Saturday, June 11, 2016

ব্যাংকিং অন ফেইথ

ব্যাংকিং অন ফেইথ
আলী ফোরকান
এশিয়ায় ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থা। বিভিন্ন ব্যাংক একের পর এক তাদের গ্রাহকদের জন্য ইসলামিক ব্যাংকিং সেবা চালু করছে। মালয়েশিয়ায় গত মে মাস পর্যন্ত পূর্ববর্তী ১২ মাসে ইসলামি ব্যাংকিং পদ্ধতিতে গাড়ি বিনিয়োগ প্রদান ২০ শতাংশ বেড়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় গত পাঁচ বছরে ইসলামি ব্যাংকিং শাখা বেড়েছে তিনগুণ।
ইসলামি ব্যাংকিংয়ের এই ব্যাপক প্রসার শুধু এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। মুডির তথ্য অনুযায়ী চলতি বছর বিশ্বে ইসলামি ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ চাহিদা এক লাখ কোটি ডলার (এক ট্রিলিয়ন ডলার) ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমানে উপসাগরীয় অঞ্চলের আরব দেশগুলোতে ইসলামি ব্যাংকিং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করে আছে। তবে এশিয়াও খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে।
ব¬ুমবার্গের তথ্য মতে, এ বছর বিশ্বে আট শ’ কোটি ডলার ইসলামিক বন্ড বিক্রি হয়েছে এবং এর মধ্যে ৬৮ ভাগ হলো এশিয়ায়। এশিয়ায় ইসলামি অর্থব্যবস্থার কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মালয়েশিয়া। ইসলামিক বন্ড ইস্যুর ক্ষেত্রে তারা এখন বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। মালয়েশিয়ায় বর্তমানে যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ হচ্ছে তার ২০ ভাগ ইসলামি ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণে। উপসাগরীয় অঞ্চলে এ অংশ ৩৫ ভাগ।
ইসলামি ব্যাংকিং কী?
ইসলামি ব্যাংকিংয়ের দু’টি দিক রয়েছে। এ ব্যাংক মূলত ওই সব মুসলমানের জন্য, যাদের ব্যাংকিং সেবা দরকার এবং সাথে সাথে যারা চান তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গাটা যেন ঠিক থাকে। ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে ধর্মের সাথে যেন কোনো আপস করতে না হয়।
পশ্চিমা দেশে যেমন নৈতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা (এথিক্যাল ব্যাংকিং) রয়েছে, এ ব্যবস্থা কিছুটি সে রকম। পশ্চিমা দেশে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান মাঝে মধ্যে গ্রাহকদের জন্য নৈতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা অফার করে থাকে। এসব ব্যাংক অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক পণ্য উৎপাদনে কোনো ধরনের বিনিয়োগ করে না। ইসলামি ব্যাংকেও একই নীতি মেনে চলা হয়।
প্রথাগত ব্যাংকের সাথে ইসলামি ব্যাংকের পার্থক্য হলো এটি শরিয়াহ আইন দ্বারা পরিচালিত। শরিয়াহ আইনের একটি প্রধান দিক হলো ‘সুদ নিষিদ্ধ করা’। এশিয়ার অন্যতম প্রধান ইসলামি ব্যাংক ‘সিআইএমবি ইসলামিক ব্যাংক বারহাদ’-এর নির্বাহী পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, প্রথাগত ব্যাংকের সাথে ইসলামি ব্যাংকের পার্থক্যের মূলে রয়েছে সুদব্যবস্থা। প্রথাগত ব্যাংকে বিনিয়োগ গ্রহীতা ও দাতার মধ্যে পারপরিক চুক্তির মাধ্যমে সুদ নির্ধারিত হয়। ইসলামি ব্যাংক তা করে না। কেউ টাকা পরিশোধে দেরি করলে ইসলামি ব্যাংক তার মাধ্যমে লাভবান হয় না। বিলম্বে বিনিয়োগ পরিশোধের জন্য চার্জ আরোপ করা হলে এবং এ বাবদ যে আয় হয় তা সমাজ কল্যাণে ব্যয় করা হয়।
সব ইসলামি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শরিয়াহ বোর্ড রয়েছে। বোর্ডের সদস্যরা সাধারণত শরিয়াহ আইন-কানুন ও ইসলামিক অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হয়ে থাকেন। মুসলমানরা ইসলামের মূলনীতি মেনে অর্থ সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও বিনিয়োগ গ্রহণে আগ্রহী। তবে এ ব্যাংক ব্যবস্থা সবার জন্যই উন্মুক্ত।
ইসলামি ব্যাংকিংসেবা
ইসলামি ব্যাংকিংয়ের অধীনে বেশ কিছু সেবা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সঞ্চয়, ক্রেডিট কার্ড, বিনিয়োগ ও বীমা। জনপ্রিয় ক’টি সেবা এখানে তুলে ধরা হলো।
মর্টগেজ ও গাড়ি বিনিয়োগ ঃ এ ক্ষেত্রে ব্যাংক ‘মুরাবাহা’ অথবা ‘ইজারাহ’ পদ্ধতি অনুযায়ী গ্রাহকের সাথে অর্থায়ন চুক্তি করে। মুরাবাহা চুক্তি অনুসারে ব্যাংক নিজে বাজার থেকে গাড়ি বা অন্য কোনো পণ্য কিনবে। তারপর বাজারের চেয়ে একটু বেশি দাম ধরে গাড়িটি গ্রাহকের কাছে হস্তান্তর করা হবে। গাড়ির দাম গ্রাহক কিস্তিতে পরিশোধ করতে পারে। ইজারা পদ্ধতিতেও ব্যাংক নিজে বাজার থেকে কোনো পণ্য কিনবে। তারপর গ্রাহককে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পণ্যটি লিজ দেয়া হবে। লিজের ভাড়া কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ থাকে এবং একপর্যায়ে পণ্যটির মালিক হয়ে যায় গ্রাহক।
