পলিথিন ঃ পরিবেশের জন্য বড় হুমকি
আলী ফোরকান
আমাদের দেশের জন্য পলিথিন একটি বড় হুমকি। পলিথিনের কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহীসহ বিভাগীয় শহরগুলো যেন অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। প্রতিটি বিভাগীয় শহরের জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ পলিথিন। শহরের আনাচে কানাচে গ্রামে গঞ্জে যেখানেই তাকাই সেখানেই পলিথিন ব্যাগ দেখতে পাওয়া যায়। খোলা মাঠে, নর্দমা, পুকুর, খাল, বিল নদী সর্বত্র পলিথিন ব্যাগের ছড়াছড়ি।
পলিথিন ব্যাগ দামে সস্তা এবং পানিতে ভিজেও এটা নষ্ট হয় না; এ কারণেই মানুষ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করছে। অথচ এই পলিথিন মানুষের জীবনে যে কত বড় বিপদ ডেকে আনছে সেদিকে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। পলিথিন কেবলমাত্রা মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ক্ষতিই করে না। এটা মাটির উর্বরতা হ্রাস, শহরের নর্দমা ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা বন্ধ করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। ব্যাপকভাবে জীবানুর বিস্তার ঘটায়। দীর্ঘ দিন পলিথিন ব্যবহারের কারণে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। বাংলাদেশের মতো এত নিম্ন মানের পলিথিন বিশ্বের আর কোথাও ব্যবহার করা হয় না।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, পলিথিন তৈরি হয় পলিমার বা হাইড্রোকার্বন উপাদান দিয়ে। এই পলিমার অনুগুলো এতো শক্তভাবে গ্রন্থিত থাকে যে ক্ষদ্রাতিক্ষুদ্র ফাঙ্গাস বা ব্যাকটেরিয়াও এর ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে পলিথিন শত শত বছর ধরে একই ভাবে থাকতে পারে। পলিথিন যেহেতু নষ্ট হয় না এবং যেহেতু পলিথিন বিনাশ করার কোনো ব্যবস্থা নেই; সেহেতু তা পুড়িয়ে ফেলা হয়। আর এই পলিথিন পোড়ানোর ফলে বায়ু মারাত্মকভাবে দূষিত হয়। পলিথিন পোড়ানোর পর এক ধরনের বিষাক্ত গ্যাস হাইড্রোজেন সায়ানাইট উৎপন্ন হয়। যা গ্যাস শ্বাস নালীতে গেলে মারাত্মক ব্যাধি হতে পারে।
পশ্চিমা দেশগুলোতে পলিথিনের মারাত্মক হুমকি থেকে রক্ষা পেতে পচনশীল প্লাষ্টিক তৈরি করেছে। এ ধরনের প্লাষ্টিক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা বিভাজিত হয়ে মাটিতে এবং সূর্যের অতিরঞ্চিত রশ্মি দ্বারা নিঃশেষিত হতে পারে। প্রাপ্ততথ্যে জানা যায়, পচনশীল প্লাষ্টিক তৈরিতে কিছু অতিরিক্ত সেলুলোজ অথবা স্টার্চ মেশাতে হয়। ভুট্টা বা চালের স্টার্চ যা মাটিতে ব্যাকটেরিয়া খেয়ে ফেলতে পারে। একবার এই প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়লে অবশিষ্ট প্লাষ্টিকের অনুগঠন ভেঙে যায়। এ ধরনের প্লাষ্টিক পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে না।
পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের হুমকি সম্পর্কে এদেশের সাধারণ মানুষ অবগত নয়। তবে যারা জানে তারাও নির্দিধায় ব্যবহার করে চলেছে। গণমাধ্যমে এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচার প্রপাগান্ডা করেও কোনো ফল হচ্ছে না। তবে পত্রপত্রিকায় লেখালেখির কারণে পলিথিন উৎপাদন সীমিত রাখার জন্য সরকার উদ্যোগ নিলেও তা কার্যকর হয়নি। তাছাড়া পচনশীল প্লাস্টিক তৈরির উদ্যোগও কেবল উদ্যোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। উন্নত দেশগুলোতে সাধারণত পচনশীল প্লাষ্টিক উৎপাদন করে। ফলে পলিথিনের ব্যবহার উন্নত দেশে দেখা গেলেও তা পরিবেশের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না।
