Saturday, May 21, 2016

দিবসে কিন্ত পরিবর্তন আসে না

দিবসে কিন্ত পরিবর্তন আসে না
আলী ফোরকান
ওরা কেবল দিবসটির নামই শুনেছে। তবে আদিবাসী দিবস কি তা তারা জানে না। পাহাড়ের সব জাতিসত্তার কাছে এখনো পৌঁছেনি যার বার্তা; আধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা কিংবা জন্মনিয়ন্ত্রণ এসব নিয়ে নেই তাদের কোন মাথা ব্যথা । প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠে ওরা নিজের মতো করে। এছাড়া কোন বছরই তাদের কাছে আদিবাসী দিবসের বার্তা নিয়ে কেউ আসেনি। এদিকে আদিবাসীদের মধ্যে এখনও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশনসহ অনেক বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। আদিবাসী দিবস উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি পর্যায়ে কোন আনুষ্ঠানিকতা নেই। তবে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো সীমিত পর্যায়ে আদিবাসী দিবস পালন করলেও এর বার্তা সাধারণ আদিবাসীদের মধ্যে পৌঁছায় না। প্রতিবছর ৯ আগস্ট আর্ন্তজাতিক আদিবাসী দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। এ দেশে দিবসটি পালনের ২৪ টি বছর পেরিয়ে গেলেও ওদের জীবনে আসেনি আধুনিকতার এতটুকু ছোঁয়াও। মানবাধিকার কমিশনের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ সাব-কমিশনের আদিবাসী জনগণ সম্পর্কিত কর্মদল তাদের প্রথম সভায় ১৯৯২ সালে আদিবাসী দিবস পালনের জন্য ৯ আগস্টকে বেছে নেয়। সেই থেকেই পালন হয়ে আসছে দিবসটি। আদিবাসী জনগণের মানবাধিকার, পরিবেশ উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সুদৃঢ় করা ও গণসচেতনতা সৃষ্টি করাই বিশ্ব আদিবাসী দশক, বর্ষ ও দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু বিশ্ব আদিবাসী দিবস ভিনদেশগুলোতে আদিবাসীদের ভাগ্যোন্নয়ন হলেও এদেশের আদিবাসীদের জীবনে এতটুকুও পরিবর্তন আনতে পারেনি। বিশ্বে ৭০টি দেশে ৩০ কোটি আদিবাসী জন জাতি রয়েছে। তারমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ও কানাডার ইন্ডিয়ান অস্ট্রেলিয়ার ইলুইট বা এস্কিসোস, উত্তর ইউরোপের সামী, নিউজিল্যান্ডের মাওরি অন্যতম। বাংলাদেশের ১৯৯১ সালে আদমশুমারি অনুযায়ী আদিবাসী সংখ্যা ১২ লাখ ৫ হাজার ৯৭৮ জন। বেসরকারিভাবে জানা যায়, বাংলাদেশে ৪৫টি আদিবাসী জাতিসত্তা মিলে তাদের জনসংখ্যা আনুমানিক ১৬ লাখের বেশি। বাংলাদেশে আদিবাসী জনগণ স্বাধীনতাযুদ্ধে ও দেশ গঠনে দেশের উন্নয়নে সামাজিক সাংস্কৃতিক বিকাশে তাদের অবদান রেখেছে। যদিও বাংলাদেশ জাতিসংঘ সদস্যরাষ্ট্র তবুও বাংলাদেশ এখনো সরকারিভাবে দিবসটি পালিত হয়নি।
দেশের এক-তৃতীয়াংশ আদিবাসীর বসবাস পার্বত্য বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায়। এখানে মারমা, চাকমা, মুরং, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খুমি, খেয়াং, চাক ও লুসাইসহ ১১টি আদিবাসী সম্প্রদায় বসবাস করছে। সারা বিশ্বে ধুমধামের সঙ্গে আদিবাসী দিবস পালিত হলেও এখানকার আদিবাসীরা জানেও না আদিবাসী দিবস কী। ১৯৯১ সালে সরকারি আদমশুমারি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা আদিবাসীর সংখ্যা ২ লাখ ৩৯ হাজার ৪১৭, মারমা ১ লাখ ৪২ হাজার ৩৩৪ জন, ত্রিপুরা ৭৫ হাজার, তঞ্চঙ্গ্যা ৫০ হাজার, মুরং ২৫ হাজার, বম আদিবাসী ৮ হাজার, খুমি ১৭৩৪, পা´েখা- ৪ হাজার, খেয়াং ২ হাজার, লুসাই ১০৯৮ এবং চাক ২৫০০ জন। তবে বর্তমান হিসাব অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীর সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ। ১৯৯৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রেজুল্যুশনের মাধ্যমে ৯ আগস্টকে আর্ন্তজাতিক আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার সুসংহত করতে জাতিসংঘ ১৯৯৫-২০০৪ সাল পর্যন্ত সময়কে আদিবাসীদের জন্য আদিবাসী দশক হিসেবে ঘোষণা করে। আর্ন্তজাতিক আদিবাসী দশকের মূল সূর হলো ‘আদিবাসী জনগণ-কর্মে অংশীদারিত্ব’ (ইন্ডিজিনাস পিপলস; পার্টনারশিপ ইন অ্যাকশন)। প্রথম দশকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্র অর্জিত না হওয়ায় ১ জানুয়ারি ২০০৪-২০১৪ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় আর্ন্তজাতিক আদিবাসী দশক ঘোষণা করা হয়েছে।
এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীরা এখনো নানা বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীদের উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিলেও এর ছিটেফোঁটাও আদিবাসীদের কাছে পৌঁছায় না। আদিবাসীরা শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে আছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো আদিবাসীদের উন্নয়নের কথা বলে ব্যাপক লুটপাট চালাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের এখনো আদিবাসীদের ভূমি জবরদখল হচ্ছে। ক্যাচিং ঘাটায় যুগ যুগ ধরে তার দখলে থাকা জমি কতিপয় সেটেলার দখল করে নিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক স্থানে এখনো এভাবে ভূমি দখল চলছে। আদিবাসীরা এখনো বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। ৯ আগস্ট আদিবাসী দিবস বলে তারা শুনেছেন। তবে আদিবাসী দিবস কী তা তারা জানে না। এছাড়াও কোন বছরই তাদের কাছে আদিবাসী দিবসের বার্তা নিয়ে কেউ আসেনি। এদিকে আদিবাসীদের মধ্যে এখনা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশনসহ অনেক বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। আদিবাসী দিবস উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি পর্যায়ে কোন আনুষ্ঠানিকতা নেই। তবে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো সীমিত পর্যায়ে আদিবাসী দিবস পালন করলেও এর বার্তা সাধারণ আদিবাসীদের মাঝে পৌঁছায় না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও দেশের উল্টর পশ্চিমাঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠী স্বাধীনতার স্বাদ তো পায়ইনি বরং অত্যাচার, নিপীড়ন হয়রানি আর দারিদ্র্যের শিকার হয়েছে বংশ পরম্পরায়। সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৫২ বছর পরও সেই ঔপনিবেশিক আমলের মতো এখনো আদিবাসীদের বসতভিটা, নারীদের মান-সম্ভ্রম কেড়ে নেওয়া হয়। পার্থক্য হচ্ছে আগে এ অত্যাচার ছিল বিদেশিদের হাতে, এখন নিজ দেশের মানুষই লুটেরার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আদিবাসীরা হারিয়েছে তাদের নিজস্ব ভূমির অধিকার, সাঁওতালি সমাজে নানা গাছ গাছালি আর প্রাণ বৈচিত্রক ধারণ করে অনেক কদুম বা হেয়ালি প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু তাদের সেই সম্পদ সেই পুণ্য সেই জঙ্গল, মালি, পাহাড়, জলাশয় সব বেহাত হয়ে গেছে। তারা হয়েছে উদ্বাস্ত। খনিজসম্পদ উত্তোলনের নামে দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে সাঁওতাল জনপদ উচ্ছেদ করা হয়েছে। নিজের সম্পদ রক্ষা করতে মেয়ে অলিফ্লে ও সরেনের মতো নাম না জানা অনেক আদিবাসীকে জীবন দিতে হয়েছে। বাজেট কী অনেক আদিবাসী জানে না। বাজেটে কতটুকু বরাদ্দ পায় ওরা?
