Saturday, June 11, 2016

মসলিন থেকে জামদানি

মসলিন থেকে জামদানি
আলী ফোরকান
পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (ইপসিক)। ইপসিক কর্তৃক ১৯৬১ সালে পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী ওই সময়ে এ দেশে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২১ হাজার ও তিন লাখ ৭২ হাজার। গত ৪৯ বছরের ব্যবধানে অর্থাৎ ২০০৯-এ এসে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৭৫ হাজার ও ছয় লাখ ২৬ হাজার। অন্যদিকে ১৯৬০ সালে এ খাতে বছরে যেখানে ২৩৫ কোটি টাকার পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হতো। সেখানে ২০১০-এ এসে উৎপাদনের সে পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা। শিল্পের সংখ্যা এবং উৎপাদন উভয় ক্ষেত্রেই অর্ধ শতাব্দীর ব্যবধানে এই যে বিরাট অগ্রগতি। এর মূল কৃতিত্ব অবশ্যই এ খাতের উদ্যোক্তাদের। তবে পাশাপাশি এটাও মানতে হবে। কৃষিনির্ভর গ্রামীণ সমাজপ্রধান বাংলাদেশে শিল্প স্থাপনের জন্য এ বিপুলসংখ্যক সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তাকে খুঁজে বের করে তাঁদের শিল্প স্থাপনে আগ্রহী করে তোলার কষ্টসাধ্য কাজটি ইপসিক তথা এর উত্তরসূরি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনকেই (বিসিক) করতে হয়েছে। সেদিক থেকে বিচার করতে গেলে শিল্প খাতে বাংলাদেশের গত ৫৩ বছরের ক্রম-অগ্রগতির (অগ্রগতির সে ধারা যত ধীরলয়েরই হোক না কেন) পেছনে বিসিকের ভূমিকাই মুখ্য।
বাংলাদেশের শিল্প খাতে এ মুখ্য ভূমিকা পালনকারী সংস্থা বিসিকের প্রতিষ্ঠা ১৯৫৭ সালের ৩০ মে, যার ৫০ বছর পূর্ণ হলো। আর এটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের শ্রম-বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী এবং পরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়ন প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে এটি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং এ খাতের সাফল্য-ব্যর্থতার অনুপু´খ মূল্যায়নের জন্য এটি একটি চমৎকার উপলক্ষও। সে মূল্যায়ন শুধু বিসিকের অর্ধ শতাব্দীর কাজের নির্ঘণ্ট তৈরির জন্যই নয়। এ খাতের আগামী দিনের দিকনির্দেশনা খুঁজে পাওয়া এবং করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যেও জরুরি।
১৯৫৭ সালে বিসিকের প্রতিষ্ঠালগ্নে প্রায় সব দিক থেকেই বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছিল কৃষিনির্ভর। কৃষির বাইরে শিল্পকে পেশা হিসেবে গ্রহণের মানসিকতা তখন ছিল না বললেই চলে। পড়াশোনা শেষে চাকরি না করে অন্য কিছু করার কথা প্রায় কেউই ভাবত না। আর সে রকম একটি পরিস্থিতিতে শিল্প স্থাপনের জন্য সম্ভাবনাময় আগ্রহী ব্যক্তি খুঁজে বের করে তাকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার কাজটি মোটেও সহজ ছিল না।
বিসিক তার প্রতিষ্ঠার পরপরই অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি দেশব্যাপী শিল্প স্থাপনোপযোগী অবকাঠামো নির্মাণের কাজে হাত দেয় এবং ওই সময়কার প্রতিটি জেলায় একটি করে শিল্পনগরী স্থাপন করে। ওই শিল্পনগরীগুলো স্থাপনের ফলেই সে সময় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড হিসেবে শিল্প স্থাপনের বিষয়টি মোটামুটি ধরনের সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাওয়ানী ইস্পাহানি তথা ২২ পরিবারের বিনিয়োগের বাইরেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাঙালি উদ্যোক্তা শিল্প স্থাপনে এগিয়ে আসেন এবং নিজেদের যোগ্যতা ও সামর্থ্যের প্রমাণ রাখতে সক্ষম হন। উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশের ৫৮টি জেলায় বিসিকের মোট ৭৪টি শিল্পনগরী রয়েছে এবং এ শিল্পনগরীগুলোতে বছরে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে।
