Tuesday, June 28, 2016

অপরিকল্পিত নগরায়ন:বিপর্যস্ত পরিবেশ


অপরিকল্পিত নগরায়ন:বিপর্যস্ত পরিবেশ
আলী ফোরকান 
নগর সভ্যতার শুরু থেকে মানুষ একটি আধুনক নগরের কথা চিন্তা-ভাবনা করেছে। প্রায় ছয় হাজার বছর আগে যখন মেসোপেটোমিয়ার টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদীর অববাহিকায় ব্যবীলন, উর ইত্যাদি প্রাচীন শহরগুলোর পত্তন হয় বা তার পরে নীল অববাহিকায় কাহুন অথবা সিন্ধু অববাহিকায় করপ্পা-মহেঞ্জেদারো ইত্যাদি শহর গড়ে ওঠে তার অনেকগুলোই গড়ে উঠেছিল এক একটি আদর্শ রূপকল্পকে ভিত্তি করে। প্রাচীন শহরগুলোর অধিকাংশের আকৃতি ছিল নির্দিষ্ট জ্যামিতিক আকৃতি, যেমন বৃত্ত, বর্গ, চতুর্ভুজ, ষঢ়ভুজ, অষ্টভূজ প্রভৃতিকে অনুসরণ করে। বলা হয়ে থাকে, জেরুজালেম তৈরি হয়েছিল আল্লাহ প্রদত্ত এক আকৃতিকে অবলম্বন করে। প্রাচীন চীন ও ভারতেও নগর পরিকল্পনায় জাগতিক ও অধিজাগতিক শর্তসমূহ প্রভাব বিস্তার করতো। প্রাচনি চীনে নগর তৈরি হতো ১২ মাসের জন্য ১২টি পবেশ পথ রেখে। প্রাচীন ভারতের নগর পরিকল্পনাকে অধিকাংশ নগরের আকৃতি করা হতো চর্তুভুজ এবং এর চারটি প্রবেশ পথ সবই কেন্দ্রমুখী হতো।
মানসরার মতে, নগরের অভ্যন্তরস্থ সড়কসমূহ এমনভাবে বিন্যস্ত করা হতো যেন নগরটি বিভিন্ন বর্ণ শ্রেণীর জন্য চিহ্নিত করা যায়। অষ্টম শতাব্দির আগদাদে মাদিনতাল মানসুর নগরটির পরিকল্পনা ছিল আদর্শ এক বৃত্তের আকৃতিতে, যার মাঝখানে ছিল আল মানসুরের মসজিদ এবং প্রাসাদ।
উনবিংশ শতাব্দিতে ইংল্যান্ডে এবনেজার হাওয়ার্ড পরিকল্পনা করেছেন ছোট ছোট বৃত্তাকার উদ্যান নগর। আরো আধুনিক কালেও আদর্শ নগর পরিকল্পিত ও নির্মিত হয়েছে। ব্রাজিলের রাজধানী হিসেবে ব্যাসিলিয়ার নক্সার মূল ভিত্তিতে রয়েছে খ্রিষ্টান ধর্মের প্রতীক, ক্রস। পরে নগরের আকৃতিটিকে উড়ন্ত পাখী অথবা উড়োজাহাজের সাথে তুলনা করা হয়েছে। ভবিষ্যত নগরের কথা চিন্তা করে আরো কিছু নতুন শহর পৃতিবীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে। পাকিস্তানে গ্রীক স্থপতি ডকসিয়াডিজ ডিজাইন করেছেন ইসলামাবাদ, ভারতের পাঞ্জাবে ফরাসী স্থপতি কর্বুসিয়ে করেছেন ইন্ডগড়, ঢাকাতেও শহরের অংশ হিসেবে শেরে বাংলা নগরের নক্সা করেছেন মার্কিন স্থপতি লুই কান। আমরা একবিংশ শতাব্দির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে একটি পরিকল্পিত আধুনিক নগরীর কথা ভাবনা না তা কি হয়! তবে ভবিষ্যত আধুনিক নগর সম্পর্কে ভাবতে হলে নগরের জনসংখ্যাগত আয়তন এবং এর প্রাকৃতিক আকৃত এবং এর কর্মকান্ড নিয়েও ভাবতে হবে।
আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ প্লেটো তার নগর রাষ্ট্রের জনসংখ্যা নিরুপণ করেছিলেন ৫০৪০। অর্থাৎ তিনি আধুনিক নগর রাষ্ট্রের জনসংখ্যা সীমিত রাখার কতা বলেছেন। তা না হলে আধুনিক নগর প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।
বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রায় ৬০০ কোটির বেশি। জনসংখ্যা বৃদ্ধিও হার এখনো বেশ উঁচু। এভাবে বাড়তে থাকরে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা ১০০০ কোটিতে দাঁড়াবে। নগর জনসংখ্যা বৃদ্ধর হার সারা বিশ্বে ২.৬ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই সার ৩.৮ শতাংশ। তবে ঢাকা শহরে এই হার প্রায় ৫ শতাংশ। উল্লেখ করা প্রয়োজন পৃথিবীর প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষ নগরবাসী। ২০১৭ সালে এই হার ৬০ শতাংশে উন্নীত হবে বলে নগরবিদরা আশা করছেন। তারা বরেছেন, ২০০১৭ সাল থেকেই আমাদের পৃথিবী একটি নগর প্রধান বা নগরায়িত গ্রহে পরিণত হব্ েনগারায়নের এই প্রক্রিয়া ঘটেছে দীর্ঘ ৬০০০ বছরের। তবে বিগত ৫০ বছরে বৃদ্ধির হার ছিল প্রবল এবং আরো কিছু কাল নগরায়রে হার বেশ দ্রুতই বাড়তে থাকবে।
এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে নগরীকে সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে হবে। ঢাকা শহরটি গড়ে উঠেছে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে। পুরোনো ঢাকার ঘিঞ্জিময় এলাকায় গেলেই বোঝা যায় নগর ব্যবস্থাপনা কতটা অপরিকল্পিত। পুরোনো ডাকায় কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। রাস্তাগুলোও বেশ সরু। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যাওয়ার পথটুকু দুজন মানুষের চলার মতো নয়। গাদা গাদি ঠাসা ঠাসি করে বসবাস করছে পুরোনো ঢাকার বাসিন্দারা। সমগ্র পুরোনো ঢাকায যত মানুষ থাকছে তা একটি নগরীতে বসবাসকারী জনসংখ্যার সমান। জনসংখ্যার এতবেশি ঘনত্ব পৃথিবীর আর কোতাও আছে কিনা সন্দেহ। পুরোনো ঢাকায় দুএকটি ছোট খাটো পার্ক ছিল; তাও আবার অবৈধ দখলে। ফলে পুরোনো ঢাকায় বসবাসকারী মানুষগুলো নিঃশ্বাসটুকুও ফেলতে পারে না। নিঃশ্বাস ছেড়ে যে একটু নির্মল বায়ু সেবন করবেন তার সুযোগ কোথায়?
একই ভাবে গড়ে উঠছে নতুন ঢাকায়। বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনো রকম পরিকল্পনা নেই। যত্রতত্র গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। বাড়ির মালিকরা অনুমোদনেরও তোয়াক্কা করছে না। পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষেধাজ্ঞা থোরাই কেয়ার করছে তারা। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, পরিবেশ অধিদপ্তরের বিদ্যমান আইনে ঢাকা মহানগরীতে ছয় তলার বেশি বানিজ্যিক ভবন, শপিং কমপ্লেক্স ও অ্যাপার্টমেন্ট ভবন নির্মাণের ওপর বিধিনিষেধ রয়েছে। বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে হয়। ১৯৯৯ সালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বহুতল ভবন, শপিং কমপ্লেক্স বাণিজ্যিক ভবন ইত্যাদির প্লান অনুমোদনের আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণকে পূর্বশর্ত হিসবে জুড়ে দিয়েছিল। পরিবেশ অধিদপ্তর এসব ছাড়পত্রের আবেদন নিষ্পত্তির লক্ষ্যে দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক গাইট লাইন অনুসারে যে সকল বিষয় বাধ্যতামূলকভাবে বিবেচনায় আনতে হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রস্তাবিত স্থানটি পরিবেশগত দিক দিয়ে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য উপযোগী কিনা, এলাকার পার্শ্ববর্তী রাস্তা সুপরিসর কিনা, সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহ কর্তৃক পানি সরবরাহ, পয়ঃ সুবিধাদি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ইত্যাদির নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে কিনা, ভবন পরিকল্পনায় চাহিদা মোতাবেক গাড়ি পার্কিংসহ চিত্যবিনোদন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধাদি রয়েছে কিনা এসব দেখা।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণের জন্য দরখাস্তের সাথে ওয়াসা কর্তৃক পানি সরবরাহ ও স্যুয়ারেজ সুবিধাদির ছাড়পত্র, তিতাস গ্যাস, ডেসা, পৌর কর্পোরেশনের ছাড়পত্র, ভবনের কারণে সৃষ্ট যানজট নিয়ন্ত্রনে পুলিশের ছাড়পত্র এবং ভবনে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সুবিধাদিও ছাড়পত্র জমা দিতে হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে বহুতল ভবন নির্মাতারা উপরোক্ত ছাড়পত্রগুলো আবেদন পত্রের সঙ্গে জমা দেন না। ফলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ্যে ছাড়পত্র দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
আর এ কারণে প্রায় এক কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ঢাকা মহানগরীটি অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণের কারণে জটিল আকার ধারণ করেছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর আবাসন সংকট সমাধান করতে গিয়ে পরিবেশ সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। তাছাড়া রাজউকের মাস্টার প্লানেও বহুতল ভবন নির্মানের ব্যাপারে কোনো অবকাঠামোগত ব্যবস্থা নেই।
মোবাইল:০১৭১১৫৭৯২৬৭


0 comments:

Post a Comment