Tuesday, May 24, 2016

প্রাকৃতিক সম্পদ বেড়ে গেলে দারিদ্র্যও কমে আসবে






প্রাকৃতিক সম্পদ বেড়ে গেলে দারিদ্র্যও কমে আসবে 
আলী ফোরকান
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এদেশের মোট জনসংখ্যার সিংহভাগ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। আর দারিদ্র্যসীমার নিচে যারা বাস করে তাদের মধ্যে প্রথমেই আসে কৃষকের কথা। আমাদের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ কৃষক। জাতীয় আয়ের ৩৫ শতাংশ জোগানদাতা এই শ্রেণীই বেশি মানবেতর অবস্থায় জীবনযাপন করে। এদিকে এডিবি তাদের এশীয় উন্নয়ন আউটলুকে বলেছে, বাংলাদেশের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে দুটি বিষয়ের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আর তা হচ্ছে, দ্রুত দারিদ্র্য কমিয়ে আনা ও জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, দারিদ্র্যবিমোচন করতে হলে বাংলাদেশের জিডিপির হার শতকরা ৭ ভাগ হওয়া প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দারিদ্র্য নির্ণয়ের জন্য তিনটি বিষয়কে মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করেছে। প্রথমত, মাথাপিছু ক্যালরি গ্রহণ বা মাথাপিছু প্রকৃত ব্যয়; দ্বিতীয়ত, দারিদ্র্য রেখা, একজন ব্যক্তি বা পরিবারকে ন্যূতম সুযোগ-সুবিধা পেতে হলে যার ওপরে অবস্থান করতে হয়; তৃতীয়ত, জনসংখ্যার মধ্যে দারিদ্র্যের মাত্রা নির্ধারণের জন্য একটি সমষ্টিগত পরিমাপ। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০৯ অনুসারে প্রত্যক্ষ ক্যালরি গ্রহণ পদ্ধতিতে দারিদ্র্যপ্রবণতা জাতীয় ৪০.০%, শহরে ২৮.৪% ও পল্লীতে ৪৩.৮%। প্রত্যক্ষ ক্যালরি গ্রহণ পদ্ধতিতে দারিদ্র্যের প্রবণতা জাতীয় ১৯.৫%, শহরে ২৪.৪% ও পল্লীতে ১৭.৯%। খাদ্য গ্রহণ পদ্ধতিতে দারিদ্র্যপ্রবণতা জাতীয় ৮০%, শহরে ২৮.৪% ও পল্লীতে ৪৩.৮%। অন্যদিকে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার বিশেষজ্ঞরা বলছেন বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার দিন দিন বাড়ছে।
সম্প্রতি রাজধানীর আগারগাঁওয়ের আইডিবি ভবন মিলনায়তনে জাতিসংঘ তথ্যকেন্দ্র আয়োজিত ‘বৈশ্বিক সামাজিক অবস্থা ২০১০ : দারিদ্র্য নিয়ে পুনর্বিবেচনা’ শীর্ষক আলোচনার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশসহ আরো কয়েকটি দেশের দারিদ্র্যের চিত্র নিয়ে নানা মন্তব্য করেন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার বিশেষজ্ঞরা। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে জাতিসংঘের মন্তব্য হচ্ছে, বাংলাদেশে দারিদ্র্যের মাত্রা বেড়েই চলেছে। দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের মধ্যে এমনটি লক্ষ করা যাচ্ছে শুধু বাংলাদেশেই। এদিকে বিশ্বব্যাংক দৈনিক মাথাপিছু আয় এক ডলার ২৫ সেন্ট হলে তাকে দারিদ্র্যসীমার মধ্যে ফেলেছে। সরকারি হিসাবে বলা হয়েছে, ১৯৯১-৯২ থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়েছে ১৯ শতাংশ। ১৯৯১-৯২ সালে দেশে মোট জনগোষ্ঠীর ৫৮ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল দারিদ্র্যসীমার মধ্যে। ২০০৫ সালে এর হার কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশে। প্রতিবেদনে এশিয়ায় দারিদ্র্য হ্রাসের একটি হিসাবও প্রকাশ করা হয়। জানা গেছে, ১৯৯০ থেকে ২০০৫ সালে গড়ে প্রতি বছর ১ দশমিক ৬ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমেছে দক্ষিণ এশিয়ায়। দারিদ্র্য থেকে উঠে আসা দেশগুলো বলেছেন, দারিদ্র্য নিয়ে এখন বহুজাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো তেমন কিছু বলছে না। অথচ বিশ্বব্যাংকের বৈশ্বিক উন্নয়ন প্রতিবেদনের প্রতিপাদ্য ছিল দারিদ্র্য। বাংলাদেশে প্রতি বছর বিভিন্ন সময় উন্নয়নমূলক কর্মকা-সহ বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রচুর বৈদেশিক ঋণ বা সাহায্য এসে থাকে। কিন্তু এসব কোথায় যায় বা কি হয় সে সম্বন্ধে অনেক বিষয়ই অজানা থেকে যায় অনেকের কাছে। চিকিৎসা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি খাতের উন্নয়নে সরকারি সাহায্য সহযোগিতার কথাও কম শোনা যায় না। কিন্তু বিগত দুই দশকে বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস ও মেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি লক্ষ করা গেলেও গুণগতমান উন্নত হয়নি স্বাস্থ্য ও শিক্ষার। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। দেশের দারিদ্র্য হ্রাসে কাজ করে যাচ্ছে অগণিত দেশি-বিদেশি এনজিও, সরকারি কার্যক্রম ইত্যাদি। কিন্তু মাঝেমধ্যেই এসবের নানা দুর্নীতি, অনিয়ম প্রভৃতির খবর ছাপা হয় পত্রপত্রিকায়। আমরা জানি, শহরের চেয়ে গ্রামগঞ্জেই এগুলোর কার্যক্রম বেশি। তবে বর্তমান সরকার কৃষির উন্নয়ন তথা গ্রামের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য নানা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। ডিজেলে ভর্তুকির ব্যবস্থা করেছে, সারের দাম কয়েক দফায় কমানো হয়েছে, সেচ ব্যবস্থা ভালো রাখতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাংলাদেশ যেহেতু কৃষি প্রধান দেশ সেহেতু কৃষির উন্নতি ঘটানোর বিকল্প থাকতে পারে না। পাশাপাশি শহরের উন্নয়নের দিকেও মনোযোগী হওয়া যেতে পারে। দারিদ্র্য কমাতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুনীতি প্রভৃতির প্রতি গুরুত্ব বাড়াতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে হবে কলকারখানা ও ক্ষেত-খামারে। তাতে করে কমে যাবে বেকারত্ব। এমনই পরিস্থিতিতে মার্কিনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট (ডব্লিআরআই) একটি ব্যতিক্রমধর্মী পরামর্শ দিয়েছে। তাদের মতে, আগামী এক দশকের মধ্যে দারিদ্র্যবিমোচন মিলেনিয়াম গোল বা সহশ্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। একইসঙ্গে তাদের দাবি পরিবেশ উন্নয়ন ছাড়া ওই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠানের দ্বিবার্ষিক প্রকাশনায় সম্প্রতি দারিদ্র্য মোকাবিলায় প্রাকৃতিক পরিবেশ ব্যবস্থাসংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, পাঁচটি দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটি সমীক্ষা চালিয়েছে। 
দেশ পাঁচটি হলোÑ নামিবিয়া, ভারত, তাঞ্জানিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিজি। বলা হয়েছে, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের মাধ্যমে দেশটিতে পর্যটন সুযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে আয় বাড়ানো সম্ভব। পক্ষান্তরে ভারতের মহারাষ্ট্রে পানি ব্যবস্থাপনা এবং বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে স্থানীয় বাসিন্দাদের রোজগার বাড়তে পারে বলে অভিমত প্রতিষ্ঠানটির। একই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রচলিত ভূমি ব্যবস্থাপনায় সংস্কার সাধনের মাধ্যমে তাঞ্জাবিয়ার উত্তরাঞ্চলে কৃষি কর্মসূচি বাস্তবায়ন হলে সেখানকার মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে। একই কারণে বাড়তে পারে স্থানীয় লোকজনের উপার্জন। ইন্দোনেশিয়ার প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, দেশটির একাধিক দ্বীপের বনাঞ্চল থেকে অবৈধভাবে গাছকাটা হচ্ছে। যা পরিবেশকে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। পরিবর্তে স্থানীয় লোকজন যদি নদী থেকে মাছ ধরে তা আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করে তাহলে অন্তত বনাঞ্চল অক্ষুণœ থাকে। যা এক সময় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে বলে ডব্লিউআরআই মনে করে। ফিজি সম্পর্কে বলা হয়েছে, স্থানীয় অধিবাসী যদি একটি নির্দিষ্টহারে কাঁকড়া, চিংড়ি এবং একই জাতীয় জলজপ্রাণী ধরে জীবিকা নির্বাহ করে তাহলে এটি দীর্ঘদিন তাদের অর্থনৈতিক জোগানের ক্ষেত্র হতে পারে। লাগামহীন মৎস্য ও জলজপ্রাণী শিকার প্রকারান্তরে অর্থনৈতিক ভিত্তিকে ঝুঁকির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। রিপোর্টের মোদ্দাকথা, অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে এবং সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রাকৃতিক উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে সবার আগে। তাহলেই জলবায়ুর রুদ্রমূর্তি রোধ করা সম্ভব হবে। বাড়বে প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রাকৃতিক সম্পদ বেড়ে গেলে দারিদ্র্যও কমে আসবে। দারিদ্র্য কমে গেলে দেশ থেকে অনেক ধরনের আর্থসামাজিক সমস্যারও কমবেশি সমাধান হবে। আমরা আশা করি সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পরিবেশ বাঁচাতে, দারিদ্র্য নির্মূল করতে বনজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় এগিয়ে আসবে অনেকেই। 

0 comments:

Post a Comment