রবীন্দ্রনাথ ও উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষ
ইঙ্গ-ভারতীয় সাহিত্যের এক উপযুক্ত পাত্র তাঁর উপন্যাসের এক বঙ্গ-দুহিতাকে দিয়ে ছড়া কাটিয়েছেন ঃ
জড়নর ইধনঁ, জ. ঞধমড়ৎব,ঙ, যব’ং ংঁপয ধ নড়ৎব!
জড়নর ইধনঁ, জ. ঞধমড়ৎব, ঙ, যব’ং ংঁপয ধ নড়ৎব!
ঙ, যব’ং ংঁ-ঁপয ধ নড়ৎব!
ঝঁপয ধ, ংঁপয ধ নড়ৎব.
ঝঁপয ধ, ংঁপয ধ নড়ৎব.
ঙ, যব’ং ংঁপয ধ, ঙ, যব’ং ংঁপয ধ, ঙ, যব’ং ংঁপয
ধ নড়ৎব.
জড়নর ইধনঁ, জ. ঞধমড়ৎব, ঙ, যব’ং ংঁপয ধ নড়ৎব!১
সম্প্রতি এই লাখবিকিয়ে বই-লেখকের প্রকাশকের অন্যতম উপদেষ্টা এক কলমচিকেও সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে আসতে ঘোষণা করতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথ এক ‘সাধারণ কবি, তৃতীয় শ্রেণীর অনুবাদক, দ্বিতীয় শ্রেণীর গল্পকার ও ঔপন্যাসিক এবং একজন সাধারণ সঙ্গীত শিল্পী।’২ কথাটা অবশ্য ঈষৎ পাল্টে নিতে হয়েছিল তাঁকে কিছুদিনেই। বলছেন, রাদিচে সাহেবের অনুবাদ পড়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা কিছুটা পাতে দেওয়ার যোগ্য মনে করেছেন। আর মেনে নিয়েছিলেন, গানই একমাত্র হতে পারে তাঁর খ্যাতির কেন্দ্র। ঊনশততম ‘অজ্ঞাত ভারতীয়’ থেকে অনতিতরুণ জনৈক সৎপাত্র পর্যন্ত তথ্যে-অতথ্যে গড়া তাঁদেরই সমদৈর্ঘ্যরে এক খর্বপুুরুষকে রবীন্দ্রনাথ নামদিয়ে ছায়াযুদ্ধ করে চলেছেন আজও।
অন্যদিকে ৯২-বর্ষ শেষের কলঙ্ককান্ডের পর এক প্রধান কন্নড় লেখক,৩ ঘটনাক্রমে ইংরেজি সাহিত্যেরই অধ্যাপক ও এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব উপাচার্য, বারবার পড়ে চলেছেন ‘গোরা’, সাহিত্য আকাদেমির কর্ণধার হিসেবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আয়োজন করেছেন, ‘গোরা’ চর্চাসত্র; তিনি আবিষ্কার করেছেন ভারতীয় সাহিত্যের নবীনতম লেখকের নাম রবীন্দ্রনাথ, ‘সাম্প্রতিকতম’ ভারতীয় উপন্যাসটি লিখেছেন, তখন থেকে আশি বছরেরও বেশি আগে। আর একজন ভারতীয় কবি, প্রয়াত গুজরাটি কোবিদ, উমাশঙ্কর যোশী রবীন্দ্রনাথের চিত্রকল্পের মধ্যে দেখেছিলেন আবহমান ভারতীয় নারীর চিরন্তন দৃষ্টি। তার স্নেহ-মায়া-মমতা, তার জায়া-কন্যা-জননী রূপ। আরও একজন কন্নড় কথাকার, উত্তর-নবতি বিশ্বকোষ-প্রণেতা, যক্ষগণের পুনরুদ্গাতা, কোটা শিবরাম করন্থ নিজেই বলেছেন, পরিবেশবিদ্যার প্রথম পাঠ তিনি পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে এসে। যার পরিণতি তাঁর ইদানীন্তন ‘কাইগা’ আন্দোলন। তাহলে দুরকম প্রক্রিয়াই ঘটতে দেখা যাচ্ছে ভারতীয় সাহিত্যে। শুধু কি অন্য ভাষায় লেখকদের মধ্যেই এই দুবিধ আলোড়ন? কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ থেকে ‘রবীন্দ্র-মাফিয়া’-বিরোধী যে- ধর্মযোদ্ধারা এজাহার দিয়ে চলেছেন আজও আর অজিতকুমার থেকে আইয়ুব পর্যন্ত বাঙলা সাহিত্যেই কি দেখা যাবে না আরও খরতর ঘাতপ্রতিঘাত? তিরিশের দশকে কেউ যখন রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে পথরোধ করে থাকার অনুযোগ করেন বা তাঁর সুশোভন রূপদক্ষতায় অসূয়াকাতর হয়ে ওঠেন অথবা তাঁর মোহন বাঁশিকেও প্রতারক মনে করেন, তাঁর এই বিলম্বিত সাময়িকদের উৎকণ্ঠার কারণ মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের অতীত মনে হয় না। কিন্তু তাঁর মৃত্যুরও অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এসে আজও যে তিনিই হয়ে ওঠেন প্রবল প্রতিপক্ষ। মূর্তিভাঙার আয়োজন করতে হলে বা নিজের প্রতিষ্ঠান-বিরোধী মূর্তি গড়তে হলে তিনিই যে হন প্রধান অভিলক্ষ্য প্রমাণ করে তাঁর অনিবার্য প্রাসঙ্গিকতা : কী বাংলায়, কী অন্যান্য প্রতিবেশী সাহিত্যে।
