Monday, April 25, 2016

কবিতার পুনর্জন্ম

কবিতার পুনর্জন্ম
আলী ফোরকান
কবিতার তর্জমা যে অসম্ভব সে-বিষয়ে বোধকরি সকলেই একমত। শেলির বিখ্যাত উক্তিটিকে আলোচ্য প্রসঙ্গে মোক্ষম বলেই ধরে নিতে পারি :
ঐবহপব ঃযব াধহরঃু ড়ভ ঃৎধহংষধঃরড়হং; রঃ বিৎব ধং রিংব ঃড় পধংঃ ধ ারড়ষবঃ রহঃড় ঃযব পৎঁপরনষব ঃযধঃ ুড়ঁ সরমযঃ ফরংপড়াবৎ ঃযব ভড়ৎসধষ ঢ়ৎরহপরঢ়ষব ড়ভ রঃং পড়ষড়ঁৎ ধহফ ড়ফড়ঁৎ, ধং ংববশ ঃড় ঃৎধহংভঁংব ভৎড়স ড়হব ষধহমঁধমব রহঃড় ধহড়ঃযবৎ ঃযব পৎবধঃরড়হং ড়ভ ধ ঢ়ড়বঃ. ঞযব ঢ়ষধহঃ সঁংঃ ংঢ়ৎরহম ধমধরহ ভৎড়স রঃং ংববফ, ড়ৎ রঃ রিষষ নবধৎ হড় ভষড়বিৎ-ধহফ ঃযরং রং ঃযব নঁৎঃযবহ ড়ভ ঃযব পঁৎংব ড়ভ ইধনবষ.’
কবির সৃষ্টিকে যে এক ভাষা থেকে আর এক ভাষায় চালান করা যায় তা তার কারণ, কবিতা হল অর্থ এবং ধ্বনির সমন্বয় এবং সেই জন্যই যদি বা অর্থকে ভাষান্তরে রক্ষা করা সম্ভব হয়, ধ্বনি যে শুধুমাত্র বাদ পড়ে যায় তাই নয়, ভাষান্তরে ভিন্ন ধ্বনিপুঞ্জ তার স্থান জবরদখল করে বসে। ফলে ধ্বনির বদলের সঙ্গে সঙ্গে রূপের এবং রসের বিনাশ বা বদল হয়। রূপ বাদ গেলে কবিতার যা বাকি থাকে তাকে মোটামুটি অর্থের একটা ঢ়ধৎধঢ়যৎধংব বলা চলে এবং তার পক্ষে কাব্যপদবাচ্য বলে স্বীকৃত হওয় এরকম অসম্ভবই বলা যায়। বিরলক্ষেত্রে সেই ভাষান্তরে কখনো কখনো কবিতা হয়ে ওঠে কিন্তু সে-ক্ষেত্রে, শেলি যেমন বলেছেন, ‘ঃযব ঢ়ষধহঃ সঁংঃ ংঢ়ৎরহম ধমধরহ ভৎড়স রঃং ংববফ’, অর্থাৎ মূল কবিতার রস-বীজ থেকে তাকে নতুন করে জন্মগ্রহণ করতে হবে। এমন ক্ষেত্রে এই নবজাত বা পুনর্জাত কবিতা কবিতা হবে বটে, কিন্তু রূপ হবে ভিন্ন অর্থাৎ সেটি হবে একটি নতুন কবিতা, মূল কবিতার সঙ্গে তার ভাবের যোগ থাকলেও রূপের স্বকীয়তায় সে হবে স্বতন্ত্র।
শেলির এই মত অবশ্যই শিরোধার্য। কিন্তু দেখা যায় প্রাচীন কাল থেকে অদ্যবধি অনুবাদ কার্যে কবি, মহাকবি, অ-কবি বা কু-কবি কারো উৎসাহের অভাব নেই। এমনকী স্বয়ং শেলি গ্রীক, স্প্যানিশ, জার্মান প্রভৃতি ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন। যথার্থ কবিকৃত তর্জমার পরিমাণ কম নয়, তার মধ্যে আবার কিছু কিছু খ্যাতিও অর্জন করেছে। এ-যুদের কয়েকটি অনুবাদ মনে পড়ছে: সেলিল লুইস কৃত ভার্জিলের এবড়ৎমরপড়, লুইস ম্যাকমিনসের ঋধঁংঃ, রয় ক্যাম্পবেলের ‘সান হুয়ান দে লা ক্রুথ’্ এর কাব্যনুবাদ ইত্যাদি। তা ছাড়া সমসায়িক কবিদের