Sunday, May 22, 2016

মাদক: জাতীয় মাদক: জাতীয় অস্তিত্বকেও বিপন্ন করছেঅস্তিত্বকেও বিপন্ন করছে

মাদক: জাতীয় অস্তিত্বকেও বিপন্ন করছে
আলী ফোরকান 
হেরোইন আসক্ত যুবক নেশার টাকার জন্য মাকে খুন করেছে। পত্রিকার খবরে প্রকাশ, চাঁপাই নবাবগঞ্জের সদর উপজেলার রানীহাটির রামচন্দ্রপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত বন কর্মকর্তার ছেলে হারুনুর রশিদ (৩০) নেশার টাকা টাকা না পেয়ে তার মা রেবিনা খাতুন (৫৫) কে উপর্যপুরি ছুরিকাঘাত  করে । এতে ঘটনাস্থলেই রেবিনা খাতুনের মৃত্যু হয়। অপর খবর টি আমাদের জন্য আরো বেদনার। ঐশী নামে এক পুলিশ দম্পতির মেয়ে,  মাদকাসক্ত হয়ে নিজ বাবা মাকে খুন করেছে। কি মর্মান্তিক খবর! কি সে এমন বস্তু ? যা সৃষ্টির সেরা জীব একজন মানুষকে এত নিচে নামাতে পারে। যার আসক্তির জন্য গর্ভধারীনি বাবা মাকে খুন করতে পারে! এই প্রচন্ড শক্তিশালী বস্তুর নাম মাদক।  আর মাদকের মধ্যে হেরোইন বা ইয়বা  এমনই একটি শক্তিশালী মাদকদ্রব্য। যার আসক্তিতে মানুষ তার মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে। শরীর ও মস্তিস্কের ওপর এর বিষাক্ত প্রতিক্রিয়ায় যুবসমাজ ধ্বংস ও মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। হেরোইন ছাড়া ও কোকেন, মরফিন, কোডেইন, অথবা পেথিডিন নতুবা গাঁজা, হাশিশ, ফেনসিডিল ও অ্যামফেটেমাইন। কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের অনেকের কাছে মাদক বিনোদন মূলক বস্তু। মাদক গ্রহণ করে আন্দঘন সুখকর উচ্ছাস উপভোগ মাদকসেবীদের কাছে এক আকর্ষণীয় অনুভুতি। উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েদের অনেকেই অ্যাডভেঞ্চারিজমে ভোগে। অ্যাডভেঞ্চারিজমের অংশ হিসেবে জীবনের কোনো না কোনো সময় এরা ধুমপানসহ মাদকদ্রব্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। এসব ছেলেমেয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঙ্গদোষে বদ অভ্যাসে জড়িয়ে পড়ে।  স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই নানাবিধ সমস্যায় ভোগে। এসব সমস্যা সমাধানে বাবা-মা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা শিক্ষক-শিক্ষয়ত্রীদের কাছ থেকে কার্যকর কোন সময়েপযোগী সাহায্য-সহযোগিতা ও সমর্থন না পেয়ে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।  দিনের পর দিন হতাশা বাড়তে থাকে এবং স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা কাজকর্ম থেকে এরা আস্তে আস্তে দুরে সরে পড়ে। অবজ্ঞা, অবহেলা, ব্যর্থতা, হতাশা এদের কর্মবিমুখ করে তোলে। এদের একটি বড় অংশ হতাশা থেকে মুক্তি পেতে মাদকদ্রব্যকে সঙ্গী করে নেয়। তারা ভাবে মাদক ও মাদকাসক্তি সব সমস্যা দুর করবে। বিশ্বের সব দেশে মাদক ব্যবসায়ীদের ভাড়াকরা প্রমোটার থাকে। তারা উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্নভাবে তাদের মাদকের প্রতি আসক্ত করে তোলে। একবার আসক্ত হয়ে পড়লে মাদকসেবীরা মাদক গ্রহন না করে থাকতে পারে না। পরিণামে যেকোনো কিছুর বিনিময়ে মাদকদ্রব্য সংগ্রহে মরিয়া হয়ে উঠে। এ অসহায় অবস্থার সদ্ব্যবহার  করে মাদক ব্যবসায়ীরা প্রচুর টাকা হাতিয়ে নেয়। দীর্ঘদিন মাদক গ্রহণের ফলে শরীর ও  মনে ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। মাদকসেবীদের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে খুব দ্রুত। কারণ এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়ে যায়। সাধারন সংক্রামক রোগেও ওষুধ কার্যকর ভুমিকা রাখতে পারে না। মাদকদ্রব্য গ্রহণে ক্যান্সার ও হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।  