Sunday, June 19, 2016

পরকাল ভাবনা

পরকাল ভাবনা
আলী ফোরকান
ইসলামী জীবন বিধান মতে,জীবন পৃথিবীর অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। মূলত আমরা সবাই রুহের জগতে ছিলাম। সেখান থেকে ক্রমান¦য়ে আমাদের এই ধরায় পাঠানো হচ্ছে। আবার হায়াত বা জীবনের নির্দিষ্ট সময় শেষ হলেই চলে যেতে হচ্ছে। এই যে আসা এবং যাওয়া। এর মধ্যে আমাদের রব আল্লাহতায়ালার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিহিত রয়েছে। তিনি মানুষের মৃত্যু দিয়ে তাদের পৃথিবীর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান। কিন্তু কিছু মানুষকে দিয়ে দুনিয়ায় এমন সব কাজ করিয়ে নেন। যার মাধ্যমে তিনি মারা গেলেও কাল থেকে কালান্তরে মানুষের কাছে বেঁচে থাকেন। যুগ যুগ ধরে মানুষ তাঁদের জীবন ও কর্ম থেকে অনুপ্রাণিত হয় এবং তাঁদের আলোকিত জীবন থেকে দ্যুতি নিয়ে প্রদীপ্ত হয়। কোরআন শরিফে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ’কল্লু নাফসিন যায়িকাতুল মাউত’ অর্থাৎ প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এখানে আমরা প্রতিনিয়ত অবলোকন করছি যে মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। নির্ধারিত সময় শেষ হলেই প্রত্যেকেরই আল্লাহর কাছে হাজির হওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকবে না। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আয়নামা তাকুনু ইউদরিক-কুমুল মাউত অলাও কুনতুম ফী বুরুজিম মুশাইয়্যাদা’ অর্থাৎ মৃত্যু থেকে বাঁচার জন্য যদি কেউ সুদৃঢ় দুর্গের মধ্যেও আশ্রয় নেয়, তবুও মৃত্যু তাকে সেখানে পাকড়াও করবে। সুতরাং কেউ যদি মৃত্যুর কথা ভুলে গিয়ে পৃথিবীকে অনন্ত নিবাস ভাবে, তাহলে সেটা হবে একান্তই বোকামি। রাসুল (সা.) এক সমাবেশে তাঁর সাহাবিদের বলেছিলেন, ‘কে সবচেয়ে বুদ্ধিমান? সাহাবিরা স্বভাবসুলভভাবে বলেছিলেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলই ভালো জানেন।’ তখন রাসুল (সা.) বললেন, সেই ব্যক্তি প্রকৃত বুদ্ধিমান, যিনি মৃত্যুর জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকে। সাহাবিরা বললেন, হে রাসুল (সা.)! আমরা মৃত্যুর জন্য কিভাবে প্রস্তুত থাকব? রাসুল (সা.) বললেন, মৃত্যু যে খুব নিকটে সে মোতাবেক প্রস্তুত থাকবে। সাহাবিরা আবার বললেন, ‘হে রাসুল (সা.)! আপনি মৃত্যুকে কেমন নিকটবর্তী মনে করেন? রাসুল (সা.) বললেন, আমি যখন নামাজে ডানে সালাম ফিরাই তখন মনে হয় বামে সালাম ফিরাতে পারব নাÑএর মধ্যে মৃত্যু এসে যেতে পারে।’ আমরা যেমন আমাদের পূর্ববর্তীদের মৃত্যুবরণ করতে দেখেছি, তেমনি আমাদের সবাইকেই মৃত্যুর সঙ্গে আলিঙ্গন করতে হবে। পৃথিবী থেকে চলে যেতে হবে। কিন্তু কোথায় যাব? সেটা আরেকটি মঞ্জিল। আরেকটি জগৎ। যাকে হাদিসে আলমে বরজাখ বা প্রতিবন্ধনের জগৎ বলা হয়েছে। মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে যেখানে আমাদের থাকতে হবে। খুব ছোটখাটো সে ঘর। কিন্তু ঈমানের বলে এই ঘর কারো দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। ঘরটি হবে আলোকিত। থাকবে সাজানো-গোছানো সজ্জা। ফল-ফুল ও খাদ্যসামগ্রী সেখানে ভরপুর থাকবে। জান্নাতের দিকে ঘরের একটি দরজা খোলা হবে। সর্বদা তিনি জান্নাতের আলো, বাতাস ও সুঘ্রাণে রোমাঞ্চিত থাকবেন। মূলত সেটি হবে বেহেশতের একটি অংশ। পক্ষান্তরে ঈমানের ঘাটতির কারণে ছোট ঘরটি কারো জন্য ক্ষুদ্রতর হয়ে যাবে। নড়াচড়া করার কোনো উপায় থাকবে না। বরং তার ঘর বা কবরের দুই পাশের মাটি পৃথিবীর দুই প্রান্তে চলে যাবে। দুদিক থেকে এমন জোরে ধাক্কা দেবে যে তার একটি পাঁজর অন্যটির সঙ্গে মিশে যাবে। জাহান্নামের আজাবের প্রাণী সাপ-বিচ্ছু অনবরত তাকে দংশন করতে থাকবে। ঘরটি