রচনার প্রতি আগ্রহের নিদর্শন-স্বরূপ যথার্থ কবিকৃত কিছু অনুবাদ চোখে পড়ে যেমন, এলিয়ট অনুবাদ করেছেন সাঁ জঁ প্যর্সের কবিতা; এলিয়টের কবিতা অনুবাদ করেছেন সাঁ জঁ প্যর্স, হিমেনেথ্ এবং রবীন্দ্রনাথ; রবীন্দ্রনাথের কবিাত অনুবাদ করেছেন আঁদ্রে জীদ্, হিমেনেথ্, রেনে ব্রিমঁ, নেরুদা, সেসিলিয়া মেয়র্লিস,; জীদের এবং ভালেরির কবিতা অনুবাদ করেছেন রিলকে; রিলকের কবিতা অনুবাদ করেছেন স্টীভন স্পেন্ডার ইত্যাদি। এÑছাড়া অ-কবি বা কু-কবিদের পরিশ্রমের ফল তো জমে উঠেছে পর্বত প্রমাণ। এই সব অনুবাদের মধ্যে শেলির আদর্শ অনুযায়ী ‘পুনর্জাত’ কবিতার সংখ্যা কত সেটা একটা সমীক্ষার বিষয়। তবে বিষয়টা নিয়ে রীতিমতো গবেষণায় প্রবৃত্ত না হয়েও স্বচ্ছন্দে বলা চলে যে সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে বাকি প্রায় সবই হল যাকে বলে চলনসই অর্থাৎ কিছুটা ব্যবহারিক প্রয়োজনে লাগলেও কবিতা হিসেবে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠার দাবি খুব কম অনূদিত কবিতাই করতে পারে। সেই সঙ্গে স্বীকার করতে হয় যে অনুবাদযোগ্য কাব্যের তালিকা থেকে লিরিক কবিতা পূর্বাহ্নেই বাদ দেওয়া উচিত। কারণ লিরিক কবিতার কাব্যরূপ ধ্বনিব্যঞ্জনার যে সূক্ষ্ম ঊর্ণাজালের বিন্যাসে গড়ে ওঠে, ভাষান্তরে তা কোনোমতেই টিকতে পারে না। সেইজন্য লিরিক কবিতার আস্বাদ গ্রহণ করতে হলে মূল কবিতার দ্বারস্থ হওয় ছাড়া গত্যন্তর নেই। তাই দেখা যায় শেক্সপীয়র, মিলটন, ভার্জিল ইত্যাদির অনুবাদ ইউরোপের নানাভাষায় হয়ে থাকলেও, শেলি, কীট্স য়ুগো বা ডনের সুষ্ঠু, এমনকী, গ্রহণযোগ্য অনুবাদও চোখে পড়ে না। দান্তের ভিভিনা কমোডিয়া-র গদ্যে পদ্যে প্রচুর অনুবাদ হয়েছে কিন্তু তাঁর রচনাবলীতে ‘কানাজোনিয়েরে’ নামক যে একগুচ্ছ লিরিক কবিতা আছে আজ পর্যন্ত তার অনুবাদে বিশেষ কেউ অগ্রণী হননি। একই কারণে রবীন্দ্রনাথের লিরিক কবিতা এবং গানগুলি অনুবাদকের নাগালের বাইরে।
কাব্যানুসারে প্রস্তাবটিই সমস্যাকন্টাকির্ণ, কিন্তু কবি স্বয়ং যখন তাঁর কবিতার ভাষান্তর করতে বসেন তখন একটি নূতন সমস্যার উদ্ভব হয়। প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে কোনো কবির পক্ষে, কবি হিসেবে, দ্বিভাষিক বা বহুভাষিক হওয়া কি সম্ভব? মাতৃভাষা ছাড়াও অপর কোন এক বা একাধিক ভাষায় কাব্যসৃষ্টির ক্ষমতা যে কবির পক্ষে স্বাভাবিক বা সুলভ নয় এবং