এছাড়া দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে মাদকদ্রব্য মানুষের ক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা নষ্ট করে দেয়। দেশের অধিকাংশ মাদকসেবী কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতী। যে সমাজের ওপর দেশের শিক্ষা-দীক্ষা, উন্নতি, অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল। তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ যদি মাদকাসক্তিতে পথ ভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। তবে সে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। মাদকাসক্তির ভয়াবহতা থেকে যুবসমাজকে রক্ষা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ।
 ১। অধিকাংশ স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া কিশোর-কিশোরী,যুবক-যুবতী বেশির বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মাদকের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা না ভেবেই মাদক গ্রহণ শুরু করে। তাই উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা দিতে হবে। 
২। মাদক গ্রহণ সমস্যার যত না সামাজিক বা রাষ্ট্রীয়, তার চেয়ে বেশি মনস্তত্বিক।কিশোর-কিশোরী,যুবক-যুবতী বা উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের যাবতীয় সমস্যাকেই বিবেচনায় নেয়া উচিত।
৩। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন জনসমাবেশে মাদক গ্রহণের করুণ পরিণতি সম্পর্কে নিয়মিত প্রচার করা ব্যবস্থা করা। মাদক সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য জাতীয় প্রচারমাধ্যম গুলোতে কার্যকর ভুমিকা পালন করতে হবে। 
৪। বাংলাদেশে মাদক ও মাদকাসক্তির ক্ষতিকর প্রভাব আরো ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছার আগেই জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া চোরাচালান বন্ধের জন্য সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে কঠোর করতে হবে।
 ৫। মাদকসেবীদের চিকিৎসা পুর্নবাসন একটি জটিল,ব্যয়সাপেক্ষ ও জরুরি পদক্ষেপ। কার্যকরভাবে এ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা গেলে অন্ধকার অপরাধ জগৎ থেকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার অনুৃপ্রেরণা পাবে।  
বাংলাদেশের ডিপার্টমেন্ট অব নারকটিক্্র কন্ট্রোলের (ডিএনসি) হিসাবেই ২০ লাখ নর-নারী বর্তমানে নেশাগ্রস্থ। শিক্ষিত অভিজাত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এর প্রবণতা বেড়েই চলেছে। ড্রাগ কিনতে রুণ-তরুণীদের একটি বিরাট অংশ পা বাড়াচ্ছে পতিতাবৃত্তির দিকে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল নারকটিক্্র কন্ট্রোল স্ট্র্যাটেজি রিপোর্টে বাংলাদেশ সম্পর্কে এ মন্তব্য করা হয়েছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি ফর ইন্টারন্যাশনাল নারকটিক্্র অ্যান্ড ল এনফোর্সমেন্ট অ্যাফেয়ার্স অ্যানি ডব্লিউ প্যাটারসন রিপোর্টটি প্রকাশ করেন। রিপের্টে বলা হয়,পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকার স্কুল কলেজ ও মসজিদসমূহে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করে। এবিষয়ক বাজেট বাড়লেও এর কোনো  কার্যকারিতা লক্ষণীয় নয়। সরকার ঢাকা,চট্টগ্রাম,খুলনা ও রাজশাহীতে নেশা নিরাময় ক্লিনিক চালু করলেও সমস্যা মোকাবেলায়  এটা একেবারেই অপর্যাপ্ত। ২০০৫ সালে সরকার ২৫০ বেডের ড্রাগ হাসপাতাল স্থাপন এবং কিছু এনজিও আরো কিছু চিকিৎসা সুবিধা চালু করলেও বাংলাদেশের হিসাবে এটা খুবই ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকেই এ সুবিধা নিতে পারছেনা। রির্পোটের সারক্ষেপে বলা হয়, ভৌগোলিকভাবে ড্রাগ উৎপাদনকারি কিছু দেশের মধ্যভাগে অবস্থান হওয়ার কারণে বাংলাদেশ সব সময়ই ড্রাগ ট্রাফিকারদের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ড্রাগ হিসেবে ইয়াবা,হেরোইন,ফেনসিডিল ও প্যাথিডিনের প্রচলনই সবচেয়ে বেশি। ফেনসিডিলের উৎসভুমি হচ্ছে ভারত।