Saturday, May 21, 2016

পানি সংকট ও সমাধান

পানি সংকট ও সমাধান
আলী ফোরকান
পানি প্রাণের উৎস। খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে পানি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্বোত্তম। জীবনধারণের জন্য পানি অমূল্য হলেও বাজার ব্যবস্থার নিরিখে পানির কোনো দাম নেই। প্রকৃতি পানি সরবরাহ নির্ধারণ করেছে। অথচ মনুষ্য বৃদ্ধির প্রান্তসীমা নির্ধারণ করা হয়নি। তাই অপ্রতিহত গতিতে পানির চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রাপ্ত পানির শতকরা ৭০ ভাগ ব্যয় হচ্ছে কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদনে। অন্যদিকে নদীনালা ও জলাশয় শুকিয়ে যাচ্ছে। বৃহৎ নদীগুলোর কিছু নদী যেগুলো শস্য উৎপাদনকারী ভূখ-ের মধ্য দিয়ে সারা বছর সমুদ্রে পতিত হতো, সেগুলোও শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনক হলো, মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে মাটির নিচের জলাধারগুলো থেকে পানি উত্তোলনের ফলে, এগুলোর জলস্তর নিচে নেমে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির পরিবর্তন ঘটিয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। দুনিয়ার শতকরা ৬০ ভাগ লোকের গাঙের অববাহিকায় বসবাস। আবার এ নদীগুলো দুই বা ততোধিক দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। ফলে জলের কারণে দেশগুলোর মধ্যে যেমন বিভেদের সৃষ্টি হতে পারে আবার তেমনি একতাবদ্ধও হতে পারে। চীন অথবা ভারতের মতো জনবহুল দেশের যে কোনো একটিতে চরম পানি সংকট দেখা দিলে বিপুলসংখ্যক জনগণের বহির্গমন ঘটতে পারে। এমনকি যুদ্ধের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জল সরবরাহের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায় না। সুতরাং চারভাবে জলের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে।
প্রথমত, জলধারার নির্মাণে এবং জল সরবরাহে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ, মাটির নিচে জলাধার নির্মাণ, লিকিং পাইপের প্রতিস্থাপন এবং সেচ কাজে যতটুকু জল না হলেই নয় ততটুকুই ব্যবহার প্রভৃতি।
দ্বিতীয়ত, বৈজ্ঞানিক উপায়ে কৃষিজ দ্রব্যাদির আকার এবং গুণাগুণের পরিবর্তন করে কম জলখেকো এবং খরা প্রতিরোধক দ্রব্যাদি উৎপাদন করা।
তৃতীয়ত, বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রযুক্তিগত জ্ঞানের উন্নতি সাধন করে লবণাক্ত জলের লবণাক্ততা দূর করে ব্যবহারের ব্যবস্থা করা।
চতুর্থত, বাজার ব্যবস্থাকে হস্তক্ষেপ ছাড়া পানির দাম নিরূপণ করতে দিয়ে চাহিদা এবং সরবরাহের ভারসাম্য বিধান করা। এটা করতে পারলে যেসব দেশ বা অঞ্চলে পানির আধিক্য, সেসব দেশ বা অঞ্চল খড়াপীড়িত অঞ্চলে পানি সরবরাহ করে আয়ের পথ করতে পারে। পানির সুষম ব্যবহারে চারটি উপায়ের প্রত্যেকটিকে কাজে লাগাতে হবে। এর যে কোনোটি বর্তমান ব্যবস্থায় পানির অপরিমেয় ব্যবহার স্বল্প সময়ে রোধ করতে পারবে না। আশার কথা এই যে, লবণাক্ততা দূর করার যে প্রযুক্তি তার অহরহ উন্নতি হচ্ছে এবং দামও কমছে। তারপরও এটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ফলে এ পদ্ধতিতে আহরিত পানি মিষ্টি পানির প্রয়োজনের মাত্র শতকরা ০.৪ ভাগ পূরণ করছে।