তার দৃষ্টান্তও যে বিরল তা সকলেই স্বীকার করবেন। অত্যন্ত বিরল ক্ষেত্রে বিশেষ ঘটনচক্রে দেখা যায় কোনো কবির মাতৃভাষা একটি নয় দুটি। সে-ক্ষেত্রে কবির পক্ষে দুটি ভাষাতেই কাব্যসৃষ্টি সম্ভব, যেমন এরেদিয়া করেছেন এবং তার ফলে ফরাসি এবং ইস্পানি দুটি ভাষার কাব্য-ক্ষেত্রেই তার আসন সুনির্দিষ্ট। তাছাড়া, বিদেশী ভাষার অনুশীলনের সূত্রেও কোনো কোনো কবি লীলাচ্ছলে অপর ভাষায় কবিতা লিখেছেন কখনো কখনো, যেমন দান্তে লিখেছেন ল্যাটিন ভাষায়, মিলটন, লিখেছেন ল্যাটিন এবং ইতালীয় ভাষায়, গ্যেটে তরুণ বয়সে লিখেছেন ইংরেজিতে। কিন্তু এই জাতীয় রচনা পূর্বোক্ত কবিদের স্বভাষায় রচিত কাব্যের নু-ঢ়ৎড়ফঁপঃ হিসেবেই গণ্য এবং এগুলির সঙ্গে তাঁদের কবিখ্যাতির কিছুমাত্র যোগ নেই। কিন্তু রিলকে ফরাসি ভাষায় যে তিনটি কাব্যপুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন সেগুলিকে পূর্বোক্ত নু-ঢ়ৎড়ফঁপঃ এর শ্রেণীতে ফেলা যায় না, যদিও রিলকের কাব্যখ্যাতি তাঁর ফরসি কবিতার উপর আদৌ নির্ভরশীল নয়। এই সূত্রে রবীন্দ্রনাথ-রচিত ইংরেজি কবিতাগুলির কথা স্বতঃই মনে পড়বে। রিলকের ফরাসি কবিতার মতেই এগুলিকে ওই নু-ঢ়ৎড়ফঁপঃ এর দলে ফেলা চলে না, যদিও রিলকের ফরাসি কবিতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এই ইংরেজি রচনাগুলির একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। রিলকের কবিতাগুলি কোথাও বিশেষ লক্ষ্যগোচরই হয়নি, অপর পক্ষে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বখ্যাতি মুখ্যত এই ইংরেজি রচনাগুলির উপরেই প্রতিষ্ঠিত। এগুলি কি অনুবাদ? অনূদিত কবিতা সারা বিশ্বকে অধিকার করেছে এমন দৃষ্টান্ত কি কোথাও আছে? এ-কথা অবশ্য অস্বীকার করবার উপায় নেই যে গীতাঞ্জলি, দি গার্ডনার প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থগুলির টাইটল পেজ্- এ ‘ঃৎধহংষধঃবফ নু ঃযব ধঁঃযড়ৎ ভৎড়স ঃযব ড়ৎরমরহধষ ইবহমধষর’, এই বিজ্ঞপ্তিটি সন্নিবিষ্ট আছে। সেই জন্যই সাধারণ্যে এই কবিতাগুলি অনুবাদ বলেই প্রচলিত। এবং ওই শব্দটির সুযোগ নিয়ে এডোয়ার্ড টমসন্ একদা রবীন্দ্রনাথকে কিছু ‘উপদেশ’-ও দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, মূল কবিতা ছেঁটে-কেটে বাদ দিয়ে, জল মিশিয়ে কবি ইংরেজিতে যা লিখেছেন তা একধরনের ঢ়ৎবপরং হয়েছে। খাঁটি অনুবাদ হয়নি। তিনি আশ্বাসও