Post a Comment