আগের তুলনায় সেচের আওতায় কৃষি জমির দ্বিগুণ বৃদ্ধি ঘটেছে। সেচে ব্যবহৃত পানির পরিমাণ বেড়েছে ৩ গুণ। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে খরাপ্রবণ এলাকায় মনুষ্য বসতির সংখ্যা শতকরা ৮ ভাগ অর্থাৎ ৫০ কোটি। ২০৫০ সালে এর পরিমাণ হবে শতকরা ৪৫ ভাগ বা ৪০০ কোটি। জল সেচের অভাবে বর্তমান বিশ্বে প্রয়োজনের চেয়ে খাদ্য উৎপাদন কম হয় এবং ১০০ কোটি লোক রাতে অনাহারী নিদ্রা যায়। যেসব নাতিশীতোষ্ণমন্ডলীয় দেশে সারা বছর মাঝারি থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। সেসব দেশ উপলব্ধি করতে পারে না সেচের জন্য কী পরিমাণ পানি দরকার! ব্রিটেনে উত্তোলিত জলের শতকরা ৩ ভাগ সেচ কাজে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে উত্তোলিত জলের শতকরা ৪১ ভাগ সেচ কাজে ব্যবহৃত হয়। ভারত ও চীন উত্তোলিত জলের শতকরা ৭০ ভাগ সেচে ব্যবহার করে। পৃথিবীব্যাপী সেচে জল ব্যবহারের পরিমাণ শতকরা ৭০ ভাগ। ক্রমবর্ধমান মানুষের জন্যই শুধু পানির চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। মানুষের উন্নত স্বাদের খাবার গ্রহণের জন্যও পানির চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, এক কিলো সয়াবিন উৎপাদনে যে পরিমাণ পানির দরকার হয় তার চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণ পানির দরকার হয় এক কিলো বাদাম উৎপাদনে। এক কাপ চায়ের উৎপাদনে যে পানির প্রয়োজন হয়, তার পাঁচগুণ বেশি পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয় এক গ্লাস কমলার রস উৎপাদনে।
শিল্প খাতে পানি ব্যবহারের পরিমাণ শতকরা ২২ ভাগ এবং গৃহস্থালির শতকরা ৮ ভাগ। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এ দু’খাতে পানির ব্যবহার বেড়েছে চারগুণ। পানি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের ধারণা, পানি ব্যবহারকারী সব খাতে পানি চাহিদা বাড়বে। পৃথিবীতে অন্য সব ধরনের চাহিদা পূরণের চেয়ে পানির চাহিদা পূরণের ব্যাপারটা ভিন্ন। কারণ পানি সরবরাহ সীমিত। আজকের পানির যে সরবরাহ তাই থাকবে ২০২৫ এবং ২০৫০ সালে। বিজ্ঞানের ভাষায় পানি যেভাবেই ব্যবহৃত হোক না কেন, এর ধ্বংস নেই। ভূপৃষ্ঠের শতকরা ৯৭ ভাগ সমুদ্র। এর জল লোনা। জলের লবণাক্ততা দূর করার প্রযুুক্তিগত খরচ কিছু কমলেও এখনও ব্যয়বহুল। ফলে অদূর ভবিষ্যতে জলের লবণাক্ততা দূর করে কৃষিতে ব্যবহারের আশা নেই। মোট প্রাপ্ত পানির শতকরা মাত্র আড়াই ভাগ লবণমুক্ত। এর শতকরা ৭০ ভাগ মেরু অঞ্চলে, হিমবাহে অথবা ভূ-অভ্যন্তরের হিমায়িত অঞ্চলে। সামুদ্রিক প্রাণী ছাড়া পৃথিবীর তাবৎ প্রাণীর বাঁচার জন্য পানির পরিমাণ মাত্র শতকরা .৭৫ শতাংশ। প্রাপ্ত এ জলের সিংহভাগ দৃষ্টি বহির্ভূত ভূ-অভ্যন্তরের জলাধারে এবং অবশিষ্টটুকু বৃষ্টির অবয়বে পতিত নদনদী, খালবিল, ডোবা এবং পুকুরে। তাছাড়াও বায়ুন্ডলে পানি থাকে।
সারা পৃথিবীতে পানির প্রাপ্তি সমানুপাতিক নয়। প্রাপ্ত পানির শতকরা ৬০ ভাগ পায় মাত্র ৯টি দেশ। এর মধ্যে ব্রাজিল, কানাডা, কলম্বিয়া, কঙ্গো, ইন্দোনেশিয়া এবং রাশিয়া অন্যতম। আমেরিকার পানিপ্রাপ্তির যোগ তুলনামূলকভাবে ভালো। পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ জনঅধ্যুষিত চীন এবং ভারতের প্রাপ্ত পানির পরিমাণ প্রায় ১০ শতাংশ। একই দেশের ভেতরেও পানির প্রাপ্তিতে রয়েছে বৈষম্য। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বার্ষিক গড় বৃষ্টির পরিমাণ পশ্চিম মেরু অঞ্চলের চেয়ে ১১০ গুণ বেশি।
ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে শুষ্ক এলাকাগুলোও আর বৃষ্টি এবং ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের প্রাকৃতিক পানির ওপর নির্ভরশীল না থেকে গভীর এবং অগভীর নলকূপের সাহায্যে ভূ-অভ্যন্তরের জলাধার থেকে পানি উত্তোলন করছে। নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে ভারত, চীন এবং বাংলাদেশ উত্তোলিত পানির পরিমাণ প্রতি বছরই জলাধারগুলোর শূন্যতা বৃদ্ধি করেছে। এটা বিশেষ করে ঢাকাসহ পৃথিবীর বড় শহরগুলোর কোটি কোটি মানুষের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কারণ বড় শহরগুলো ভূ-অভ্যন্তর থেকে সিংহভাগ পানি উত্তোলন করছে। ভূ-অভ্যন্তরের শূন্যতা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে ২০০ বছরের মধ্যে বা তার অনেক আগেই ভূ-অভ্যন্তরের জলাধার শুষ্ক হয়ে যাবে। কিন্তু তার আগেই শুরু হয়েছে শহরের দেবে যাওয়া।
পানির দাম নির্ধারণ করা হোক বা না হোক, পানি অমূল্য। শুধু খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনেই শিল্প খাতের প্রতিটি উৎপাদিত পণ্যের জন্যই পানির ব্যবহার অপরিহার্য। মাইক্রো চিপস থেকে শুরু করে স্টিল গার্ডার তৈরিতে পানির প্রয়োজন। ধনী দেশগুলোর শিল্প খাতে পানির ব্যবহার শতকরা ৬০ ভাগ। বাকি দেশগুলোর শিল্প খাতে পানির ব্যবহার শতকরা ১০ ভাগ। ধনী দেশগুলোর গৃহস্থালিতে পানির ব্যবহার শতকরা ১১ ভাগ। বাকি দেশগুলোতে শতকরা ৮ ভাগ। ধনী এবং অবশিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে গৃহস্থালিতে পানি ব্যবহারের তারতম্যের অন্যতম প্রধান কারণ। ধনী দেশে প্লানে অপরিমিত জলের ব্যবহার এবং শৌচাগারে জলশ্রোতের ব্যবহার। মানবকুলের প্রত্যেকের জন্য দৈনিক খাদ্য এবং পানিতে কমপক্ষে ২ লিটার পানি দরকার। ষষ্ঠ শতাব্দীতে বাইজানটাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান বাতাস এবং পানিকে সবার জন্য অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। পানির প্রয়োজনে বহুমাত্রিকতা থাকার জন্যই এর ব্যবহারে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জটিল এবং সুকঠিন। তাই সময় থাকতে বাংলাদেশকে সর্তক হতে হবে। পানির অকাল মহামারি রুপ ধারণের আগেই সমাধানের পথে এগুতে হবে।
০১৭১১৫৭৯২৬৭

0 comments:

Post a Comment