দিয়েছিলেন, খাঁটি অনুবাদ কাকে বলে তা তিনি দেখিয়ে দেবেন এবং তার ফলে ‘ও ধস মড়রহম ঃড় ৎবাড়ষঁঃরড়হরংব ঃযব বিংঃবৎহ হধরড়হ ড়ভ ুড়ঁ ধং ধ ঢ়ড়বঃ’! টম্সন্ তাঁর খাঁটি অনুবাদ প্রকাশও করেছিলেন কিন্তু তাঁর সেই অনুবাদ কতদূর ‘খাঁটি’ হয়েছে সে-আলোচনা বাহুল্যমাত্র। যেহেতু সেগুলি আদপে কবিতাই হয়নি। প্রায় চল্লিশ বছর পরে দেখা যায় বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি রচনার সমালোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন (কবি রবীন্দ্রনাথ, ১৯৬৬ দ্রষ্টব্য) তাঁর আলোচ্য বিষয় হল : ‘রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ কতদূর ভালো বা ভালো নয়’। অতঃপর তিনি যে আলোচনাটি করেছেন সেটা মূলতঃ টমসনেরই প্রতিধ্বনি। বুদ্ধদেব বসু যে কালিদাসের কাব্যলোচনায় দিঙনাগকেই যোগ্য পথপ্রদর্শক স্থির করেছিলেন সেটা অবশ্যই বিস্ময়কর। দেখা যায়, তাঁরও খাঁটি অনুবাদের আদর্শ হল আক্ষরিক অনুবাদ এবং সারা প্রবন্ধটিতে তাঁর আলোচ্য বিষয় এবং মন্তব্যের লক্ষ্য হল মূলের ভাব-পরিবর্তন, অংশ-বর্জন, নূতন উপমা-চিত্রকল্পের সংযোজন এবং সর্বোপরি ‘ইংরেজিয়ানা’। ইংরেজি ক্লাসে মাস্টারমশাই ছাত্রের অনুবাদ যে-ভাবে সংশোধন বা আলোচনা করেন সমালোচনার ভঙ্গিটা অনেকটাই সেইরকম। বিশেষতঃ ‘ইংরেজিয়ানা’ সম্বন্ধে তাঁর অসন্তোষটা উপভোগ্য বটে; যিনি তাঁর নিজের বাংলা রচনায় ‘বিহঙ্গদৃষ্টি, ‘অসেতুসম্ভব’ প্রভৃতি আমদানি-করা শব্দের বিচিত্র ইংরেজিয়ানার দ্বারা পাঠক-সমাজে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন, তিনিই যে রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি রচনায় ইংরেজিয়ানার গন্ধ পেয়ে বিচলিত হচ্ছেন সেটা অবশ্যই বিস্ময়কর এবং কিঞ্চিৎ কৌতুকপ্রদ। যাই হোক, এই জাতীয় সমালোচনার মধ্যে যে জিনিসটা ধরা পড়ে তা হ’ল এই যে সারা বিশ্বে সমাদৃত এই ইংরেজি কবিতাগুলিই পূর্বোক্ত সমালোচকেরা কবিতা হিসেবে আস্বাদন করতে অক্ষম, নিছক তর্জমা হিসেবেই এগুলকে তেল করতে তাঁরা ব্যস্ত।
কিন্তু কাব্যের রস-রূপ সম্বন্ধে সচেতন পাঠকেরা কবির এই ইংরেজি রচনাগুলি পড়লেই বুঝতে পারবেন সরল গদ্যে রচিত এগুলি কবিতা,স্বরূপে এবং স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। মূলের সঙ্গে মেলালেও বুঝবেন, ভাষান্তরের সঙ্গে সঙ্গে এগুলির রূপের এবং রসের বদল হয়ে গেছে এবং তাদের সফলতার বা শ্রেষ্ঠতার মাপকাঠি মূল বাংলা কবিতার মধ্যে নেই, আছে তাদের নিজেদেরই রূপ-রসের মধ্যে।