কিন্তু কেন হল এমনটা? আমরা যদি লক্ষ করি তাহলে দেখতে পাব, এক সময় নিজেদের আত্মপরিচয় খোঁজবার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল আমাদের কিছু সমকালীন মূর্তি এবং ভারতবাসী অত্যন্ত সৌভাগ্যমান যে একই সময়ে দুই অসামান্য পুুরুষকে তাঁরা পেয়েছিলেন এই আত্মরিচয়ের নির্ভর হিসেবে। একজন কবি, অন্যজন কর্মী। একজন রবীন্দ্রনাথ, অন্যজন গান্ধি। সবাই জানেন, ভারতবর্ষের বাইরে যেখানেই অনাবাসী ভারতীয় সম্প্রদায়ের বাস, সেখানেই দেখা যাবে এই দুই ভারতীয়ের নামাঙ্কিত কোনো-না-কোনো প্রতিষ্ঠান- শতবার্ষিকীর সরকারি উপঢৌকন হিসেবে নয়, সাধারণ মনুষের আত্মপরিচয়ের প্রয়োজনে। নিউজিল্যান্ডের হ্যামিল্টনে এমনই এক “টেগোর হল” দেখে প্রশ্ন করেছিলেন তার প্রতিষ্ঠাতা বর্তমান আমেরিকার এক মোটেল-শ্রেণীর অধিকারী অশীতিপর শ্রী এ.ডি.প্যটেলকে, এই নামকরণের তাৎপর্য বিষয়ে। অদ্ব্যর্থ স্পষ্ট উত্তর এসেছিল এক লহমায় : এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝি থেকে প্রবাসী যে-কোনো ভারতবাসীই গৌরববোধ করতেন- আর সেটাই ছিল তাঁদের গোত্র পরিচয়- যে তাঁরা ‘টেগোর’ আর ‘গান্ধি’র দেশের মানুষ। যারা দেশের বাইরে আছে, তাদের প্রত্যেককে বুঝতে হয়েছে ভারতবর্ষের আত্মপরিচয়ের জন্য, আর সেই আত্মপরিচয় দিয়েছিলেন এঁরা। তাই এঁদের নামের মধ্য দিয়ে আমাদের নিজেদের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছি। আমরা নিজেরা বেঁচে থাকবার চেষ্টা করেছি। খ্যাতিমান পদাধিকারী, পুরস্কৃত, শহিদ ভারতীয় আরও অনেকে ছিলেন, কিন্তু একটি সমগ্র দেশ ও জাতিকে সত্তাপরিচয় দিয়েছিলেন এই দুজন -এক জন কবি, আরেকজন কর্মী। আরও নিকটকালের উদাহরণ যোগ করা যায় : পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশে পরিণত হয়েছিল যে- স্বাজাত্যাভিমানে, তারও বিনির্মাণ করলে পৌঁছে যাব এক কবির উদগীত বচনে। তাহলে দেখতে পাচ্ছি, একটা সময় এই মূর্তি গড়ার প্রয়োজন হয়েছিল আত্মপরিচয়ের প্রয়োজনে। আর একটা সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী নিজেদের একটা মূর্তি গড়বার জন্য এই দু-জনের মূর্তি ভাঙার চেষ্টা হয়েছে। শুধু যে দু-জনেরই হয়েছে তাই নয়,আরও কয়েকজেনর হয়েছে, সেই সৌভাগ্যবানদের তালিকায় বিদ্যাসাগরও আছেন। কিন্তু এই রকম ঘটনা যে ঘটল, অর্থাৎ কখনো আত্মপরিচয় লাভের জন্য মূর্তি গড়া হল, কখনো আত্মপ্রকাশের জন্যে তাদের মূর্তি ভাঙবার প্রয়োজন হল। এটা ঘটল কিন্তু একটা অপ্রকৃতিস্থ অবস্থার কারণে, আর সেই অপ্রকৃতিস্থ অবস্থাটাই হল ঔপনিবেশিকতা।
নন্দন বা নিন্দন; রবীন্দ্র প্রসঙ্গে এই উভয় ধারার প্রতিক্রিয়াই তাহলে ঘটেছে ভারতীয় জীবন ও সাহিত্যের ব্যাপ্তবিস্তারে, একই সময়পটের মধ্যে। এর কোনটিকে ঋতু কোনটিকে অনৃত বিবেচনা করবেন সংস্কৃতবিদ্যার পাঠক? তার আরোহ-অবরোহের মাত্রাই-বা নির্ধারিত হবে কোন সূচকে? আর হবেই-বা কোন চিহ্নতত্ত্বের বিচারে, কোন পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে? নাকি ঘটমান ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক গতিরই পূর্বপক্ষ ও উত্তরপক্ষ হিসেবে সামাজিক রুচির তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা করবেন এই প্রবণতাগুলির? যে কোনো ব্যক্তিপ্রতিভার পরিমাপে এমন সমস্যা উঠে আসতেই পারে চিন্তা-চেতনার ইতিহাসে। রবীন্দ্র প্রসঙ্গে আরও গুণিত হয়ে ওঠে এই বাধা একাধিক কারণে।
