Sunday, June 12, 2016

শহুরে জীবন বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে

শহুরে জীবন বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে 
আলী ফোরকান
আমরা সমাজ বা রাষ্ট্রীয় জীবনে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হই, তার মূল কারণ মানুষ। আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজেরাই নিজেদের সমস্যা সৃষ্টি করে থাকি। প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে যদি আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ হতে পারতাম, তাহলে হয়তো আমাদের এত সমস্যা থাকত না। সমস্যা থাকলেও সহজ হোক কঠিন হোক, উত্তরণের কোনো না কোনো পথ পাওয়া যেত। তখন আমাদের জীবনযাত্রার মান আরো অনেক উন্নত হতো। মন-মানসিকতা সুন্দর হতো এবং জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে আমাদের মান-মর্যাদা অনেক বৃদ্ধি পেত। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। এ যে কত বড় ব্যর্থতা আর অসম্মানের ব্যাপার, তাও আমরা উপলব্ধি করতে সক্ষম নই।
ঢাকা শহরে মানুষের চাপ যে হারে বাড়ছে। তাতে সামনের দিনগুলোতে আমাদের এই শহরে সুস্থ-সুন্দর পরিবেশ রক্ষা করা ও নিরাপত্তার সঙ্গে বাস করা যাবে বলে মনে হয় না। লোকসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমাগত বাড়ছে হরেক রকম গাড়ির সংখ্যা। ক্রমবর্ধমান গাড়ির কারণে শহরে রাস্তাঘাটে চলাফেরা যেমন দায় হয়ে পড়েছে, তেমনি শব্দ দূষণ ও পরিবেশ দূষণে বিপর্যস্ত হচ্ছে ঢাকার নাগরিক জীবন। জাতি হিসেবে আমাদের ধৈর্যের প্রচন্ড ঘাটতি রয়েছে। ঘাটতি রয়েছে নিয়ম-শৃ´খলাবোধের। আমরা যে কত বিশৃ´খল জাতি, ঘরের বাইরে গেলেই তা প্রতি মুহূর্তে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। তাড়া সবারই আছে। এ দেশে পথচারীর যেমন তাড়া, তেমনি রিকশাওয়ালা, ঠেলাগাড়িওয়ালা বা গাড়িওয়ালারও সমান তাড়া। তাড়াহুড়ার এমন প্রতিযোগিতায় আসলে কেউই আগে যেতে পারে না। সবাই আগে যেতে গিয়ে এমন জট বাধায় যে, ঘন্টার পর ঘণ্টা জটে আটকে থাকতে হয়। পৃথিবীর উন্নত ও সভ্য দেশগুলোতে রাস্তাঘাটে গাড়ির সংখ্যা আমাদের চেয়ে কম নয়। তা সত্ত্বেও সেসব দেশে সবাই সর্বত্রই নিয়ম-কানুনকে শ্রদ্ধা করে, ট্রাফিক আইন পু´খানুপু´খভাবে মেনে চলে। গাড়ি চালাতে গিয়ে সেসব দেশে কারো ধৈর্য্যচুতি ঘটে না। এসব কারণে উন্নত বিশ্বে রাস্তাঘাটে হর্ন বাজানোর প্রয়োজন পড়ে না। অথচ আমরা অকারণে হর্ন বাজাই। যখন-তখন হর্ন বাজালে শব্দ দূষণের কারণে মানুষের নাগরিক জীবনে অশান্তি সৃষ্টিসহ শারীরিক ক্ষতি সাধিত হয়- এটা কি বইতে লিখে মানুষকে শেখাতে হবে? আমার মনে হয়, সমস্যা অন্যখানে। এখানে সংস্কৃতি, সভ্যতা এবং ঐতিহ্যেরও অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে।
শব্দ দূষণ আমাদের শরীরে মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম। এ কথাটি আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না। শব্দ দূষণের কারণে সারা বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ শ্রবণশক্তি হারাচ্ছে। একসময় ভাবা হতো, শব্দ দূষণ শুধু বিরক্তি উৎপাদন করে। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, আচার-আচরণে এবং মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ছাড়াও শব্দ দূষণ ঘুমের ব্যাঘাত, কাজকর্মে অমনোযোগ, শিশুদের মানসিক বিকাশরোধ, মানসিক চাপ এবং আক্রমাত্মক মনোভাব সৃষ্টির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। শব্দ দূষণ হৃদরোগ এবং স্ট্রোক সৃষ্টির পেছনেও অনন্য ভূমিকা রাখে। হৃদরোগীদের শব্দ দূষণমুক্ত পরিবেশে বসবাসের পরামর্শ দেওয়া হয়। শব্দ দূষণের কারণে শরীরে অ্যাড্রেনালিন নিঃস্মরণ বেড়ে যায়। যা রক্তনালি সংকোচনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। রক্তনালি সংকোচনের ফলে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। হৃৎপিন্ডের রক্তনালি সংকুচিত হলে হৃদরোগের উৎপত্তি হয়।
