Saturday, June 11, 2016

টেকসই জাতীয় উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব

টেকসই জাতীয় উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব
আলী ফোরকান
একটি দেশ বা জাতি উন্নয়নের জন্য কয়েকটি বিষয়কে বিবেচনায় আনতে হয়। প্রথমত, টেকসই রাষ্ট্র কাঠামো, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, মেধাসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, দক্ষ দেশপ্রেমিক নীতি সঞ্চালনকারীদের এবং ওই জাতির সম্পদের সমাহার। সর্বোপরি রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নীতি সঞ্চালনকারী জাতির সম্পদ চিহ্নিত করার সক্ষমতা এবং চিহ্নিত সম্পদের প্রায়োরিটি নির্ধারণের বিচক্ষণতা। চিহ্নিত সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের প্রায়োগিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সম্পদ চিহ্নিত করার ব্যাপারে আমরা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারিনি। আমাদের সম্পদ বলতে প্রথমত, মানবসম্পদ, যার শতকরা ৬০ ভাগই ১৮-৪০ বছরের মধ্যে বয়স যা এক অনন্য সম্পদ। এরা খুবই কর্মোদ্যোগী নাগরিক। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং নীতি সঞ্চালনকারীদের ধ্যান-জ্ঞান হওয়া উচিত এ জনগোষ্ঠীকে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষায় পারদর্শী করে তুলে সমগ্র বিশ্বের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করা। বর্তমানে যে বিদেশি রেমিটেন্স বাংলাদেশে আসছে, যদি ১০ বছরে তার ৪-৫ গুণ বৃদ্ধি নিশ্চিত করা যায় তাহলে দেশের শিল্প, কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উন্নয়ন ত্বরানি¦ত হবে। ফলে জিডিপিও অনেক গুণ বেড়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত, সম্পদ হচ্ছে আমাদের উর্বর পলিবিধৌত দেশের মাটি এবং মিঠা পানি। এটা আমাদের সম্পদ। সুষ্ঠু পরিকল্পনা, ভূমি ব্যবহার এবং পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন করে এর উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
তৃতীয়ত, আমাদের রাষ্ট্রীয় সীমানা অর্থাৎ ভৌগোলিক অবস্থানটিই আমাদের একটা বিরাট সম্পদ। দেশের উন্নয়নে এটিকে কাজে লাগানো যায়। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানটাই ভূ-অর্থনীতির জন্য অত্যইন্ত সহায়ক। যদি সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে যথাযথ ডিপ্লোমেটিক ম্যানুভার করা এবং সুষ্ঠু ভৌত অবকাঠামো গড়ে তোলা যায় তাহলে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানকে ব্যবহার করে একটি সমৃদ্ধ অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব। আমাদের মনে রাখতে হবে, কানেকটিভিটি বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণ। যদি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় ৭টি রাজ্য নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার ও চীনের কুনমিং প্রদেশকে কানেকটিভিটি নেটওয়ার্কের আওতায় এনে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা দাঁড় করানো যায় তাহলে আমরা অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভবান হব। বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও সৃষ্টি হবে।
আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত ও চীন দু’দেশই বড় অর্থনীতির দেশ। আরও বড় হওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত গতিতে চালিয়ে যাচ্ছে তারা। এ চলমান প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গতি এবং সংহতি রক্ষা করে আমাদের অর্থনীতিকেও আরও বড় করার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। যদিও এটা কঠিন বিষয়, তবে অসম্ভব নয়। মেধা ও দক্ষতাসমৃদ্ধ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নীতি সঞ্চালনকারীরা এটা করতে পারে। চীন তার অপূরণীয় জ্বালানি ক্ষুধা নিবারণের জন্য বেলুচিস্তানের গাদোওয়ার বন্দর, জিন্নাহ নৌ-ঘাঁটি, শ্রীলংকার উত্তরে হামবানতোতায়, মিয়ানমারের কোকো দ্বীপে এবং কিয়াক ফিকাওয়েতে নৌ-বন্দর নির্মাণ করছে। আমরা চেষ্টা করলে মংলায়, পটুয়াখালীতে, নোয়াখালীর সমুদ্র উপকূলে এবং চট্টগ্রামে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন করে চীন-ভারতের জ্বালানি ক্ষুধা নিবারণের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারি। বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, চীন, মিয়ানমার এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলসহ সমগ্র এলাকার সরবরাহ নিশ্চিত করার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রিফাইনারি বিএমআরই করার জন্য তোমাদের অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। কুনমিং থেকে সড়ক ও রেলপথ মিয়ানমারের ওপর দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসতে রেল ও সড়ক যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে, যা চট্টগ্রাম গভীর সমুদ্রবন্দরকে যুক্ত করবে। বেনাপোল থেকে তামাবিল হয়ে ভারতের পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। মংলা বন্দর থেকে বাংলাবান্ধা হয়ে নেপাল পর্যন্ত সড়ক ও রেল যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে। বেনাপোল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম হয়ে ইয়াঙ্গুন পর্যন্ত আরেকটি সড়ক যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে। প্রস্তাবিত পটুয়াখালী সমুদ্রবন্দর থেকে সড়ক ও রেল যোগাযোগ পদ্মা ব্রিজ হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-বাংলাবান্ধা পর্যন্ত প্রসারিত করতে হবে। কলকাতা থেকে নদীপথে ঢাকা হয়ে আশুগঞ্জ পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে।
উপরোক্ত কার্যক্রম সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করার জন্য প্রচলিত রাষ্ট্র কাঠামো ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। আমার মনে হয়, স্বাধীন দেশ উপযোগী আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামো ও প্রাসঙ্গিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যার ভিত্তি হবে ‘জাতীয় ঐক্য’। অনেকেই বক্তৃতা-বিবৃতি-টকশোতে এবং পত্রিকার ফিচারে বিভিন্ন সময় খন্ডিত আকারে যুগোপযোগী রাষ্ট্র কাঠামো ও প্রশাসনিক পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু বক্তৃতা তুলে ধরেছেন। আমার জানা মতে, স্বাধীনতার অন্যতম সংগঠক বিশিষ্ট রাজনীতিক তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খান স্বাধীন দেশের উপযোগী আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামো, প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত এক পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি ‘প্যাকেজ’ আকারে জাতির সামনে তুলে ধরেছেন, যা ১৪ দফা রাজনৈতিক ঘোষণা হিসেবে খ্যাত। তিনি ফেডারেল সরকার ব্যবস্থার কথা বলেছেন। রাজনীতিবিদদের নির্ভর করতে হয় কখনও উচ্চ আদালত, কখনও নির্বাহী অঙ্গ, কখনও দলের ওপর, আবার কখনও নীতি সঞ্চালনকারীদের ওপর। তারা নির্ভর করতে পারেন না সমাজশক্তি যা উন্নয়ন ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, মেধা ও দক্ষতাসম্পন্ন মানুষের ওপর। এ কারণেই সরকারি দল এবং বিরোধী দল তার চাটুকারদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। অন্যের হাতে খাওয়াতে যেমন সন্তুষ্টি নেই, তেমনি পলিটিক্যাল ম্যানেজমেন্ট সম্পূর্ণ দলনির্ভর হলে পরিণতি ভালো হয় না।
আমরা জানি, সমাজ শক্তির প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকাই হলো সভ্যতার ক্রমবিকাশের চালিকাশক্তি। সভ্যতা মানে মানব জীবনের সব ক্ষেত্রের উন্নয়ন। বর্তমান পর্যায় থেকে আরেক ধাপ বা পর্যায়ে উন্নীত করার নামই উন্নয়ন। উৎপাদন প্রক্রিয়ার উন্নয়নের ‘কর্তা’ এবং উন্নয়নের ‘উপাদান’ এই দুয়ের সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করা অবশ্যই আবশ্যক। এখানে ‘কর্তা’ হলো ‘শ্রমশক্তি’ এবং দক্ষতার মালিক শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবী মানুষ। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য আজকের প্রয়োজন এবং বাস্তবতাই হলো ‘শ্রমশক্তি’ এবং দক্ষতার অধিকারী মানুষকে দলের পাশাপাশি জাতীয় রাজনৈতিক এবং জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মক্ষেত্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সরাসরি যুক্ত করা। তবেই জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব।

0 comments:

Post a Comment