প্রথমত সময়। তাঁর জীবন যেমন আঙ্কিকভাবে বিভক্ত দুই শতাব্দীতে, তেমনি ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসনের উত্থানপতনসংকুল নয়টি দশকের আটটি কেটেছে তাঁর জীবনকালে। দুই বিশ্বযুদ্ধ যেন ধনুর দুই প্রান্তের মতো ধারণ করে আছে পশ্চিমে তাঁর প্রতিষ্ঠা ও প্রতিক্রিয়ার ইতিহাসে। দ্বিতীয়ত অবস্থান। সাম্রাজ্যবাদের প্রতাপদম্ভের ক্রমোত্তাপের মধ্যে উপনিবেশিতের নিস্ফল দলেই নিজের স্থান বেছে নিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু সংকোচবিহ্বল আত্মলাঘববতা ত্যাগ করে। তৃতীয়ত সাহিত্যরুচির বিপবাতবিহার। পরম্পরার সঙ্গে এক স্বেচ্ছাছেদ মেনে নিয়ে ভারত-সাহিত্য এই সময়ে হয়ে উঠেছে প্রতীচীপ্রবণ। আর তখন সরল বিপ্রতীপতায় তিনি অতীতপ্রেমের স্বাদেশিক পথে চলেননি, বরং ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য নির্ভর করেছিলেন প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সংঘাতময় বর্তমানেই। চতুর্থত, বহুমুখিতা। কোনো ভাষার মহত্তম শিল্পীকে যদি পরিবেশ বৈগুণ্যে মেনে নিতে হয় আরও শতেকরকম ভূমিকা-এবং প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য ভাবে সফল ভূমিকা-তাঁর একটি সুকুতি অন্য আরেকটিকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে পারে লোকবিচারে। আর তার থেকেই তৈরি হয় অস্পষ্ট ভাবশরীরী এক মূর্তি। পঞ্চম, তাঁর স্বকীয় স্বতন্ত্র বিকল্প চিন্তা ও কর্মধারা। তাঁর সম ও উত্তর-কালের দেশবাসীর অধিকাংশেরই পক্ষে দুরূহ, প্রায় অসম্ভব ছিল ও আজও আছে তাঁর স্বভাবের এই চলমান নৈপূণ্য আবিষ্কার। সমকালেই ব্যতিক্রম-উজ্জ্বল বৈপরীত্য সত্ত্বেও অথবা সেই কারণেই-অবশ্য ছিলেন গান্ধি। যাঁদের সম্বোধন-বিনিময় ধরিয়ে দেয় তাঁদের সমতাবোধ ও পারস্পরিক কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা।
ঔপনিবেশিকতার মধ্যে একটা আরোপ আছে, একটা ভিন্ন সংস্কৃতিকে শ্রেয়তর বলে আরোপ করা হয় উপনিবেশিত সংস্কৃতির ওপর। এবং এমনটা বিভিন্ন দেশে ঘটেছে আমরা জানি। সতেরো শতক থেকে যে অভিযাত্রার যুগ শুরু হয়েছিল ইউরোপে তারই ফলে এশিয়া-আফ্রিকার বহু দেশ ইংরেজ, ফরাসি, ওলন্দাজ, ইস্পানি, পর্তুগীজ এবং দিনেমার উপনিবেশে পরিণত হয়। এই উপনিবেশের একটা প্রধান লক্ষণ হল ভাষালোপ। মাইকেল পলিয়্যানি যাকে বলবেন, ‘দ্য স্ম্যাশিং অফ দ্য স্পেক্টাক্্ল্স।’ আমাদের দেশেও এইভাবে ভাষালোপ করা হয়েছিল। টমাস ব্যাবিংটন্ ম্যাকলে, অসামান্য ধীশক্তিসম্পন্ন ঐতিহাসিক, ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি যে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন তার ফলে ইংরেজি হয়ে উঠেছিল আমাদের শিক্ষার ভাষা। আমাদের ন্যায়ের ভাষা, বিচারালয়ের ভাষা এবং তার পর থেকে যে-ইতিহাস সে ইতিহাসও আমাদের অজানা নয়। এই ভাষাহরণ কিন্তু শুধুই দৃষ্টিশক্তি হরণ করল না, সৃষ্টিশক্তিও হরণ করল। মূল্যবোধের মাত্রাটিকে সরিয়ে নিয়ে গেল অন্যত্র। ফলে আমাদের সাহিত্যের মানদন্ড হয়ে উঠল শেক্সপিয়র, মিল্টন, বায়রন, শেলি বা স্কটের সাহিত্যে। আর সেই বিচারেই পরিমিত হলেন কালিদাস, মধুসূদন, নবীনচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথ। এরই প্রতিক্রিয়ায় যে কোনে ঔপনিবেশিক সমাজে দুটো ধারা আমরা দেখতে পাই। একটি সহাযোগের ধারা, আরেকটি প্রতিযোগের ধারা। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় পড়ষষধনড়ৎধঃরড়হ, আর অন্যদিকে পড়হভৎড়হঃধঃরড়হ। এই দুই ধারা কখনো সংঘাতে লিপ্ত হয়, কখনো কখনো আমরা দেখি তার মধ্য দিয়ে, ওই ক্ষুরস্য ধারার মধ্য দিয়ে, কেউ-কেউ চলতে পারেন। খুব সতর্কভাবে, সংকিলভাবে আত্ম-অনুসন্ধানের পথে। উত্তর-ঔপনিবেশিক পরিবেশে ঠিক এরই প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পারি। আবার চেষ্টা হয় একধরনের আত্মান্ধানের, শেকড় ফিরে পাওয়ার। হিমেনেথের ভাষায় বললে, ‘শিকড়ের ডানা হোক, ডানার শিকড়।’ এইভাবে এর মধ্যে কিন্তু একটা উত্তেজনা এসে পড়ে। আত্ম-আবিষ্কারের উত্তেজনা। এই দুটো পর্যায়ের মধ্যে থেকে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে এবং কেমন করে ঔপনিবেশিকতার এই আরোপ, এই বন্ধনকে অস্বীকার করার চেষ্টা করছিলেন? গান্ধি একভাবে করেছেন, তাঁর সত্যাগ্রহ একটা বিকল্প পথের সন্ধান দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষত স্বদেশকর্মীর ভূমিকায় যাননি, কিন্তু তাঁর মধ্য দিয়ে আমরা আরও একাধিক বিকল্পের হয়তো সন্ধান পাব। এই প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা, রবীন্দ্রনাথ কোন সময়ে কী পরিস্থিতিতে এবং কাদের সঙ্গে কাজ করছিলেন, মনে রাখা দরকার। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহি বিদ্রোহ ঘটে গেছে। কোম্পানির হাত থেকে শাসন এসে গেছে রাজা বা রাণীর মুকুটের শীলমোহর আঁকা পাঞ্জায়। তারপরে চার বছরের মধ্যেই ভূমিষ্ট হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রায় দুই শতাব্দীতে আধাআধি ভাগ হয়ে যাওয়া তাঁর জীবন। তার যে ৯০ বছর ব্রিটিশ রাজশক্তির শাসন রইল ভারতবর্ষের ঠিক মধ্য পর্বের আটটি দশক জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। এবং এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ মেনে নিচ্ছেন নিজের স্থান ওই উপনিবেশিতের দলে। দ্বারকনাথ ঠাকুরের পৌত্র তিনি, কার-ঠাকুর কোম্পানির পথে যাচ্ছেন না, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র আদি ব্রাহ্মসমাজের ধারক হয়ে উঠছেন না। তিনি চলে যাচ্ছেন কখনো নদীমাতৃক দুর্গম পূর্ববঙ্গে, কখনো ঊষর পশ্চিমের রাঢ়ে, আর সেখানে তিনি নিজের মতো কাজ করে চলেছেন। এই যে নিস্ফলের দলে থাকার পথ তিনি বেছে নিলেন, একথা নিজের মুখেই তাঁকে বলতে হল যখন তিনি নাইটহুড পরিত্যাগ করলেন। সাহিত্যের দিক দিয়ে আরো একটা কথা আমাদের মনে রাখা দরকার। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বারবার বলেছেন, তাঁর জন্ম হয়েছিল এমন একটা সময়ে। যখন ব্যক্তিগত খুশির দৌড় প্রধান হয়ে উঠেছিল, সাহিত্যে, ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের জগৎ হয়েছিল ওয়ার্ডস্ওয়ার্থীয়, শেলির জগৎ শেলিয়, বায়রনের জগৎ বায়রনিক। আর তারপরে যে উদ্ধত আত্মপ্রচারের জগৎ এল তাকে তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। এমনকী যে ইউরোপ একসময় তাঁকে মুগ্ধ বিস্ময়ে গ্রহণ করল, সেই ইউরোপের আধুনিক কবিতাও তিনি মানতে পারলেন না। ইয়েটসের ‘লেক আইলস্ অপ ইনিসফ্রি’র বাইরে আর কোনো কবিতা মনে পড়ল না তাঁর। ইয়েটস্ ছাড়াও এলিয়ট বা পাউন্ডের কবিতাও তাঁকে আকর্ষণ করতে পারল না। তাঁর মনে হল যে আত্মদম্ভ এখানে টঙ্কার দিয়ে উঠছে। কিন্তু এই রবীন্দ্রনাথই আবার বাংলায় আধুনিকতার সবথেকে বড় প্রবর্তক হয়ে উঠলেন। যাঁরা আধুনিকতা নিয়ে আন্দোলনে মেতেছিলেন, তাঁরাও মেনে নিলেন যে তিনি