Friday, April 29, 2016

মহান মে দিবস: খোদা আমাদের সহায় হোন

মহান মে দিবস: খোদা আমাদের সহায় হোন
আলী ফোরকান
১৮৮৬ সালের ১ মে। শিকাগোয় সংঘটিত ঘটনা ও পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে এই দিবসের উৎপত্তি। আট ঘণ্টার শ্রম দিবস, মজুরি বৃদ্ধি, কাজের উন্নততর পরিবেশ ইত্যাদি দাবিতে ১ মে একটি শ্রমিক সংগঠন শিল্প ধর্মঘটের ডাক দেয়। বর্বর পন্থায় সে ধর্মঘট দমন করা হয়। ৩ মে ধর্মঘটী শ্রমিকদের এক প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশের গুলিতে ৬ জন প্রাণ হারায়। এর ফলস্বরূপ পরদিন হে মার্কেটে শ্রমিকরা প্রতিবাদ সমাবেশে মিলিত হলে কারখানার মালিকরা সেখানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় এবং তাতে ৪ জন শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে। ধর্মঘট সংঘটিত করার দায়ে অগাস্ট স্পাইস নামে এক শ্রমিক নেতাকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয় (বাংলাপিডিয়া, অষ্টম খন্ড, পৃ. ৩৫৩)। সেই থেকে বিশ্বের শ্রমিকরা দিবসটি পালন করে আসছেন। তবে এটি পালনে নতুন মাত্রা যোগ হয় ১৯১৭ সালে মহান সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের পর দিনটি উদযাপনে কিছুটা ম্লান হয়ে আসে। তবুও এখন বলা চলে যে এটি যথার্থ আর্ন্তজাতিক শ্রম দিবস। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনার ভেতর দিয়ে দিবসটি পালিত হয়। এখন শুধু শোক নয়, কিছুটা বিজয় অর্জনের আনন্দ অনুভূত হয়। বেশ উৎসবমুখর দিনটি থাকে। রাশিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ভ¬াদিমির পুতিন কিছুদিন আগে বলেছিলেন যে ২০ শতকের অন্যতম বৃহৎ মানবিক বিপর্যয় হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। কথাটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ নয় কি? এটি অবশ্য আলাদাভাবে আলোচনার দাবি রাখে। সময়-সুযোগ এলে আলোচনা করা যাবে বৈকি। শিকাগোর সেই আন্দোলনের স্মরণে বিশ্বের শ্রমিক তথা মেহনতি মানুষরা দিনটি উদযাপন করে, সেটা ভালো কথা। তবে শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন, কৃষক নির্যাতন, শাসক কর্তৃক শোষিতের ওপর জুলুম ১৮৮৬ সালের ১ মে’র পূর্বেও ছিল, এখনো আছে। আমাদের দেশে ইংরেজ নীলকর সাহেবরা নীল চাষের জন্য কৃষকদের ওপর কি অত্যাচারই না চালিয়েছেন। দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ বইটি পড়লে বোঝা যায়। একইভাবে ছিল জমিদারদেরও অত্যাচার-উৎপীড়ন। একে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন জমিদার দর্পণ নামে একটি বই লিখেছেন। বাংলাকে কবি-সাহিত্যিকরা সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন সোনার বাংলা। জীবনানন্দ দাশ বলেছেন রূপসী বাংলার কথা। কিন্তু এই বাংলার ঘরে ঘরে এসেছে দুর্ভিক্ষ, মহামারী। ইংরেজরা দুর্ভিক্ষ কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে তার জন্য তৈরি করেছিলেন বেঙ্গল ফেমিন কোড। অবশ্য তারাও বহু দুর্ভিক্ষের সৃষ্টিকর্তা। আর সে জন্য সুকান্ত ভট্টাচার্য্যরে সেই বিখ্যাত পঙ্ক্তি ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’ ১৮৮৬ সালে শ্রমিকরা যেসব দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন, তা কি এখনো পূরণ হয়েছে। তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। খাতওয়ারি সর্বাধিক শ্রমিক এই শিল্পে কাজ করে থাকেন। এর ভেতর মহিলা শ্রমিক বেশি। এরা সকাল ৮টা থেকে অনেক সময় রাত ৮টা এমনকি ১০টা পর্যন্ত কাজ করে থাকেন। অবশ্য অতিরিক্ত মজুরি দেয়া হয় তবে তা কতোটা বিধিমোতাবেক, সে প্রশ্ন থেকে যায়। আগুনের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার অধিকার রয়েছে। এটা প্রতিষ্ঠিত করতে কয়েক ডজন পোশাক শিল্প শ্রমিককে আগুনে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে। ছোট কাঁচি কিংবা সুই-সুতা চুরি হবে, এই আশঙ্কায় কারখানার দরজা বন্ধ রেখে শ্রমিকদের পুড়িয়ে মারা হয়েছে। পোশাক শিল্প মালিকের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বিজিএমইএ অবশ্য এখন দাবি করছে যে শ্রমিকদের নিরাপত্তার এবং অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দেখা যাক। সময় সব বলে দেবে। কিছুদিন আগে জাপান গার্ডেন সিটির মতো একটি অভিজাত আবাসিক এলাকায় অগ্নিকান্ডে একটি গোটা পরিবার নারী-শিশুসহ পুড়ে মারা গেলো। স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী ঘটনাস্থলে গিয়ে ক্রটি-বিচ্যুতি দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে কী হয়েছে আর জানা যায়নি। কোনো দিন হয়তো জানা যাবেও না। কলকারখানা, আবাসন সর্বত্র অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা গ্রহণের কিছু নির্দেশ আছে। এর জন্য সরকারি দপ্তর রয়েছে। কিন্তু তাদের কাজকর্ম হলো দেখেও না দেখা। অর্থাৎ চোখ থাকিতে অন্ধ। একটা সিস্টেম তো আছে তাদেরকে নিষ্ক্রিয় রাখতে। তাহলো মাসোহারা বা বর্ষহারা। ভদ্দরলোকের চুক্তিতে সবকিছু ঠিকঠাকমতো চলছে। এবারে নির্মাণ শ্রমিকের কথায় আসা যাক। নির্মাণ শিল্পের অবস্থা এখন রমরমা। সেটাই স্বাভাবিক। উন্নয়নশীল দেশ আমাদের। বহুকিছু নির্মাণ করতে হবে। মাঝে মাঝে পত্রিকা মারফত জানা যায় যে সুউচ্চ ভবন থেকে পড়ে গিয়ে শ্রমিকদের মৃত্যু। এটুকু খবরই শেষ। কোথায় কোন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসেছে। সেনা সমর্থিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে র‌্যাংকস ভবন ভাঙা হলো। দুর্ঘটনায় কয়েক শ্রমিক মারা গেলেন। একজন শ্রমিকের লাশ সপ্তাহখানেক ভবনে ঝুললো। কেমন লেগেছিল তার নিকট আত্মীয়দের। সেই সঙ্গে আমরা সংশ্লি¬ষ্ট প্রকৌশলীদের দক্ষতার পরিচয় পেলাম। একটি ভূমিকম্পে ঢাকা শহরের ভবনে সবাইকে এভাবেই বোধহয় ঝুলতে হবে। খোদা আমাদের সহায় হোন, এই মোনাজাত করি। আমাদের কৃষি শ্রমিকদের কথা না বলাই ভালো। কয়েকটি সংগঠন আছে। তবে তাদের প্রধানরা শহরে থাকেন এবং দলীয় রাজনীতির লেজুরবৃত্তি করেন। সংগঠনের পদটি ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার সুবিধা হয়। কৃষিঋণ মওকুফ করতে সরকারের কষ্ট হয়। অথচ জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ অবদান তাদের। এই যে বর্তমানে আকস্মিক বন্যায় বেশ কিছুসংখ্যক কৃষকের ফসল সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে গেছে। এর বিপরীতে ঋণ নেয়া হয়ে থাকলে তা শোধ করা সম্ভব নয়। আর ব্যাপারটা একশতভাগ সত্য। এখন প্রয়োজন এই ঋণ মওকুফ করে নতুন ঋণ দেয়া। কেননা এরা পণ্য উৎপাদন করে জিডিপি বাড়াবেন। এরা তো ঋণের টাকা দিয়ে বিলাসবহুল গাড়ি কিনে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক ভ্রমণ করেননি। অর্থ মন্ত্রণালয় তা সহজে করতে নারাজ। তারা বহুজাতিক কোম্পানির করপোরেট ট্যাক্স কমাতে রাজি, কেননা তারা কিঞ্চিৎ শেয়ার বাজারে ছাড়বে। এই ছাড় দেয়া করপোরেট ট্যাক্সের বিপরীতে জনগণের কী লাভ। এদিকে রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান কসম খেয়ে বলেছেন যে পুঁজি বৃদ্ধির ওপর কোনো কর আরোপ করা হবে না।
অন্যরা আয় করলে যদি কর দিতে হয়, তাহলে এরা দেবে না কেন। হয়তো একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত ছাড় দেয়া যেতে পারে। অথবা এরকম শর্ত দেয়া যেতে পারে যে টাকাটা কমপক্ষে ১ বছরের শেয়ার বাজারে রেখে পূর্ণবিনিয়োগ করলে এ ধরনের সুযোগ দেয়া যেতে পারে। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংগুলো গ্রামমুখী হতে চান না। তাদের বেশি আগ্রহ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করার। সরকারের কৃষি ব্যাংক এবং রাজশাহী বিভাগের জন্য রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক বা রাকাবের আগ্রহী এখন নগরমুখী। এবারে গৃহপরিচারক-পরিচারিকাদের নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। এদের সংখ্যা কম নয়। এদের ওপর কী নিষ্ঠুর নির্যাতন হয় তা মাঝে মাঝে পত্রিকা মারফত জানা যায়। সব তো আর পত্রিকায় আসে না। দুবোন দুবাড়িতে কাজ করছে এই ঢাকা শহরে। গৃহকর্তাদের অনীহার কারণে ঈদের দিনেও তারা পরস্পর পরস্পরের সাক্ষাৎ করতে পারে না। কেন পারবে, এরা তো কাজের মেয়ে, এদের কোনো আবেগ, অনুভূতি থাকবে কেন? আবার একটু ফিরে যেতে চাই কৃষক নির্যাতনের কথায়। আজ আমরা ১ মে পালন করবো। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা হবে কে কতো মেহনতি মানুষের জন্য বক্তব্য-বিবৃতি দিতে পারবেন। কতো রকমের অনুষ্ঠান হবে। টোপর মাথায় দেয়া হবে। আর যেসব নেতা বলবেন, তারা চিত্তবিনোদনের জন্য মালয়েশিয়া যাবেন। চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে। আর যাদের উদ্দেশ্যে বলবেন, তারা বাংলাদেশের কোনো এক সরকারি হাসপাতালে ভর্তির আশায় বারান্দায় পড়ে থাকবে। তবুও বলবো ১ মে জিন্দাবাদ। আশা জিয়ে না রাখলে তো চলার পথ স্তব্ধ হয়ে যাবে। 

0 comments:

Post a Comment