Saturday, May 21, 2016

কিশোর অপরাধ : সভ্যতা যেন দেউলিয়ার পথে

কিশোর অপরাধ : সভ্যতা যেন দেউলিয়ার পথে
আলী ফোরকান 
আমরা এখন স্বাধীনতার ৪৫ বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। একটি জাতি ও ব্যক্তির জন্য ৪৫ বছর অবশ্যই একটা তাৎপর্যপূর্ণ সময়। শিশু, কিশোর, যৌবনে যা কিছু অর্জিত হয়, তার প্রতিফলন ঘটে এ সময়ে এসে। পেছনের সুখ-দুঃখকে পেছনে ফেলে নতুন জীবনে যাত্রা শুরু করে সে। পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ তৈরির সক্ষমতাও তার সাফল্য ও ব্যর্থতার ওপর নির্ভর করে এবং সেই অর্জনের সুফল বা কুফলের অংশীদার হয়। পূর্বপুরুষের দেয়া বিষয়-সম্পত্তি এবং ব্যক্তিগত অর্জনের সম্মিলনের ফলই এ সময়ে ভোগ করার কথা। এখনকার অবস্থানই বলে দেবে সে পূর্ববর্তী সময়গুলোকে কিভাবে কাজে লাগিয়েছে। এ সময়ে যদি সে দাঁড়াতে না পারে, তবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তা দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তার এ ব্যর্থ জীবনের অংশীদার পরবর্তী প্রজন্মকেও হতে হয় বৈকি।
আমাদের দেশের ৪৫ বছরের সার্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে মনে হয়, স্বাধীনতার পর যে বিষবৃক্ষ রোপণ করেছি, তার বিষাক্ত ফল আমরা ভক্ষণ করে যাচ্ছি এবং তার বীজ থেকে তৈরি হচ্ছে আরও নতুন বিষবৃক্ষ। জীবনের এ নতুন অধ্যায়ে এসে আমাদের সমাজজীবনে চরম অবক্ষয়ের চিত্র জীবন্ত হয়ে আছে। সাম্প্রতিককালের ইভটিজিংয়ের মতো ঘটনা প্রতিনিয়তই যেভাবে ঘটছে ও বাড়ছে। তা আমাদের জীবনকে অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে ক্রমশ। যারা এতদিন নিজেদের নিরাপদ ভেবে হাত গুটিয়ে বসেছিলেন, তারাও এখন এ সামাজিক অস্থিরতার বেড়াজাল থেকে নিজেদের রক্ষা করার পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। কেননা বখাটেরা শুধু মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার মধ্যেই তাদের অনাচার সীমাবদ্ধ রাখেনি, বাসায় এসে প্রেমিকাকে হুমকি-ধামকি কিংবা তার বাবা-মাকে খুন করে যাচ্ছে।
জাতীয় একটি দৈনিকে প্রকাশ, চলতি বছর এপ্রিল নাগাদ শুধু ঢাকা শহরেই ৫১১ জন কিশোর সন্ত্রাসীর তালিকা করেছে পুলিশ। পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব কিশোর স্কুল-কলেজের সামনে নারীদের উত্ত্যক্ত করা থেকে সামান্য বিষয় নিয়ে মানুষ খুন করার মতো ঘটনাও ঘটিয়ে থাকে। সব ঘটনা তুলে ধরলে এ তালিকা আরও দীর্ঘ হবে। কোন একটি এলাকা থেকে শুধু একদিনেই ১১ জন কিশোরকে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার অপরাধে গ্রেফতার করেছে পুলিশ, যাদের বয়স ১৬ থেকে ১৯-এর মধ্যে। বলা বাহুল্য, এরা সবাই ছাত্র এবং সচ্ছল পরিবারের সন্তান। মূলত পথের শিশুরাই বড় হয়ে নানারকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এটা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু এখন সচ্ছল পরিবারে যতেœ বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েরাও নানা ধরনের অপরাধে নিজেদের জড়িয়ে ফেলছে। খুন করতেও হাত কাঁপছে না তাদের। সব বখাটের কারণে পিংকি, ইলোরার মতো আরও অনেক মেয়েই বেছে নেয় আত্মহননের পথ। পুলিশ প্রশাসনের ভাষ্য মতে, মূল্যবোধের পরিবর্তন, সামাজিক অবক্ষয় ইত্যাদি কারণে কিশোর-তরুণরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। পুলিশ এদের তালিকা করেছে। এদের ধরার চেষ্টাও চলছে। তাদের ধারণা, কিশোর-তরুণরা নিত্যনতুন মোবাইল ফোন, দামি কম্পিউটার, পোশাক-আশাকের মোহেও পা বাড়ায় অপরাধের পথে। বাবা-মা চাহিদা পূরণ করতে না পারলে এরা টাকার লোভেই অপরাধ করে বসে।