সর্বোত্তম আধুনিক। এই যাঁকে বাইরের দিক থেকে মনে হবে দ্বিধাচিত্ত, যিনি ইউরোপীয় আধুনিকতা মানতে পারছেন না, তিনি কী করে বিচিত্রা ভবনে সমাবেশ ডেকে তরুণদের কথা শুনতে চাইছেন। জানতে চাইছেন তাঁদের আধুনিকতার ধরণ, তাঁদের সঙ্গে গড়ে তুলতে চাইছেন এক সংলাপের সেতু? এই প্রবণতর মধ্যেই আমরা দেখতে পাব যে দেশে এবং বিদেশে তাঁর ভূমিকায় হয়তো অবস্থানভেদ ঘটে যাচ্ছে। এবং এই রূপভেদ যে ঘটছে, এই রূপভেদ যে মেনে নিতে হচ্ছে তাঁকে, সেটাও কিন্তু ঔপনিবেশিকতর একটা আরোপিত পরিস্থিতির কারণে। অর্থাৎ দেশে যিনি কবি, ইউরোপে যেন তিনি হয়ে উঠছেন নবী ইউরোপে গেলেই তাঁকে বলতে হচ্ছে একসাধনার কথা। যদিও একটু পড়লেই আমরা বুঝতে পারছি, তার মধ্যেও আছে তাঁর এই উপনিবেশিতের বেদনা। ‘দ্য রিলেশন অফ দ্য ইন্ডিভিজুয়াল টু দ্য ইউনিভার্স’ বা আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর সংলাপ বা গিলবার্ট মারের সঙ্গে তাঁর আদান প্রদান ‘ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্টে’র মধ্যেও আমরা দেখতে পাব। যদি আমরা একটু মিলিয়ে নিই টয়েনবি আর ইকেদার সংলাপ। দুই স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকের সংলাপ, তাহলে দেখতে পাব যে রবীন্দ্রাথ যখন এই উপনিবেশিতের লাঞ্ছনা ভুলে কথা বলতে পারছেন না ইউরোপীয় চিন্তাধারা থেকে স্বতন্ত্র এক চিন্তাপ্রস্থানের প্রবক্তা হয়ে উঠছেন তিনি। এমনকী, কর্মী রবীন্দ্রনাথ যা কিছু করছেন, তার মধ্যেও আছে বিকল্প পন্থার সন্ধান। তাঁর বিশ্বভারতীও ঔপনিবেশিক শিক্ষার এক প্রতিবাদ। আমি মনে করি, যে ধরনের শিক্ষাধারা ভারতবর্ষের বিশ্ববিদ্যালয়ের তখন গড়ে উঠেছিল তারই নিজের মতো প্রতিবাদ তিনি করেছিরেন এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে।
সাহিত্যরুচির ক্ষেত্রে ভারতবর্ষে আরো একটা পরিবর্তন এল স্বাধীন হবার পরে এবং সেটা ঘটল ভারতীয় সাহিত্যের অসম উত্থানের ফলে। ভারতবর্ষ এক দেশ কিন্তু বহু ভাষার দেশ। অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষায় ইউরোপের সঙ্গে পরিচয় বা তার স্বাজাত্যের অভিমান থেকে যে ধরনের সাহিত্য গড়ে উঠছিল সেই পর্যায়টা বাংলা সাহিত্য সৌভাগ্যক্রমে হয়তো পেরিয়ে এসেছিল কিছুটা আগে। উনিশ শতকে এবং প্রধানত রবীন্দ্রনাথের সুকৃতিতে আমরা যেখানে গিয়ে পৌঁছেছিলাম,তাঁর সমকালীন ভারতীয় সাহিত্যের অন্যান্য রথীরা সেখানে গিয়ে তখনো পৌঁছতে পারেননি। এখানে আরো একটা কথা আমাদের মনে রাখা দরকার। যে সারা ভারতবর্ষে যেমন বিদেশেও অনেকখানি, রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হয়েছিল কিন্তু ‘গীতাঞ্জলি’র মাধ্যমে। অর্থাৎ তিন স্বতন্ত্র রবীন্দ্রনাথকে আমরা ভারতীয় সাহিত্যে খুঁজে পাব। একজন স্বদেশভাবুক রবীন্দ্রনাথ, অন্যজন কবি রবীন্দ্রনাথ, আর একজন ধ্যানী রবীন্দ্রনাথ। বিশেষ করে আমি তিনজনের কথা বলব। প্রথম, তামিল কবি সুব্রহ্মনিয়ম ভারতীয় কথা। যিনি ‘কবি রবীন্দ্রনাথ দিগবিজয়’ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। দ্বিতীয়, মলায়ালম কবি কুমারন আসানের কথা, যিনি ‘চন্ডালবিক্ষুণী’ লিখেছিলেন, আর তৃতীয়, উমাশঙ্কর, যোশীর কথা। যিনি রবীন্দ্রনাথের চিত্রকল্প নিয়ে ভারতীয়তার ধ্যানমূর্তির চিন্তায় বিভোর হয়েছিলেন। ঠিক একইভাবে আমি বলব যে, রবীন্দ্রনাথ যা লিখেছিলেন-তাঁর আখ্যান, গল্প, উপন্যাস এবং নতুন ধরনের কাহিনী, তাঁর নাটক, এমনকী আমি বলব তাঁর গান, অনুবাদÑএ-ও হয়ে উঠেছিল অন্যরকম। একটু লক্ষ করলেই দেখতে পাব যে রবীন্দ্রনাথ যে উপন্যাস লিখলেন তা কিন্তু ভিক্টোরিয় উপন্যাসের পথে গেল না অথবা ভার্জিনিয়া উলফ যেমন বলেছিলেন যে ১৯১০ বা তার কাছাকাছি এসে মানুষের চরিত্র পাল্টে গেল, তেমনটিও ঠিক নয়। পালটাল, আমাদের পক্ষে অবশ্যই পাল্টাল। ১৯১০-ও আমাদের পক্ষে অসামান্য বই, একই লেখকের দুটি বই। ‘গীতাঞ্জলি’ আর ‘গোরা’। কিন্তু অন্যভাবে পাল্টে দিল আমাদের আত্মপরিচয় এবং এ-ও আবার কাকতাল হলেও মনে করতে ভাল লাগে, ‘গোরা’র বিষয় ছিল আত্মানুসন্ধান, আর স্বদেশানুসন্ধান। ‘গীতাঞ্জলি’ও কি তাই নয়? আর এই ‘গীতাঞ্জলি’ নিয়ে তাঁর যে-অনুবাদকর্ম শুরু হল, সেই অনুবাদকর্মে তিনি বেছে নিলেন এক ভাষা, যে ভাষা-তখনকার ইংরেজি সাহিত্যের ভাষা নয়। এ-কথা মনে করার কোনো কারণ নেই, রবীন্দ্রনাথের অজানা ছিল সেই ভাষা। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি এমন ভাষায় ফিরে যাচ্ছেন যে ভাষা আবার ঠিক ডন, ব্লেক বা ওয়ার্ডসওয়ার্থ অথবা বার্নসের ভাষাও নয়, এবং আমি বলব এই ভাষাও কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা। টমসন যে বলেছিলেন, যে তাঁর রুচিটা ব্রাউনিং বা টেনিসনের মতো, জন্মেছিলেন বা এসে পড়েছিলেন। এলিয়ট-পাউন্ডের যুগে, এটাই হয়েছিল তাঁর বিপদ : এ-বিচার কিন্তু আমার ঠিক মনে হয় না ওই জন্যেই। আমার মনে হয়, এ শুধু জন্মের আকস্মিকতা নয়, এ তাঁর নির্বাচন। আরো স্পষ্ট হবে, যদি আমরা লক্ষ করি নাটক; পাশাপাশি তখন বাংলা নাটকে কী হচ্ছে। সেই যুগ গিরিশ ঘোষের যুগ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের যুগ, ক্ষীরোদপ্রসাদের যুগ। কিন্তু তখনই মাত্র দুটো নাটকের অতৃপ্তি নিয়ে আমরা জানি যে ‘রাজা ও রাণী’ লিখে তিনি তৃপ্ত হননি, তাঁকে বারবর ভাঙতে হয়েছিল নাট্যবন্ধন। আমাদের অজানা নয়, ‘বিসর্জন’ প্রকাশিত হবার পরেও প্রায় প্রতিটি সংস্করণের সুযোগ নিচ্ছিলেন তিনি পরিবর্তনের। অর্থাৎ শেক্সপিয়রীয় এই নাট্যধারা তাঁর পছন্দ হল না। ‘শারোদৎসব’ (১৯০৮) থেকে তিনি পেয়েছিলেন একটা নিজের ধারা। যে ধারা সম্পূর্ণভাবে ইউরোপের নয়, ভারতেরও সম্পূর্ণ নয়। আমরা ১৯১২ সালে ভাসের আবিষ্কার লক্ষ করলাম পরম বিস্ময়ে। কিন্তু ভাস, ভবভূতি, এমনকী কালিদাস, কারো নাট্যগৌরবেই আমরা মিলিয়ে নিতে পারলাম না রবীন্দ্রনাথকে। আমি বলব, এখানেও রবীন্দ্রনাথ সন্ধান করছিলেন একটা বিকল্পের। অর্থাৎ তাঁর সাহিত্য, তাঁর প্রতিষ্ঠান এইসবের মধ্যেই একটা বিকল্পের সন্ধান ছিল রবীন্দ্র-জীবনে।
ভাবতে অবাক লাগে, যাঁরা উত্তর-ঔপনিবেশিক, বর্তমান ভারতবর্ষে তাঁরাও কিন্তু ভাবছেন এই বিকল্পের কথা। আমাদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে অজ্ঞেয়র সেই বিখ্যাত বই ঞযব ঝবহংব ড়ভ ঞরসব। সেখানে তিনি এক নতুন সময়ের কথা বলছেন, যে-সময় ইউরোপের মতো খন্ডকালসীমার মধ্যে বদ্ধ নয়, যে-সময় ভারতীয় সময়ের মতো দু-দিকেই সীমাহীন নয়। তখন কিন্তু আমাদের মনে হয়, এই সময়ের কথাই কি বলেননি রবীন্দ্রনাথ ‘ডাকঘর’ নাটকে? তাঁর ‘সময়ের দেশে’র ভাবনায়? এই সময় কি বরবার ফিরে আসে না ঘন্টা বাজানোয়, যেখানে ঘন্টা থেকে বাইরে একটা নিরবধিকালের কথা বলেন তিনি। কিন্তু সে-নিরবধিকাল ভবভূতির নয় এবং সেখানে তাঁর কোনো সমানধর্ম নেই। আমাদের মনে পড়বে যে গিরিশ করনাড আমাদের যুগে বসে ঠিক সেই রকমই নাটক লেখার কথা ভাবছেন। তাঁর ‘তারদন্ডে’ তিনি ফিরে যেতে চাইছেন এমন একজন কবির কাছে, বাসবান্নার কাছে, দ্বাদশ শতকের কন্নড় বীরশৈব বাসবান্না, যিনি একটা রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী, যিনি ভক্ত, যিনি সেনাপতি, এমন একজন কবি। এর পাশে কি মনে পড়বে না, যদি ‘রক্তকল্যাণ’ পড়ি, তাহলে রবীন্দ্র-নাটকের সেই অংশ যেখানে সৈনিকের সঙ্গে কথোপকথন হয় কবির:
সৈনিক : তুমি তো লম্বা উপদেশ দিয়ে গেলে, ওদিকে যে লাগল আগুন।
কবি ঃ যুগাবসানে লাগেই তো আগুন। যা ছাই হবার তাই ছাই হয়, যা টিকে যায় তাই নিয়ে সৃষ্টি হয় নবযুগের।
সৈনিক ঃ তুমি কী করবে কবি?
কবি ঃ আমি তাল রেখে রেখে গান গাব।
সৈনিক ঃ কী হবে তার ফল?
কবি ঃ যারা টানছে রথ তারা পা ফেলবে তালে তালে। পা যখন হয় বেতালা তখন ক্ষুদে ক্ষুদে খানাখন্দগুলো মারমূর্তি ধরে মাতালের কাছে রাজপথও হয়ে ওঠে বন্ধুর।
আমাদের চিনতে অসুবিধে হয় না এ ‘রথের রশি’র (১৯৩২) একটা সংলাপচূর্ণ। তাহলে এই রকম একজন কবির কথা ভাবছেন রবীন্দ্রনাথ। ইনি কবি, যিনি শুধুমাত্র রোমান্টিকদের গজদন্তমিনারবাসী কবি নন। প্রথম পর্বে, যেমন রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন, ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মতো, যিনি পৃথিবীর প্রতিবেশিনীর মেয়ের সন্ধানে আছেন, নিরুদ্দেশ যাত্রায় চলেছেন, তিনি নন। আরো এক কবি, যিনি আগুনের মধ্যে তাঁর গান গান। তাহলে গিরিশ করনাডও ভাবছেন এমনই একজন কবির কথা। আমাদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে কুরাতুলেইন হায়দারের উপন্যাস ‘আগুনের নদী’র কথা। শুধু নামের বৈপরীত্যের জন্যই নয়, এক পায় আপন-হানা খেলায় মাতাল মনুষদের কথা বলেছেন কুরাতুলেইন। আর বলছেন এমন একটা আখ্যানে, যে-আখ্যানটা সম্পূর্ণভাবে প্রাচ্য বা প্রতীচ্য আখ্যানরীতির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবার স্পর্ধা দেখাচ্ছে। অথবা মনে পড়বে এ. কে. রামানুজনের কথা, যনি সংগ্রহ করছেন ঋড়ষশ ঞধষবং ড় ওহফরধ, যাঁর মনে হচ্ছে, এই লোককথার গল্পগুলের মধ্যে আছে আমাদের সাহিত্যের প্রাণভ্রমরা এবং এই কাজ করেছেন রামানুজন তাঁর জীবেনর শেষ দু-বছরে, যে-বই প্রকাশিত হয়েছে মাত্র গত বছর। রবীন্দ্রনাথ কি করেন নি সেই কাজ আরো-আরো কয়েক দশক আগে? রবীন্দ্রনাথ কি ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘মেয়েলি ব্রত’ লেখবার উৎসাহ দিচ্ছেন না, রবীন্দ্রনাথ কি ‘ছেলেভুলানো’ ছড়া সংকলন করছেন না? তাহলে কেন হচ্ছে এমন ? উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষ যা করতে চাইছে, তার সাহিত্য যা করবার স্বপ্ন দেখছে, একজন ঔপনিবেশিক পর্বে বসেই সেই কাজ শুরু করেছিলেন, অনেকখানি সমাধাও করেছিলেন। এ-কথা ঠিক তার বানচভঙ্গি পালটে গেছে আজ। যেমনভাবে কোনো বাচন বা ভাষাভঙ্গী পালটে যায় দশকে-দশকে। ‘বিশ বছরে সংঘ ভেঙ্গে যায়।’ ঠিক তেমনিভাবে হয়তো তার আক্ষরিক বাচনভঙ্গীটা পালটে গেছে আজ। কিন্তু তার সত্যের কি কোনো অপলাপ হয়েছে? এই প্রশ্ন বহুদিন আগে তুলেছিলেন, ভারতীয় সাহিত্যের ক্ষেত্রে, আবু সয়ীদ আইয়ুব, তাঁর চড়বঃৎু ড়ভ ঞৎঁঃয বইয়ে। এই একই প্রসঙ্গ তুলেছিলেন মাইকেল হামবুর্গর পাশ্চাত্য সাহিত্যের পটভূমিকায়, তাঁর ঞৎঁঃয ড়ভ চড়বৎঃু বইয়ে এবং রবীন্দ্রনাথের ‘সাহিত্যের সত্য’ আমাদের কি তাত্ত্বিকভাবে সেইদিকেই পথ দেখায় না? তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে যা ঘটেছে তার অনেকটাই আমরা পেয়ে গেছি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে স্বীকার করে নিতে কোথাও আমাদের দ্বিধা। কেন হচ্ছে এমনটা?