আদিবাসীদের মধ্যে রয়েছে কর্মসংস্থানের অভাব, শিক্ষার অভাব, নিরাপত্তার অভাব। এ কারণে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হতে পারেনি আদিবাসীরা। তাদের প্রধান পেশা কৃষি হলেও আজ তারা ভূমিহীন। অধিকাংশ পরিবার দরিদ্র হওয়ার কারণে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে গিয়ে বসতভিটা হাত ছাড়া হয়ে যায়। আজও আদিবাসীদের তাদের নিজস্ব ভাষায় পাঠ্যসূচি দেওয়া হয়নি। যার ফলে বাংলা ভাষা তেমন বুঝতে পারে না। আদিবাসীর বিরাট অংশ অশিক্ষিত থেকে যাচ্ছে। সরকারের নেওয়া অর্থনৈতিক কর্মকান্ড থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। খুব কম আদিবাসী বয়স্কভাতা বা অন্য সুযোগ-সুবিধা পায়। স্থানীয় মেম্বাররা ওদের কাছে টাকা চায় বয়স্কভাতার জন্য- এ কারণে ওরা এসব ঝামেলায় যায় না। দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রায় ২০ লাখ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, জয়পুরহাট, রংপুর, দিনাজপুর। এ অঞ্চলে প্রায় ৩০টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাস করে। এদের মধ্য সাঁওতাল, ওরাঁও, মুস্তারি, সাহাত্যে, রাজোয়ার, কর্মকার, মাহালি, আদিবাসী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সংখ্যালঘু এই জনগোষ্ঠী নিজস্ব সংস্কৃতি লোকাচার ও ভাষায় স্বতন্ত্র। যার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সুনির্দিষ্টভাবে আদিবাসী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল রহনপুর, গোমস্তাপুর, আমনুরা, ভোলাহাট এলাকায় রাজশাহী জেলার তানোর, গোদাগাড়ী, কাঁকন হাট, মু-মালা, দামকুড়াহাট এলাকায় নওগাঁ জেলার খান্দা নিয়ামতপুর পাঁচবিবি পঞ্চগড়ের আটোয়ারী, রানীগঞ্জ এলাকায় সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ তাড়াশ, সোনাপাড়া, সেয়া ও জোসাই এলাকায় এবং ঠাকুরগাঁও রংপুর বগুড়াসহ অন্যান্য জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় এদের আকাশসম বঞ্চনা মাথায় নিয়ে বসবাস।
স্বাধীনতা যুদ্ধের ১৯৭১ সালে যেসব আদিবাসী দেশ ছেড়ে গিয়ে ছিল তারা ফিরে এসে আগের জায়গায় মালিকানা ফিরে পায়নি। বারবার বাস্তুচ্যুতির কারণে জমির ওপর আদিবাসীদের দখল সংকুচিত হয়েছে। আদিবাসীদের প্রায় ৮৫ ভাগ পরিবারের কোন চাষযোগ্য জমি নেই। ভূমিদস্যু, সুদখোর মহাজন বিভিন্ন কৌশলে তাদের উৎখাত করে দখল নিয়েছে ভূসম্পত্তি। ভূমিকে ঘিরেই আদিবাসীদের সুখ-দুঃখ তাদের স্বপ্ন- সাধনা। আদিবাসী জমি তো দূরের কথা, আদিবাসীদের সমাধিস্থলটির গ্রামের নাম মবিদতার কিওলি আশ্রয় প্রকল্পের নামে। কোর্টে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রক্ষা পায়নি সমাধিস্থলটি। আদিবাসীরা মাছ ধরা ও মাটি কাটার মতো অনেক কঠিন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে।
অনেকে তাদের কাজ দিতে চায় না। একজন বাঙালি শ্রমিক যে পরিমাণ মজুরি পায় তার অর্ধেক মজুরি পায় আদিবাসী পুরুষ। আদিবাসী নারীদের মজুরি পাওয়ার অবস্থা আরও সঙ্গীন। মানুষ হলেও তাদের সামান্যতম মানবিক মূল্যটকুও দেওয়া হয় না। লোকজন তাদের বুনো সাঁওতাল বলে গলি দেয়, ব্যঙ্গ করে। সবকিছুই তাদের নীরবে-নিভৃতে সহ্য করতে হয়। এই জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্য সচেতন করে তোলার জন্য কারো মাথা ব্যথা নেই। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় রাস্তাঘাট অবকাঠামো উন্নয়ন হয় না। সুপেয় পানি, বিদ্যুৎ-এ সবের কথা তারা ভাবতে পারে না। ধর্মীয় বিভেদ থেকে সৃষ্ট এই ভেদ ভুলে যেতে হবে। আদিবাসী নেতাদের আশা দেশের আইন অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। জনকল্যাণমূলক সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে আসবে আদিবাসীদের জন্য এটাই আজ সময়ের দাবি। গায়ের রং, মুখের ভাষা কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাস ভিন্ন বলে একই দেশ ও মাটির মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তারা আলাদা বা ভিন্ন বলে চিহ্নিত। ভদ্র-সভ্য মানুষের সমাবেশে তাদের স্থান হয় না। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, প্রশাসন, আইন কেউ তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে চায় না। আদিবাসীদের এ অবস্থা কিছুতেই চলতে পারে না। ওদের জীবনের গতিপথ ঘুরিয়ে দিতে এখনই সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। তা না হলে ওদের প্রতি অবিচারের দায়ভার গিয়ে বর্তাবে আমাদের ওপরই।
০১৭১১৫৭৯২৬৭

0 comments:

Post a Comment