তাছাড়া, টাইটল পেজ-ধৃত বিজ্ঞপ্তি সত্ত্বেও কবি স্বয়ং বরাবর একটা কথাই বলে এসেছেন : তাঁর ইংরেজি রচনাগুলি অনুবাদ নয়। ১৯১৩ সালেই অজিতকুমার চক্রবর্তীকে লেখা একটা চিঠিতে তিনি বলছেন : ‘আমি আজকাল যেভাবে তর্জমা করি তাতে তর্জমার মধ্যে মূলের চেহারা খুঁজে পাওয়া যায় না। আমার এগুলি প্রতিভাতি : প্রতিমূর্তি নয়।’ কবির এই উক্তির প্রতিধ্বনি শুনি অগণিত গ্রন্থ-সমালোচনার মধ্যে। কবি এডোয়ার্ড টমাসদি গার্ডনার-এর সমালোচনা-সূত্রে যা বলেছিলেন সেটাকে প্রতিনিধি-স্থানীয় বলা যায় : ‘ঃযবু (ঃযব ঢ়ড়বসং ড়ভ ঞযব এধৎবহফবৎ) ধৎব ঊহমষরংয ঢ়ড়বসং যিরপয যধাব ইবহমধষর ঢ়ৎড়ঃড়ঃুঢ়বং ৎধঃযবৎ ঃযধহ ঃৎধহংষধঃরড়হং’.। ১৯১৩ সালে সুইডিশ অ্যাকাডেশি রবীন্দ্রনাথের রচনা পরীক্ষা করবার জন্য যে বিশেষ কমিটি নিয়োগ করে তার অন্যতম সদস্যদ্বয়, ফের্ণের ফন্ হাইডেনস্টাম এবং পের হালস্ট্রয়েম্, তাঁদের পৃথক রিপোর্টে ঠিক এই কথাই বলেছিলেন।
তার ইংরেজি রচনাগুলি যে প্রচলিত অর্থে অনুবাদ নয় এ-কথা বলেই ক্ষান্ত হননি, সেই সঙ্গে তিনি এমন কয়েকটি মন্তব্য করেছেন যা কবিতার প্রকরণ-রহস্যের উপরেই আলোক-সম্পাত করে। ১৯১৮ সালে কেমব্রিজের অধ্যাপক জে ডি অ্যান্ডারসন-কে এক পত্রে তাঁর রচনা সম্বন্ধে কবি লেখেন : ‘ওহ ঊহমষরংয ঢ়ৎড়ংব ঃযবৎব রং ধ সধমরপ যিরপয ংববসং ঃড় ঃৎধহংসঁঃব সু ইবহমধষর াবৎংবং রহঃড় ংড়সবঃযরহম যিরপয ঃড় ড়ৎরমরহধষ ধমধরহ রহ ধ ফরভভবৎবহঃ সধহহবৎ. ঞযবৎবভড়ৎব রঃ হড়ঃ ড়হষু ংধঃরংভরবং নঁঃ মরাবং সব ফবষরমযঃ ঃড় ধংংরংঃ সু ঢ়ড়বসং রহ ঃযবরৎ ঊহমষরংয নরৎঃয.’। কিছু পূর্বে ১৯১৬ সালে আমেরিকা সফরকালে কোনো এক সাক্ষাৎপ্রার্থী মার্কিন রিপোর্টারকেও তিনি একই মর্মে আরও একটু বিশদ করেই বলেছিলেন :
ও রিংয ুড়ঁ সরমযঃ ৎবধফ রঃ (সু ঢ়ড়বঃৎু) রহ ঃযব ড়ৎরমরহধষ ইবহমধষর. গু ঊহমষরংয ঃৎধহংষধঃরড়হং ধৎব হড়ঃ ঃযব ংধসব. ঊধপয পড়ঁহঃৎু যধং রঃং ংুসনড়ষং ড়ভ বীঢ়ৎবংংরড়হ. ঝড়, যিবহ ও ঃৎধহংষধঃব সু ড়িৎশ ও ভরহফ হবি রসধমবং ধহফ ঢ়ৎবংবহঃষু হবি ঃযড়ঁমযঃং ধহফ ভরহধষষু রঃ রং ংড়সবঃযরহম ধষসড়ংঃ বহঃরৎবষু হব.ি ঞযব ভঁহফধসবহঃধষ রফবধ রং ঃযব ংধসব হঁঃ ঃযব ারংরড়হ পযধহমবং. অ ঢ়ড়বস পধহ হড়ঃ নব ঃৎধহংষধঃবফ, রঃ পধহ ড়হষু নব ৎব-ষরাবফ রহ ধ ফরভভবৎবহঃ ধঃসড়ংঢ়যবৎব.’