এই বিচ্ছেদ অকস্মাৎ ঘটেছে তা নয়, আমরা কিন্তু জানবার চেষ্টা করিনি অন্য প্রদেশ কী ভেবেছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। এ-কথা আমাদের শান্ত মনে মেনে নিতেই হবে যে একটি আপতিক ঘটনার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় গড়ে উঠেছিল ভারতবর্ষে এবং ভারতবর্ষের বাইরে, সেটি নোবেল পুরস্কার। বাঙালি তাকে যতই সরিয়ে রাখতে চাক, বাঙালির কাছে যতই অকিঞ্চিৎকর হোক এই ঘটনা, সরা পৃথিবীতে তাঁকে পরিচিত করেছিল এই পুরস্কার এবং একটি বই ‘গীতাঞ্জলি’। আজও পর্যন্ত বহু ভারতীয় এবং বিশ্বের ভাষায় রবীন্দ্রনাথের একমাত্র অনুদিত বই ‘গীতাঞ্জলি’। কেন হল এমনটা? অথবা আজকে যদি কেউ প্রশ্ন করেন, নোবেল পুরস্কার পাবার পর কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ভারতবর্ষের প্রান্ত-প্রত্যন্তে, তার কোনো শুমারি, কোনো পরিসংখ্যান নেই আমাদের কাছে। তার সংকলন জানা নেই আমাদের। অথচ বন্ধুদের সুবাদে যতদূর জানি, মারাঠি ভাষায় ভালচন্দ্র নেমাড়ে, বিখ্যাত ঔপন্যাসিক, মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গুরুদেব ঠাকুর বলেছেন, গুজরাটি ভাষার বিখ্যাত অনুবাদক ভেলাভাই প্যাটেল বলেছেন, তামিল ভাষার বিখ্যাত অনুবাদক অশোকমিত্রণ বলেছেন, আইয়াপ্পা পানিক্কর, মালয়লাম কবি, বলেছেন যে, এই প্রত্যেকটি ভাষা থেকে এক-একটা সংকলন হতে পারে যেখানে কীভাবে তাঁরা গ্রহণ করেছেন রবীন্দ্রনাথকে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ, সাহিত্যিক পতিগ্রহণ পর্যন্ত এক ইতিহাস তৈরি হয়ে উঠতে পারে আমাদের সামনে। তাহলে আজ রবীন্দ্রনাথ যখন অনেকটা প্রয়োজনহীন মনে হচ্ছেন অন্য ভারতীয়দের কাছে, সেখানেও ঘটেছে একটা অপরিচয়ের তাচ্ছিল্য, আর সেই তাচ্ছিল্যের জন্য দায়ী কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নন, দায়ী আমরা, দায়ী তাঁর স্বভাষী। রবীন্দ্রনাথ যখন অভিমানভরে বলেছিলেন, আমার কবিতা পড়তে হলে কাউকে পড়তে হবে আমারই ভাষায়, সে-যুগ থেকে আমরা সরে এসেছি। যে-অভিমান তাঁর করা শোভা পেত, সে-অভিমান কি আমরা করতে পারি?
পশ্চিমবঙ্গের বাইরে, বিশেষ করে দিল্লির ছাত্র সমাজে বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীদের পরিচয় দেওয় হয় এই নামে।
১. বিক্রম শেঠ, এ স্যুটেবল বয় (নিউ দিল্লী : ভাইকিং ১৯৯৩) পৃ. ৪১১।
২. সম্পাদকীয় ঃ আনন্দবাজার পত্রিকা। ২৩ জুলাই ১৯৯৫।
৩. ইউ আর অনন্তমূর্তি, ‘সংস্কার’ উপন্যাসের লেখক।
৪. ‘রবীন্দ্রমাফিয়া’, রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৭শে ১৯৯৫।
0 comments:
Post a Comment