কমদাম ও নেশা কার্যকারিতাই এর জনপ্রিয়তার কারণ। এক্ষেত্রে রফতানিযোগ্য মাদক উৎপাদনে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার বিষয়টি  তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ সরকার যে ধরনের নেতৃত্ব, জনবল ও সরঞ্জাম থাকা প্রয়োজন, সেটার অনুপস্থিতিই সমস্যাকে দিন দিন প্রকট করছে।রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকারকে সাহায্য করতে যুক্তরাষ্ট্র সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। বাংলাদেশে ড্রাগ চোরাচালান বন্ধে পেশাগত দক্ষতা ও কারিগরি প্রযুক্তি এবং অবকাঠামোগত উৎকর্ষের জন্য যা প্রয়োজন হবে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার তা দিতে কখনো কার্পণ্য করবে না। এ মনতব্যধর্মী প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের মাদকসংক্রান্ত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এর সাথে দুটি সামাজিক সমস্যাও চিহ্নিত করা হয়েছে। শিক্ষিত ও অভিজাত পরিবারের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে নেশাগ্রস্তের সমস্যা বাড়ছে। এ বাড়তি অংশটি দ্রুত পা বাড়াচ্ছে যৌনবৃত্তির দিকে। এর ফলাফল দু:সহনীয় হতে বাধ্য। আমাদের সামাজিক অস্থিরতা ও উচ্চবিত্তের ঘরে ঘরে অপরাধ বাড়ছে। ওপরতলার নৈতিক স্মলনের প্রভাব পড়ছে তরুণ-তরুণেিদর ওপর।  এর সাথে পশ্চিমা অপসংস্কৃতির কুপ্রভাবে আমাদের চিরায়ত মূল্যবোধ ও লোকজ ঐতিহ্যগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। পরিবার ভাঙছে। সামাজিক অস্থিরতার সাথে ভায়োলেন্স যোগ হয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিপথগামী করেদিচ্ছে।  অপরাধের ধরন পরিবর্তন হলেও মাত্রা বাড়ছে। নারীদের জীবনে নেমে আসছে বিভীষিকা। অপরাধপ্রবণ উচ্চবিত্তের সন্তানরদের মাধ্যমে শুধু নেশার প্রসার ঘটছেনা। অসংখ্য নারী হারাচ্ছে কুমারিত্ব। আমাদের সমাজ গড়ে উঠেছে ধর্মীয় মূল্যবোধ, পরিবার প্রথা ও নৈতিক বেষ্টনীর ভেতর। মাদকনেশা ও যৌনবৃত্তির শুধু অপরাধ বাড়াচ্ছে না। আমাদের জাতীয় অস্তিত্বকেও বিপন্ন করে তুলছে। এটি যে একটি ভয়াবহ জাতীয় সমস্যা। সম্ভবত আমাদের জাতীয় নীতিনির্ধারকদের কাছে তা এতটা গভীরভাবে ধরা দেয়নি। কারণ মাদকনেশার যে সয়লাব এবং এর যে পরিণতি, সেদিকে কাঙ্কিত নজর দেয়া হচ্ছেনা।  শুধু থার্টিফার্স্ট নাইটে পাহারা বসিয়ে এ ধস টেকানো যাবে না। এর জন্য বাজেট বাড়াতে হবে। প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। উদ্বুদ্ধকরণ প্রক্রিয়াকে আরো ব্যাপক ও গতিশীল করতে হবে। আমরা শুধু এইডস ঠেকাতে ধর্মীয় শিক্ষার কথা বলছি। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার কথা বলছি। বাস্তবে আমরা নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের শেকড় উপড়ে ফেলতেই অধিকতর সক্রিয়। এ প্রতিবেদনে যে ভীতিকর ভবিষ্যতের চিত্র ফুটে উঠেছে। তা ঠেকাতে সরকারি -বেসরকারি অরো উদ্যোগ প্রয়োজন। একটি সামাজিক আন্দোলন ও সময়ের দাবি। সবচেয়ে বড় দাবি, সরকারি ব্যবস্থা ও আইনের কঠোর প্রয়োগ। আমরা আশাকরি কতৃপক্ষ এটিকে জাতীয় সমস্যা ভেবেই পদক্ষেপ নেবে এবং তা নিতে সময়ক্ষেপণ করবে না।
০১৭১১৫৭৯২৬৭


                                                                                            

0 comments:

Post a Comment