তাঁর হাতে অনুবাদ কেমন করে নূতন সৃষ্টিতে রূপান্তরিত হয়ে যায় সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনাসূত্রে কবি যা বললেন, তার মধ্যে কাব্যসৃষ্টিতে মিডিয়ামের ভূমিকা সম্বন্ধেই গভীর ইঙ্গিতের সন্ধান পাই। ভাষা শুধুমাত্র ভাবপ্রকাশের উপায় অথবা গড়নের হাতিয়ার নয়, উপরন্তু, কাব্যের বাচনিক উপাদানও বটে। সেইজন্য সৃষ্টি প্রকরণে ভাষার প্রভাব অসামান্য। ভাষা তার নিজের শক্তি ও মেজাজের দ্বারা কাব্যসৃষ্টির প্রবর্তনায় এবং নিয়ন্ত্রণে অনেকখানি দায়ী। ভালেরির মতো ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ কবিকেও স্বীকার করতে হয়েছে যে একটি মাত্র মিলের জবরদস্তিতে তাঁকে একটি গোটা কবিতার গড়ন সম্পূর্ণ পাল্টিয়ে দিতে হয়েছে। স্ব-ভাষায় যা সত্য ভিন্ন ভাষায় রূপান্তরের বেলায় তা আরো বেশি সত্য। কবির সঙ্গে এক ভাষায় যে বোঝাপড়াটা হয়েছিল, সেটা পরিত্যাগ করে তাঁকে আবার নতুন করে আর এক ভাষার দাবি-দাওয়ার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হয় এবং তারই ফলে যে কবিতার জন্ম হয় তার রূপরস স্বতন্ত্র হতে বাধ্য। তাছাড়া, কবি যে বলেছেন, ‘অ ঢ়ড়বস পধহহড়ঃ নব ঃৎধহংষধঃবফ, রঃ পধহ ড়হষু নবৎব-ষরাবফ রহ ধ ফরভভবৎবহঃ ধঃসড়ংঢ়যবৎব’, তার মধ্যেও নতুন সৃষ্টি-প্রেরণার ইঙ্গিত উহ্য আছে। এ-যুগে রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত অপর যে কজন মাত্র দ্বিভাষিক কবিকে আমরা জানি, সেই রিলকেও ঠিক একই অভিজ্ঞতার কথাই বলেছেন। বান্ধবী লু আন্ড্রেয়াস সালোমে-কে রিল্কে একটি চিঠিতে লিখেছেন :
ঝড়সবঃরসবং ও ঃড়ড়শ ঁঢ় ঃযব ংধসব ঃযবসব রহ ঋৎবহপয ধহফ এবৎসধহ ধহফ রঃ ঃযবহ, ঃড় সু ংঁৎঢ়ৎরংব, ফবাবষড়ঢ়বফ ফরভভবৎবহঃষু রহ নড়ঃয ষধহমঁধমবং : যিরপয ফড়বং সঁপয ঃড় নবষরব ঃযব হধঃঁৎধষহবংং ড়ভ ঃৎধহংষধঃরহম.’
এইভাবে কবিতায় যে রূপান্তর এবং রসান্তর ঘটে তারই ফলে অনেক সময় অনিবার্যভাবেই কাব্যগুণেরও তারতম্য দেখা দেয়। রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি রচনাগুলিতে তার অজস্র দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে। স্থানাভাব বশত এখানে দুটির উল্লেখই যথেষ্ট হবে।
বাবলা শাখারে বলে আম্রশাখা, ভাই
উনানে পুড়িয়া তুমি কেন হও ছাই?