ঢাকার যানজট এক অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। যানজটের কারণে ইদানীং মানুষ ঘর থেকে বেরোতে ভয় পায়। যানজটে পড়লে ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় পড়ে থাকতে হয়। প্রতি বছর জনগণকে সচেতন করার জন্য ট্রাফিক মাস পালিত হয়। ট্রাফিক মাস উপলক্ষে ব্যানার ঝুলিয়ে, মাইক বাজিয়ে, জেল-জরিমানার মাধ্যমে নগরবাসীকে ট্রাফিক আইন মেনে চলার জন্য, চলন্ত গাড়িতে ওঠানামা না করার জন্য, জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পারাপারের জন্য আহ¡ান করা হলেও নগরবাসীকে তা মানানোর জন্য কোনো বিশেষ উদ্যোগ খুব একটা চোখে পড়ে না। ট্রাফিক পুলিশের সামনেই মানুষ ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে। ট্রাফিক পুলিশ অসহায়। মানুষের জন্য এখন আর রাস্তায় গাড়ি চালানো যায় না। হাজার হাজার মানুষ চারদিকে ছোটাছুটি করছে। চলন্ত গাড়ি থামিয়ে যত্রতত্র রাস্তা পার হচ্ছে। ঢাকা শহরের রাস্তায় কদাচিৎ জেব্রা ক্রসিং দেখা যায়। ট্রাফিক নিয়ম না জানার কারণে, এমনকি জানলেও তা না মানার কারণে রাস্তাঘাটে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। এখানে একটি বাস্তব ঘটনার কথা উল্লেখ না করলে নয়। কিছুদিন আগে তিতুমীর কলেজের সামনে এক দুর্ঘটনায় এক শিক্ষার্থী মারা যায়। এ কারণে ব্যাপক ভাংচুর হয়। ফলে কলেজের সামনে জরুরি ভিত্তিতে একটি সুন্দর ওভারব্রিজ তৈরি করে দেওয়া হয়। আশা করা গিয়েছিল, ছাত্রছাত্রীরা এই ওভারব্রিজটি ব্যবহার করবে। আমি প্রতিদিন সেই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কোনো ছাত্রছাত্রী সেই ওভারব্রিজটি ব্যবহার করে না। ট্রাফিক আইন না মানাটা আমাদের জাতীয় কালচারের একটি অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা শোধরানো কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেখানো যায় তাকে, যার শেখার আগ্রহ আছে, শিক্ষা আছে, যোগ্যতা আছে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষের শিক্ষা নেই, শেখার কোনো আগ্রহও নেই। আমাদের অনেকেরই পুঁথিগত শিক্ষা আছে; প্রায়োগিক শিক্ষা নেই। তাই আইন আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে না; আইনকেই আমরা তাড়িয়ে বেড়াই, পদদলিত করি।
মানুষকে ট্রাফিক আইন মেনে চলার জন্য প্রতিনিয়তই উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। কিন্তু ঢাকা শহরে ট্রাফিক আইন মেনে চলার উপায় আছে কি? ধরুন, আপনি বলাকা সিনেমা হলের পাশ দিয়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরির দিকে ফুটপাথ ধরে এগোতে চান। আপনি গলদঘর্ম হয়ে যাবেন; এগোতে পারবেন না। ফুটপাত পুরোটাই দখল করে আছে হকার ও পকেটমাররা। ফুটপাত হকারের দখলে থাকলে মানুষ বাধ্য হয়েই রাস্তা দিয়ে হাঁটবে, বিশৃ´খলা সৃষ্টি হবে, দুর্ঘটনা ঘটবে। সারা ঢাকা শহরের একই দৃশ্য। কোথাও কোনো ব্যতিক্রম নেই। মাঝেমধ্যে পুলিশি অ্যাকশনে ফুটপাত হকারমুক্ত হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ফলে মানুষের দুর্গতিও কমে না। ওভারব্রিজগুলোও হকারদের দখলে চলে গেছে। আমি মনে করি, টাকার সদ্ব্যবহার করার জন্য হলেও মানুষকে এসব ওভারব্রিজ ব্যবহারে বাধ্য করতে হবে। ওভারব্রিজ ব্যবহার করলে রাস্তা পারাপারে জনগণের চাপ কমে যাবে এবং আমরাও নিরাপদে গাড়ি চালাতে পারব। রাস্তা পারাপারের জন্য রাস্তার সুনির্দিষ্ট জায়গায় দৃশ্যত জেব্রা ক্রসিং থাকতে হবে। অনেক সময় গাড়ির যন্ত্রণায় মানুষ জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করতেও ভয় পায়। গাড়িচালকরা জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পথচারীকে রাস্তা পারাপারের খুব কমই সুযোগ দিয়ে থাকে। ট্রাফিক পুলিশকে অবশ্যই ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। ঢাকা শহরে প্রতি মাসে যে হারে গাড়ি আমদানি হচ্ছে, তাতে রাস্তায় গাড়ি চলার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা থাকবে না। ইদানীং যেসব ট্রাফিক আইন চালু করা হয়েছে, তার কিছু কিছু ফলপ্রসূ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ট্রাফিক সিগনাল মোতাবেক গাড়ি চলা, লেন পরিবর্তন না করে নির্দিষ্ট লেনে নির্দিষ্ট গাড়ি চলার বিধান আরো কঠোরভাবে প্রয়োগ করলে অবস্থার আরো উন্নতি ঘটবে। রাস্তা পারাপারে এবং যত্রতত্র মানুষের ছোটাছুটি এবং চলন্ত গাড়ি থামিয়ে রাস্তা পার হওয়ার প্রবণতা ও অভ্যাস বন্ধ করা দরকার। রাস্তাঘাটে যত্রতত্র মানুষের বিশৃ´খলভাবে চলাফেরা আমার কাছে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের অন্যতম কারণ বলে মনে হয়। এই শতাব্দীতে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ শহরেই বাস করবে। এর ফলে শহুরে জীবনের ওপর চাপ ক্রমেই বাড়তে থাকবে। বাসযোগ্য পরিবেশের অভাবে শহুরে জীবন বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। ঢাকা শহরের বর্তমান চিত্র এর ব্যতিক্রম নয়। সুতরাং এ ধরনের বিপর্যয় রোধে অধিকতর তৎপর হতে হবে।

0 comments:

Post a Comment