বিনিয়োগ তহবিল ঃ যেসব প্রতিষ্ঠান নৈতিক আর্থিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত, তাদের ক্ষেত্রে সাধারণত ইসলামি ব্যাংক বিনিয়োগ করে। এটি অনেকটা সোস্যালি রেসপনসিবল ফান্ড (এসআরএফ) বা সামাজিক দায়বদ্ধ তহবিলের মতো। যেসব প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি অ্যালকোহল, তামাক, জুয়া ও পর্নোগ্রাফির মতো পণ্য উৎপাদন ও তৈরির সাথে জড়িত, তাদের ক্ষেত্রে ইসলামি ব্যাংক বিনিয়োগ করে না। এ ছাড়া শূকরের ব্যবসা করে এবং যেসব প্রতিষ্ঠান সাধারণ ব্যাংক ও বীমার মতো সুদ নেয় ও দেয় তাদের শেয়ার কেনার ক্ষেত্রেও বিনিয়োগ তহবিলের অর্থ খাটানো হয় না।
‘সোসাইটি অব ফাইন্যাসিয়াল সার্ভিস প্রফেশনালস’-এর সাবেক প্রেসিডেন্ট লিয়ং এসজি হিয়ান পরামর্শ দিয়ে বলেন, ইসলামি তহবিল ঝুঁকিমুক্ত নয়। ইসলামি মানে কম ঝুঁকিপূর্ণ, সেটি মনে করবেন না। আপনি যদি ইসলামিক ফান্ডের মূল বিষয়টি বুঝতে না পারেন তাহলে এটি আপনার জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তিনি বলেন, আপনার পুরো বিনিয়োগ ইসলামি তহবিলকে ভিত্তি করে আবর্তিত হলে তাতে পর্যাপ্ত বৈচিত্র্য থাকবে না।
ব্যাংক আমানত ঃ ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় জনসাধারণের কাছ থেকে অনেকভাবে আমানত গ্রহণ করা হয়। ‘মুদারাবা’ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে যে আমানত গ্রহণ করে তা ব্যাংক যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগ করে এবং লাভ ভাগাভাগি করে নেয়। এ ছাড়া ‘ওয়াদিয়াহ’ আমানত ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাংক গ্রাহককে সুদের বদলে হিবা বা পুরস্কার দিতে পারে।
তাকাফুল (ইসলামি বীমা) ঃ এ বীমা ব্যবস্থার মাধ্যমে এক দল লোক নিজেদের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে অপরের দুঃখ বা বিপদ ভাগ করে নেয়। এ জন্য তাকাফুল পরিচালনা পরিষদের মাধ্যমে তারা একটি সাধারণ তহবিল তৈরি করে এবং ওই তহবিলের মাধ্যমে কোনো সদস্যের বিপদে পাশে দাঁড়ানো হয়। এর মাধ্যমে তারা সমিলিতভাবে কোনো ঝুঁকি মোকাবেলা করে থাকে। প্রথাগত অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় ইসলামি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঝুঁকি ভাগাভাগি করে নেয়ার একটি মধ্যস্থতা কাঠামো আছে। আর এখানে স্বচ্ছতার জন্য কিছু কিছু আর্থিক লেনদেনের মূল বিষয়ের প্রতি নজর রাখা হয়। বাদলিশাহ জানান, ইসলামি ব্যাংকিংয়ে কোনো লুকানো খরচ নেই। ফলে আপনি যা দেখবেন বাস্তবে তাই পাবেন।
তিনি আরো বলেন, প্রথাগত অন্যান্য ব্যাংক আপনাকে যেসব নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দেবে ইসলামি ব্যাংকও ঠিক একই নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দেয়। যেটি গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা দরকার তা হলো অন্যান্য সাধারণ ব্যাংক ও ইসলামি ব্যাংক দেশের একই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিমালার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। ফলে উভয় ব্যাংকের গ্রাহকের অধিকার সমানভাবে সুরক্ষার ব্যবস্থা আছে।
এশীয় অঞ্চলের ইসলামি ব্যাংকিং বিকাশের ক্ষেত্রে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা জড়িত রয়েছেন। মালয়েশিয়া এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রতিযোগিতাপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় সিআইএমবি ইসলামিক ব্যাংক বিশ্বব্যাপী পরিচিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এইচএসবিসি’র ইসলামি শাখা ‘আমানাহ’ এবং ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ইসলামিক শাখা ‘সাদিক’-এর সাথে প্রতিযোগিতা করছে। এশিয়ায় মালয়েশিয়া যেমন ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উন্নতি লাভ করেছে তেমনি তাদের দেখাদেখি প্রতিবেশী ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুরও এর বিকাশকে উৎসাহিত করছে।
ইন্দোনেশিয়ার ইসলামি ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অধিক বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বসবাস। কিন্তু সে তুলনায় তারা ইসলামি ব্যাংকিংয়ে অনেক দেরিতে অগ্রসর হয়েছে। এখানকার কর্তৃপক্ষ ইসলামি ব্যাংকিংয়ের অনুমোদন দিয়েছে আর এ জন্য একটি নিয়ন্ত্রণ ও আইনি কাঠামো উন্নয়নের কাজ করছে। ইন্দোনেশিয়ার কর্তৃপক্ষ দেশটির সর্বত্র প্রথাগত ও ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম¦য়ে একটি দ্বৈত ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কাজ করছে, যাতে এটি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বা আর্থিক খাতে কোনো সঙ্কট সৃষ্টি হলে তখন সহায়তা করতে পারে।


0 comments:

Post a Comment