অথচ এক যুগ আগেও ঘরভর্তি সন্তান ছিল। এসব সন্তানের পক্ষে বাবা-মায়ের যথাযথ যতœ ও তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এছাড়া পরিবারের সীমিত আয়ের মধ্যেই সবার চাহিদা সীমাবদ্ধ থেকেছে। তবে বাড়ির মধ্যে অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত গৃহকর্তার নির্ধারিত নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য থাকত সবাই। বাবা-মা, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও গুরুজনদের নীতি, আদর্শ অনুসরণ করে জীবনের সঠিক পথ খুঁজে বের করাই সে সময় ছোটদের জীবনের লক্ষ্য মনে করা হতো। সে সময় কিশোর-যুবকদের বখে যাওয়ার ঘটনা ঘটত খুবই কম। অথচ বর্তমান সমাজ অর্থবিত্তের মোহে এমনই ডুবে আছে যে, তা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় কোন আদর্শ নয়, বরং যেনতেন উপায়ে বিত্তবৈভব অর্জনের কৌশল আয়ত্ত করাই। এ ধরনের মনমানসিকতা আমাদের নীতিবিবর্জিত এক জাতিতে পরিণত করছে। রাজনৈতিক দৈন্য-দুর্দশা, শিক্ষাজগতে নৈরাজ্য, সমাজসেবার নামে নিজের স্বার্থ হাসিল এবং স্বেচ্ছাচারিতা ইত্যাদি কিশোরদের মধ্যে হতাশা ও ব্যর্থতার জন্ম দিচ্ছে। যার পরিণামে তারা অনিবার্যভাবে নানা অপরাধের দিকে পা বাড়াচ্ছে।
স্বাধীনতার পর একটি প্রজন্ম অতিক্রান্ত হয়ে আরেকটি প্রজন্মের সূচনা ঘটেছে। সাম্প্রতিককালের মতো এমন সংকট এদেশে আর কখনও দেখা যায়নি। বর্তমানে সভ্যতা একেবারে যেন দেউলিয়া হয়ে গেছে। সৌজন্যবোধের অভাব প্রতিনিয়তই বিস্তার লাভ করছে। বর্তমানে ছাত্রসমাজের একাংশের উচ্ছৃংখলতার কথা বলতে গেলে তা হবে খুবই দুঃখ ও বেদনার। যেখানে তাদের ওপরই নির্ভর করে দেশ ও জাতির গৌরব, সেখানে মূল্যবোধের অবনতি, তাদের অরাজকতা ও উন্মাদনা যেন জাতীয় জীবনের এক অশনি সংকেত। অথচ ছাত্রজীবন হল মানুষের প্রস্তুতিপর্ব। এর ওপরই নির্ভর করে তার পরবর্তী জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতা। ছাত্রজীবনে যে পিতামাতা-গুরুজনকে শ্রদ্ধা করতে শিখল না, যার দুর্বিনীত ব্যবহারে শিক্ষকরা ক্ষুব্ধ, বেদনাহতÑ পরবর্তী জীবনেও তার একই আচরণের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এটাই স্বাভাবিক।
ইভটিজিংয়ের ভয়াবহতা রোধে সরকার নানা ধরনের আইন প্রণয়নের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু আইন দিয়েই কী সব অপরাধ রোধ বা দমন করা যায়? মূলত আইন প্রয়োগের ব্যর্থতাই মানুষকে অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়। এমনকি আইনি দুর্বলতার সুযোগে অপরাধী অপরাধ করতে দ্বিধাবোধ করে না। অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তি না হলে পরে ভুক্তভোগীও ধীরে ধীরে নিজেকে অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এ কঠিন বাস্তবতারই প্রতিফলন।
জীবন গতিশীল। সম্মুখের যাত্রাপথ পাড়ি দিতে হলে মানুষকে ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষকেই সর্বোৎকৃষ্ট সমাজ গঠনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। চরিত্র মানব জীবনের এক অমূল্য সম্পদ। এ শিক্ষা আমরা পেয়েছি কৈশোরেই। সত্যনিষ্ঠা, প্রেম, পরোপকারিতা, দায়িত্ববোধ, শৃংখলা, অধ্যবসায় ও কর্তব্য পালনের মতো চারিত্রিক গুণাবলী ভালোভাবে মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখেই আমরা শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায় সমাপ্ত করে থাকি। তবে এ শিক্ষা যেন আমাদের পরীক্ষার খাতায় নাম্বারিংয়ের মানদন্ড হিসেবেই পরিগণিত। এ যেন পুঁথিগত বিদ্যা শেখানো ও শেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বিশ্বের প্রতিটি দেশ যেখানে প্রস্তুতি নিচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নিজেদের সফল ও উন্নত করতে; সেখানে এদেশে প্রস্তুতি চলছে আত্মহনন ও হত্যার মাঝে জীবনের অর্থহীন পথকে খুঁজে বের করার। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতা ও অদূরদর্শিতা যেন নিয়তির লিখন। এ থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে নতুন প্রজন্মকে আমরা রক্ষা করতে পারব না কিছুতেই। এ দায়িত্ব নিতে হবে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানীসহ সবাইকে। তবে সেক্ষেত্রে আগে নিজেকে সংশোধন করতে হবে। নিজেদের অর্থলিল্পা, স্বার্থপরতা, হীনমন্যতা দূর করতে হবে। নতুবা নতুন প্রজন্মকে আদর্শের বুলি শুনিয়ে সঠিক পথে পরিচালনা করা যাবে না। গুরুজনকে তখনই ছোটরা সম্মান ও অনুসরণ করবে যখন গুরুজন নিজেকে সম্মানিত অবস্থানে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে।
০১৭১১৫৭৯২৬৭


0 comments:

Post a Comment