হস্ত ও কুটির শিল্পের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তা, কারুশিল্পী ও কারিগরদের প্রশিক্ষণ ও নকশা দিয়ে সহায়তা করার জন্য ১৯৬০ সালে স্থাপিত হয় বিসিকের নকশাকেন্দ্র। ১৯৬১ সালে বিসিক হাতে নেয় তার লবণ শিল্পের উন্নয়ন প্রকল্প। যার আওতায় কক্সবাজার, চট্টগ্রাম,সাতক্ষীরা,খুলনা,বাগেরহাটের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার সৌরতাপে লবণ উৎপাদনের কাজ শুরু হয়। এ প্রকল্পেরই অবদানে দেশ আজ লবণ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বিসিক তার আগের কর্মকান্ডের পাশাপাশি বেশ কিছু সুতা, রং ইত্যাদি শিল্প কাঁচামাল আমদানি করে তা উদ্যোক্তাদের মধ্যে ন্যায্য মূল্যে বিতরণ করত। এ সময় তাঁত ও রেশম শিল্পকে সহায়তাদান ছিল বিসিকের অন্যতম কাজ। পরে এ উপ-খাত দুটিকে বিসিক থেকে আলাদা করে নিয়ে দুটি স্বতন্ত্র বোর্ড গঠন করা হলেও এগুলোর সূচনাপর্বের অনেক কাজই বিসিকের হাতে গড়া, যার মধ্যে রাজশাহীর রেশম কারখানা অন্যতম।
ইতিহাসখ্যাত মসলিন আজ আর টিকে নেই;কিন্তু তার অপভ্রংশ হিসেবে বেঁচে আছে জামদানি। আর শুধু জামদানি শিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার জন্য বিসিক রাজধানীর অদূরে গড়ে তুলেছে জামদানি শিল্পনগরী ও গবেষণাকেন্দ্র। ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনের জন্য বিসিকের আওতায় ঢাকার মিরপুরে নির্মিত হয়েছে বহুতলবিশিষ্ট ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স। বিসিকের হোসিয়ারি শিল্পনগরী প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার নিটওয়্যারসামগ্রী বিদেশে রপ্তানি হয়েছে।
পঞ্চাশের দশকে বিসিক যখন কাজ শুরু করে। তখন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তি ছিল ১৩ দশমিক ৫৭ লাখ। যার সিংহভাগই ছিল কুটির শিল্পে। পরবর্তী সময়ে বাস্তব কারণেই প্রচলিত ধাঁচের অনেক কুটির শিল্প বিলুপ্ত হয়ে গেলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বহু কারিগর ও কারুশিল্পী পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। কিন্তু তার স্থলে আবার নতুন নতুন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গড়ে ওঠায় দেশে আজ এ খাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৬ লাখ। যা পুরো শিল্প খাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তির প্রায় ৮২ ভাগ। বিপুল বেকারত্বের এ দেশে বর্ধিত কর্মসংস্থান সৃষ্টির এ সুযোগ তৈরির পেছনে বিসিকের যে অবদান, নিঃসন্দেহে তা অসামান্য।
পৃথিবীজুড়ে বিশ্বমন্দার রেশ এখনো অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শিল্প খাতে ন্যূনতম ৯ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশা করা হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরূপতা ও অভ্যন্তরীণ সীমাবদ্ধতা মোকাবিলা করেও সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশের শিল্প খাত স্থিতিশীল ও ধারাবাহিক অগ্রগতি অর্জনের যে শক্তি ও সক্ষমতা অর্জন করেছে। তার পেছনে বিসিকের গত ৫৩ বছরের নীরব ও প্রকাশ্য অবদান যথেষ্টই রয়েছে বৈকি!

0 comments:

Post a Comment