Sunday, June 19, 2016

সুুন্দরবন ও নীলগিরি পাহাড়

সুুন্দরবন ও নীলগিরি পাহাড় 
আলী ফোরকান
পৃথিবী বিখ্যাত একটি পাহাড় নীলিগিরি। স্থানীয়ভাবে ব্লু মাউন্টেন নামেও পরিচিত। পাহাড়ী এ জনপদ ভারতের তামিলনাড়ু প্রদেশে। অসাধারন প্রাকৃতিক সৌন্দার্য বেষ্টিত এ পাহাড়ের আদি জনগোষ্ঠী কুরুম্বা আদিবাসী। তাদেরকে নীলগিরি পাহাড়ের সন্তান বলা হয়। নীলগিরি পাহাড় তাদের মাতৃতুল্য। মা-য়ের সাথে সন্তানের যে সম্পর্ক, নীলগিরি পাহাড়ের সাথে কুরুম্বা আদিবাসীদের তেমনই সম্পর্ক। পাহাড়ের প্রতিটি উদ্ভিদ-প্রাণীর সাথে নীলগিরি সন্তানদের আতœার-রক্তের-জীবনযাত্রার সম্পর্ক। তাইতো একই মায়ের কোলে থাকা বন্যহাতি-হরিণ-বানর-সাপ-শুকুর-গাধা-বিভিন্ন পাখির সাথে কখনও আদিবাসী সন্তানদের সংঘাত হয় না। বরং জীবনযাত্রায় তারা পারস্পারিক বন্ধ ও আন্ত:নির্ভরশীল। কুরুম্বা আদিবাসীরা পাহাড় থেকে জীবন-জীবিকা বিভিন্ন উপকরন সংগ্রহ করে মাতুন্সেহে স্ব-গৌরবে বেঁচে আছে। পাহাড় থেকে মধু-মোম, বনজ ফল-মূল, পাতা, জ্বালানী, পানি, পশুখাদ্য, আবাসন উপকরন সংগ্রহ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনায় তাদের প্রথাগত জ্ঞাণের স্বীকৃতি দিয়েছে ভারত সরকার। ভারত সরকারের বনবিভাগ, পাহাড়ের প্রাণবৈচিত্র্য ব্যবস্থপনায় নীলগিরি পাহাড়ের সন্তানদের, পেশাগত স্বীকৃতিসহ সধ ধরনের আইনগত স্বীকৃতি দিয়েছে। বিভিন্ন মৌসুম ভিত্তিক কুরুম্বা আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের কার্ড নিয়ে পাহাড়ের সম্পদ সংগ্রহ করে। এবং বনবিভাগ ও বিভিন্ন গবেষণা সংগঠন সংগৃহীত সম্পদ বাজারজাতকরনের মাধ্যমে নায্যমূল্য প্রাপ্তির ব্যবস্থা করেন। নীলগিরির সন্তানদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস মধু ও মোম। বিশাল পাহাড়ের উঁচু-নিচু চূড়ায় ছোট/বড় অনেক মৌচাক তৈরী হয়। কুরুম্বা আদিবাসীরা এক ধরনের পাহাড়ী লতা দিয়ে মই তৈরী করে তা বেয়ে সমস্ত পাহাড় থেকে মধু ও মোম সংগ্রহ করে। মধু-মোম সংগ্রহের পূর্বে তারা পাহাড় পূজা করে ও নাচ-গান পরিবেশন করে। সরকারী/বেসরকারী সহযোগিতায় তারা মধুর সাথে বিভিন্ন পাহাড়ী ফলের স্বাদযুক্ত করে বাজারে বিক্রি করে। তাছাড়া, মোম থেকে মোমবাতি-সাবান-লিপজেল-বাম জাতীয় অর্গানিক পণ্য তৈরী করে লাষ্ট ফরেষ্ট ব্র্যান্ডে বিশ্বব্যাপি বাজারজাত করছে। ভারতের ডাবর কোম্পানীর মধুর এ্যাড দেন বিখ্যাত অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন। আর লাষ্ট ফরেষ্ট মধুর কোন বিখ্যাত সেলিব্রেটি এ্যাড না দিলেও বিশ্বব্যাপি মানুষের চাহিদা তালিকার শীর্ষে অবস্থান। প্রাণবৈচিত্র্যের সাথে আদিবাসী জনগোষ্ঠী ঐতিহ্যবাহী ঐতিহাসিক সহঅবস্থানের একটি জনপদ নীলগিরি পাহাড়। জীবনচক্রের প্রতিটি মুহুর্তে পাহাড়ের প্রতিটি প্রানী-উদ্ভিদ ও আদিবাসীদের আন্ত:সম্পর্ক দেখলে মনে হবে “জীববৈচিত্র্য জীবন, জীববৈচিত্র্য পাহাড়ী সন্তানদের বাঁচিয়ে রেখেছে”। এছাড়া, একই পাহাড়ী প্রতিবেশে মানুষও যে একটি প্রাণী হিসাবে চমৎকারভাবে অভিযোজন করে আছে, তার বাচ্চবচিত্র নীলগিরি পাহাড়। রাত-দিন মানুষের সাথে বানর-হতি-হরিন-শুকুর-গাধা ও বিভিন্ন পাখির খুব কাছাকাছি অবস্থান হলেও কেউ কারোর জীবনযাত্রার জন্য শত্রু নয়। ১৯৯২ সালে আর্ন্তজাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদে বিশ্বের যে ১৮১টি দেশ স্বাক্ষর করেছিল তার মধ্যে ভারত একটি। সিবিডির ১০ এর গ ধারার সফল বাস্ত বায়ন করতে সক্ষম ভারত সরকার। নীলগিরি পাহাড় ব্যবস্থপনা বিশ্ববাশির জন্য শিক্ষানীয় হতে পারে। সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ একক ম্যানগ্রোভ বন এবং বিশ্ব ঐতিহ্য। বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব অর্জনে অন্যান্য বনের তুলনায় সুন্দরবনের অবদান সবার শীর্ষে। বাংলাদেশ ভূ-খন্ডের ৬০১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনের উপর প্রায় ৬ লক্ষাধিক বনজীবি-বাওয়ালী, মৌয়ালী, জেলে, জোংরাখুটা (চুনারি), মুন্ড, মাহাতোর জীবন-জীবিকা সরাসরি নির্ভরশীল। বনজীবিরা যুগ যুগ ধরে পূর্ব পুরুষের লোকজ জ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রয়োগ করে মৌসুম ভিত্তিক সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদ (গোল-গরান, মধু, মাছ, কাঁকড়া, কেওড়া, চুন তৈরীর উপকরন) সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে। সুন্দরবনরে বনজ সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনায় হাজার বছর ধরে বনজীবীরা তাদের জীবনকে উৎসর্গ করতে একটুকুও ভয় করিনি। সুন্দরবন রক্ষায় তারা আজীবন বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে। বনের প্রতিটি সম্পদের সাথে তাদের আতœার সম্পর্ক, প্রাণের সম্পর্ক এবং জীবন জীবিকার সম্পর্ক। তাই সুন্দরবন ও বনজীবী এক এবং অবিচ্ছেদ্য। একই সাথে বিশ্ব ম্যানগ্রোভ বনের একটি অংশ ভারতে। মধু সংগ্রহ মৌসুমে বনবিভাগ ও ভারতের মানুষের কাছে উৎসবে পরিনত হয়। ভারতের জনপ্রিয় দৈনিন বাংলাবাজার প্রত্রিকায় ২৮ মার্চ ২০১৬ তারিখ মধু সংগ্রহ মৌসুম শিরোনাম হয়েছিল “বাদাবনে, মধুর টানে”। বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভ নির্ভর বনজীবী মৌয়ালীদের সাথে মধু-মৌমাছি-মধুবৃক্ষ ও বনের সামগ্রিক প্রতিবেশ পারস্পরিক আতœ:সম্পর্কের সহঅবস্থান। মৌমাছির সাথে সম্পর্ক ফুলের। ফুল যেখানে তারা সেখানে। তাইতো সুদূর হিমালয় থেকে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ফুলের টানে সুন্দরবনে আসে। তাদের আগমন বনজীবি মৌয়ালীদের সৌভাগ্যের প্রতীক। বিশ্বে যত প্রকার মধু পাওয়া যায়, তার মধ্যে ম্যানগ্রোভ মধু সবচেয়ে বিশ্ববিখ্যাত একটি ভৌগলিক স্বাদ। বনজীবিদের সাথে বনের প্রাণবৈচিত্র্যের সম্পর্ক কখনো সংঘাতের হতে পারে না, হতে পারে সহঅবস্থান। কিন্তু দু:খজনক সুন্দরবননির্ভর বনজীবী মৌয়ালীরা আজও তাদের পেশাগত স্বীকৃতি পাইনি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনের ব্যবস্থাপনায় তাদের শ্রেষ্ঠ অবদান রাখলেও, তারাই সবচেয়ে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অবহেলিত জনগোষ্ঠী। সুন্দরবনের সাথে তাদের জীবনযাত্রার প্রতিবেশিক সম্পর্ককে কখনো বিবেচনা করিনি সরকার। প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য়ের প্রতিযোগিতা থাকা সুন্দরবন কখনোও তার বনজীবী সন্তানদের থেকে বিছিন্ন বিষয় না। নীলগিরি সন্তানদের মত বনজীবী সন্তানদের প্রতি সরকারের সম্মান-শ্রদ্ধ-মমত্ববোধ-ভালবাসা-প্রেম সবকিছুই থাকা প্রয়োজন। তানাহলে প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যে উত্তীর্ণপ্রায় সুন্দরবন তার প্রতিবেশিক সৌন্দার্য হারাবে। অন্যথাই, আর্ন্তজাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ (সিবিডি ১৯৯২) ১০ এর “গ” ধারা লংঘন করবে সরকার। এবং সনদে স্বাক্ষরকারী বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে বায়োডাইভারসিটি কমিউিনিটি নলেজ প্রটেকশন এ্যাক্ট নামে যে একটি খসড়া নীতিগত কাঠামো তৈরী করেছে। যেখানে প্রাণবৈচিত্র্যের প্রথাগত/লোকায়ত ব্যবহার এবং প্রাণবৈচিত্র্যের সাথে স্থানীয় মানুষের স্থায়িত্বশীল সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তা বৃথা প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু না। লেখক: গবেষক ও কলামিষ্ট
০১৭১১৫৭৯২৬৭



0 comments:

Post a Comment