হায় হায়, সখী, তব ভাগ্য কী কঠোর!
বাবলার শাখা বলে, দুঃখ নাহি মোর।
বাঁচিয়া সফল তুমি, ওগো চুতলতা,
নিজেরে করিয়া ভস্ম মোর সফলতা।
কণিকর অন্তর্গত এই ছটি লাইনের সঙ্গে ঝঃৎধু ইরৎফং- এর দুটি লাইনের তুলনা করা যেতে পারে :
ঞযব নঁৎহরহম ষড়ম নঁৎংঃং রহ ভষধসব ধহফ পৎরবং,
‘ঞযরং রং সু ভষড়বিৎ, সু ফবধঃয.’
প্রথমত ইংরেজি লাইনদুটিকে পূর্বোদ্ধৃত বাংলা ছয় লাইনের ভাষান্তর বলে অনেকেই চিনতে পারবেন না। পারলেও টনমসনের মতে গণিতের সাহায্যে বলবেন যে, যেহেতু ছয় লাইনের পদ্য দুই লাইনের ইংরেজি গদ্যে পরিণত হয়েছে, অতএব ওটা মূলের একটা ঢ়ৎবপরং ছাড়া আর কিছুই নয়। যাঁরা রসগ্রাহী তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে না যে ইংরেজি লাইনদুটি একটি নূতন কবিতা যদিও বাংলা পদ্যটি তার ঢ়ৎড়ঃড়-ঃুঢ়ব। তাছাড়া রূপান্তর এবং রসান্তর কতখানি হয়েছে সেটা খতিয়ে দেখলে তাঁরা বুঝবেন, যা ছিল আত্মত্যাগের মহিমা-বিষয়ক একটি উৎকৃষ্ট সুভাষিত, ইংরেজিতে সেটাই হয়েছে ঃৎধমরপ অভিজ্ঞতার মর্মস্থিত উত্তরণের উপর একটি অপরূপ কবিতা। বিশ্বের দু এক ছত্রের যত কবিতা আছে তার মধ্যে এটি শীর্ষস্থান পাবার যোগ্য। আরো একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করবো : চিত্রার ১৪০০ সাল (আজি হতে শতবর্ষ পরে) কবিতাটির সঙ্গে ঞযব এধৎফবহবৎ-এর শেষ কবিতাটি মিলিয়ে পড়লে দেখা যায় ৪০ লাইনের মূল বাংলা কবিতা ১৪ লাইনের ইংরেজি পদ্যে রূপান্তরিত হওয়ায় রূপের ও রসের এতই পরিবর্তন হয়েছে যে দুটিকে স্বতন্ত্র কবিতা না বলে উপায় নেই। তাছাড়া কবিতা হিসেবেও দুটিই অনবদ্য। দুটির মধ্যে যে পার্থক্য বর্তমান সেটা কবির বিখ্যাত উপমার যোগে সংজ্ঞা বন্ধ করা যায়। মূল কবিতাটি একটি ঝর্ণা, ইংরেজি রূপান্তরে সেটি যেন থমকে দাঁড়িয়ে সরোবর হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি কবিতার প্রসঙ্গে অনুবাদ কথাটি অনর্থক এবং বর্জনীয়। ফিরে যেতে হয় পুর্বোদ্ধৃত শেলির উক্তিতে ঃ ভাষান্তরে কবিতা অসম্ভব যদি না আদিম রস-বীজ থেকে তার নবজন্ম ঘটে। রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি কবিতা সেই পুনর্জাত কবিতা এবং সেই জন্যই তাঁর সুবিশাল রচনাচক্রে তাঁর এই ইংরেজি কবিতাগুলি একটি ক্ষুদ্র কিন্তু মহার্ঘ্য সংযোজন।
০১৭১১৫৭৯২৬৭

0 comments:

Post a Comment