অনুসন্ধান করে জানা যায়, বাংলাদেশ প্রথম পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার শুরু হয় আশির দশকে। এর আগে মানুষ কাগজ, পাঠ ও কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করতো। দামে সস্তা এবং নষ্ট না হওয়ার কারণে পলিথিন ব্যাগ দ্রুত বাজার পেতে থাকে। এক পর্যায়ে পলিথিন পাটের ব্যাগের স্থান দখল করে নেয়। বর্তমানে ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরের এমন কোনো পরিবার নেই যারা পলিথিন ব্যবহার করে না। মানুষ আগের মত এখন আর চটের ব্যাগ নিয়ে বাজারে যায় না। একেবারে নিম্ন আয়ের লোক থেকে শুরু করে উচ্চ আয়ের লোকেরা পলিথিন ব্যবহার করছে। ব্যবহারের পর তা আবার যত্রতত্র ফেলে দিচ্ছে। এগুলো কোথাও না কোথাও জড়ো হয়ে মানুষের সমস্যার সৃষ্টি করছে।
আর্ন্তজাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের এক রিপোর্টে জানা যায়, পলিথিন বা প্লাষ্টিক যখন মাটির সংস্পর্শে আসে তখন উপকারি ব্যাকটেরিয়া, যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সহায়ক, সেগুলো মরে যায়। এর ফলে মাটি তার উর্বরতা হারায়। ধান, গম ও সরিষা উৎপাদনকারী মাটিতে পলিথিন বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনে। শুধু তাই নয়, মাঠে বিচরণকারী গবাদিপশুর জন্যও পলিথিন বিপদ ডেকে আনতে পারে।
ব্যাপক হারে পলিথিন ব্যবহারের কারণে দেশের অন্যতম পাট খাত নিদারুন সংকটে নিপতিত হয়। পাটের ব্যবহার ও চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় পাটখাতে কর্মরত লোকজন বেকার হয়ে পড়ে। দেশের পাটের ব্যবহার কমে যাওয়ায় কৃষকরা পাঠ চাষেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। যে পাট রপ্তানি করে বাংলাদেশ বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতো সে পাট খাতটি আজ বিভিন্নমুখী সংকটের মুখোমুখি। এই খাতে কর্মরত প্রায় ৫০ হাজার লোক বেকারত্বের দুর্বিসহ যন্ত্রণায় ভুগছে।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ১৯৮২ সালে ঢাকায় প্রথম পলিথিন ব্যাগ তৈরির কারখানা স্থাপিত হয়। প্রথম অবস্থায় দুতিনটি কারখানা ছিল। এরপর পলিথিনের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কারখানার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বর্তমান প্রায় তিনশয়ের অধিক পলিথিন ব্যাগ তৈরির কারখানার সন্ধান পাওয়া যায়। এই সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে।
পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে সরকার পলিথিনের কাঁচামালের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই পদক্ষেপও কার্যকর হয়নি। পরে ১৯৯৩ সালে সরকার রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের বাইরে পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এ লক্ষ্যে একটি আইনও পাস হয়। এই আইনটি ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এই আইনটিও শেষ পর্যন্ত বলবৎ হয়নি।
এক হিসেবে জানা যায়, বর্তমান শুধও ঢাকা শহরেই প্রতিদিন প্রায় ৬০ লাখ পলিথিন ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ অপসারন করা সম্ভব হয়। বাকিটা যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। সম্প্রতি বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় কালো পলিথিন নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বলা হয়েছে, কালো পলিথিন জনস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এই প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদন দিয়েছেন। তবে কথা হচ্ছে, পলিথিন ব্যাগ প্রস্তুতকারকরা কালো পলিথিনের পরিবর্তে অন্য রংয়ের পলিথিন তৈরি করবে। তাদেরতো কোনো সমস্যা নেই। আসলে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার এবং উৎপাদন পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা ছাড়া পলিথিনের হুমকি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। আমাদের বাচঁতে ও আগামী প্রজম্মদের বাঁচাতে পলিথিন উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করা ছাড়া বিকল্প নেই। আমরা আশাকরি সরকারসহ সংশ্লিষ্ট মহল এব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
0 comments:
Post a Comment