হবে ঘুটঘুটে অন্ধকার। জাহান্নামের দিকে তার কবরের একটি দরজা খুলে দেওয়া হবে। যার কারণে জাহান্নামের আগুনের হাওয়া সব সময় তার কবরে প্রবেশ করতে থাকবে। মূলত তার কবরটি হবে জাহান্নামের একটি অংশ। কেয়ামত পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকবে। তা ছাড়া যাঁরা দুনিয়ায় কিছু ভালো কাজ করে গেছেন, তাঁদের জন্য কবরের আজাব কিছুটা হালকা করা হবে। বুখারি ও মুসলিম শরিফের হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে, মানুষ যখন মারা যায় তখন তাঁর সব আমল বন্ধ হয়ে যায় তিনটি ছাড়া। ১. সাদকায়ে জারিয়াহ বা সমাজে এমন ভালো কাজ চালু করে যাওয়া, যার সুফল মানুষ ভোগ করে; ২. উপকারী জ্ঞান : তাঁর রেখে যাওয়া যে জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ সাধন হয়; ৩. সৎ সন্তান : যে তাঁর মা-বাবার জন্য দোয়া করে। যদি কোনো ব্যক্তি উপরোক্ত এ তিনটি কাজ করে কবরের বাসিন্দা হয়ে হন, তাহলে তাঁর কবরের আজাব কমানো হবে। যখন আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইস্রাফিল (আ.) শিঙায় ফুৎকার দেবেন তখন কেয়ামত সংঘটিত হবে। সব মানুষ আল্লাহর দরবারে সেদিন হাজির হবে। তখন আল্লাহ কাহ্হার রূপ ধারণ করে বিচারকের সিংহাসনে বসবেন। সেদিন কারো প্রতি অবিচার করা হবে না। সবার প্রতি তিনি সুবিচার করবেন। আজকের রাজা-বাদশাহ, ধনিক শ্রেণী, নেতা সবাই সেদিন বিচারপ্রার্থী অবস্থায় কাতারবন্দি হয়ে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। আল্লাহ বলেন, ‘সেই দিন (বিচার দিবসে) জিবরাইল (আ.), ফেরেশতারা ও সব মানুষ কাতারবন্দি অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকবে। কারো মুখে কোনো কথা থাকবে না। আল্লাহ যাঁকে আদেশ করবেন, সেই কেবল কথা বলবে।’ দুনিয়ায় যে ব্যক্তি সামান্য পরিমাণ পুণ্য করেছে তা সেদিন দেখতে পাবে। যে ব্যক্তি সামান্য পরিমাণ গুনাহ করেছে, সেটাও সেদিন সে দেখতে পাবে। পাপ-পুণ্যের ওজনের ভিত্তিতে কারো আমলনামা ডান হাতে এবং কারো বাঁ হাতে প্রদান করা হবে। যে ব্যক্তি আমলনামা ডান হাতে পাবেন, তিনি হবে সৌভাগ্যবান অর্থাৎ জান্নাতি। আর যে বাঁ হাতে পাবে, সে হবে দুর্ভাগা। তার স্থান জাহান্নাম। সেখানে তাকে অনন্তকাল কষ্ট আর কষ্টের মধ্যে কালাতিপাত করতে হবে। অন্যদিকে যিনি জান্নাতে যাবেন সেখানে তিনি আল্লাহর অফুরন্ত নিয়ামতের মধ্যে শান্তিতে বসবাস করবেন। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন আল্লাহতায়ালা গায়েব থেকে জান্নাতিদের বলবেন, আমি কি তোমাদের সঙ্গে আমার কৃত সব ওয়াদা পূর্ণ করেছি? তাঁরা বলবেন হ্যাঁ, হে আমাদের রব! কিন্তু আপনার সেই দিদার বা দর্শন এখনো সংঘটিত হয়নি। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা তখন তাঁর ৭০ হাজার নূরের পর্দা উন্মোচন করে দেবেন। আল্লাহ বেহেশতিদের দিকে তাকিয়ে থাকবেন। বেহেশতিরা আল্লাহর দিকে চেয়ে থাকবেন। এর মধ্যে ৫০ হাজার বছর কেটে যাবে। কোনো বেহেশতির চোখে কোনো পলক পড়বে না। অপলক নয়নে কেবল আল্লাহতায়ালাকেই দেখতে থাকবেন। বেহেশতের অগণিত নিয়ামতের মধ্যে আল্লাহতায়ালার দিদারের চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু থাকবে না। আর এটা পেতে হলে এখন থেকে নিজের মধ্যে একটি পরিবর্তন সূচিত করতে হবে। দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ীÑএ ধারণা যাঁদের মধ্যে বদ্ধমূল আছে। তাঁরা বিভ্রান্তদের মতো বিলাসী জীবনের দিকে ধাবিত হতে উৎসাহী হবেন না। তাঁরা হবেন নির্লোভ, নিরহংকার, পরোপকারী, বিনয়ী, সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবনের অধিকারী মানুষ।আল্লাহ আমাদের সকলকে তোমার দিদার লাভের তওফিক দান করুন।

0 comments:

Post a Comment