Friday, April 29, 2016

বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণী ও মে দিবস

বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণী ও মে দিবস 
আলী ফোরকান
মে দিবস। এক সময়ে সারা দুনিয়াতে এই দিনটি শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার আদায় ও মুক্তির লড়াইয়ের প্রতীক। বাংলাদেশেও তাই ছিল। কিন্তু কালক্রমে মে দিবস যেমনটি দুনিয়াতে তার ধার হারিয়েছে। তেমনি হারিয়েছে বাংলাদেশেও। এখন বাংলাদেশে এটি একটি ছুটির দিন মাত্র। বাংলাদেশের ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক সংগঠনগুলো এই দিনে এখন আর আগের মতো র‌্যালি করে না-জনসভা করে না বা শ্রমিক শ্রেণীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা বা অধিকার আদায়ের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে না। বরং মে দিবস অনেকটাই পত্রিকার পাতার প্রতিবেদন-মন্তব্য এবং টিভির টক শোতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তবে এখনো পুঁজিবাদবিরোধী দুনিয়ায় দিনটি শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্য ও সংহতির প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়। এই দিনটি আর্ন্তজাতিক শ্রমিক দিবস বা লেবার দিবস হিসেবেও দুনিয়ার কোথাও কোথাও পালিত হয়। সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের আগে এই দিনটি সারা দুনিয়ার শ্রমিক শ্রেণীর অনুপ্রেরণার দিবস হিসেবে পালিত হতো। কিন্তু রাশিয়ার পতনের পর পুঁজিবাদী দুনিয়ার দাপটে মে দিবস অনেকটা ম্লান হয়ে পড়েছে। আমাদের দেশে বৃহৎ পুঁজির আগ্রাসনে শ্রমিক শ্রেণীর ক্রমান্বয়ে কোণঠাসা হওয়ার অবস্থা হওয়ায় মে দিবসের সেই জলুস এখন আর নেই। তবে এখনো বিশেষত কম্যুনিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় দিনটি গুরুত্ব বহন করে। আমাদের দেশে পাকিস্তান আমলে এই দিনটি আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে পালিত হতো। শ্রমিক শ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য দিনটি পালনে আমাদের শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন ও রাজনৈতিক দলগুলো অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। মে দিবসের বিশাল র‌্যালি বা জনসভার কথা এখনো আমাদের যৌবনের কথা মনে করিয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর পঁচাত্তরের আগে বাংলাদেশে সরকারিভাবে দিনটি অত্যন্ত মর্যাদাবান ছিল। তখন আমাদের সমাজতন্ত্রের অঙ্গীকার ছিল। আমরা কম্যুনিস্ট না হলেও শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তিতে বিশ্বাস করতাম। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষক শ্রমিকের রাজত্ব কায়েম করার জন্য তার দ্বিতীয় বিপ্ল¬বের কর্মসূচি নিয়েছিলেন। তিনি গড়েছিলেন বাকশাল। সেটি ছিল কৃষক শ্রমিকের আওয়ামী লীগ। আজকাল সেই আওয়ামী লীগের নাম কেউ উচ্চারণ করে না। তখন সরকারি শ্রমিক সংগঠনতো বটেই অন্যান্য শ্রমিক সংগঠন এবং রাজনৈতিক দলগুলো মে দিবসকে গুরুত্ব দিতো। সরকার নিজে পালন করতো সেই দিনটি। শ্রমিকরাও দিনটিকে তাদের নিজেদের দিন হিসেবে পালন করতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে খুন করার পর বাংলাদেশের জন্মের আদর্শকে বদলে দিয়ে পুঁজিবাদের দিকে যাত্রা শুরু করার পর পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র পুঁজিবাদের তোষণ শুরু করে। পুঁজিবাদীরা রাষ্ট্র যন্ত্রের সর্বত্র তাদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। সংসদ থেকে রাজনৈতিক দল সর্বত্র পুঁজিবাদেরই জয়গান গাওয়া হতে থাকে। বাংলাদেশের জন্মের আগে বা পরে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর শ্রমিক সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়নগুলোর যে প্রভাব ছিল পঁচাত্তরের পর সেগুলো হাওয়ায় ওড়ে যায়। যে দেশটি সাধারণ মানুষ, মেহনতি মানুষ, দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির অঙ্গীকার নিয়ে জন্ম নিয়েছিল তাতে শ্রমিক শ্রেণী দিনে দিনে আরো শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকলো এবং এখনতো বলতে গেলে এই রাষ্ট্রে শ্রমিকের কোনো অধিকারই নেই। রাষ্ট্রযন্ত্র এখন ধনিক শ্রেণীর পরিপূর্ণ দখলে। ফলে তারা রাষ্ট্রকে তাদের শোষণের যন্ত্রে পরিণত করেছে। ফলে শোষণ যা আগে কেবল সাধারণ মাত্রার ছিল এখন তা চরম দুর্বিষহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। অন্যদিকে যে ধনিক শ্রেণী সাধারণ মুনাফা করতো এবং শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল সেই শ্রমিক শ্রেণীকে এখন কার্যত পুঁজিপতিদের দাসে পরিণত করা হয়েছে। এক ধরনের ক্ষোভ আমাদের মাঝে দানা বেঁধে আছে।  পাকিস্তানের তেইশ বছরে তৎকালীন পূর্ব বাংলার শিল্পায়ন বলতে কিছু ছিল না। যা কিছু আইসক্রিম ফ্যাক্টরি বা লোহার পাতের কারখানা ইত্যাদি ছিল সেগুলোর মালিক ছিল পাকিস্তানিরা। ১৬ ডিসেম্বরের পর সেই মালিকরা পালিয়ে যায়। সেগুলোতে বসে প্রশাসক নামক নতুন মালিক। চোখের সামনে দেখছিলাম দেশের শিল্প কল কারখানাগুলোর সেই নতুন মালিকরা পাগলা কুকুরের মতো সেইসব প্রতিষ্ঠানকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাবার চেষ্টা করছিল। বঙ্গবন্ধু এসব কারখানা পরিচালনা করার জন্য প্রশাসক নিয়োগ করেন। যারা কোনোদিন কারখানা কি জিনিস তা-ই চোখে দেখেনি তারাই প্রশাসকের নামে মালিক বনে যায়। এরপর যা হওয়ার তা-ই হয়। এখন খোঁজ করলে সেইসব জাতীয় সম্পদের কোনোটিকেই হয়তো আর খোঁজে পাওয়া যাবে না। তখন থেকেই বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের চিত্রটা আমাদের চোখের সামনে ভাসতে থাকে। স্বাধীনতার আগে যদিও দেশের শিল্পখাতটি ছোট ছিল তথাপি আদমজীসহ দেশের সবখানে ছড়িয়ে থাকা পাটকল, কাপড়ের কল এবং আরো অনেক শিল্প কল-কারখানায় বিপুল পরিমাণ শ্রমিক কাজ করতো। কেউ যদি স্মরণ করতে পারেন তবে এটি মনে থাকার কথা যে ঊনসত্তরের আন্দোলনে আদমজী ও টঙ্গীর শ্রমিকদের অবদান ছিল ব্যাপক। সত্তরের নির্বাচনে শ্রমিকদের অবদান ছিল অপরিসীম। এমনকি একাত্তরের মার্চ মাসে দেশজুড়ে যেসব শ্রমিক এলাকা ছিল সেইসব স্থানে মু্িক্তযুদ্ধের পক্ষে সাংগঠনিক কাজ হয়েছিল ব্যাপক। সেই সময়ে শ্রমিক সংগঠন গুলি অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে দেশ স্বাধীনে সহায়তা করেছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালেও বাংলাদেশের শ্রমিকরা জাতীয় অগ্রগতির জন্য ব্যাপকভাবে কাজ করেছে। এমনকি এখনো যদি আমরা দেশের সার্বিক অবস্থার দিকে তাকাই তবে এটি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলা যাবে যে, আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে দেশের অতি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য। যদি দেশের গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমিকরা তাদের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে তবে আমরা যে একটি দিনও সামনে পা বাড়াতে পারবো না সেটি কাউকে চোখে আঙুুল দিয়ে দেখানোর প্রয়োজন পড়বে না। কেউ যদি একটু সহানুভূতির মতো করে চোখটা খোলা রেখে এই খেটে খাওয়া মানুষদের দিকে নজর দেন তাহলে দেখবেন মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে তারা কর্মস্থলে আসেন। তাদের থাকার জায়গাটা হয়তো কবরের মতো। তাদের চিকিৎসা নামক কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। ওরা যা খায় তা হয়তো মানুষ সাধারণভাবে গলাধঃকরণ করে না। তাদের কাপড়চোপড় দেখার মতো নয়। দিনে-রাতে কঠোর পরিশ্রম করে তারা মালিকদের জন্য ক্লুগার বা এসইউবি গাড়ি, বাড়ি ও বিলাসিতার আয়োজন করে দেয়। কিন্তু দিন শেষে তাদের ভাগে বেঁচে থাকার ন্যূনতম আয়োজনটি থাকে না। অন্যদিকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে উঠেছে সেই মানুষগুলোর জন্য যারা প্রবাসে প্রতি মুহূর্তে প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকে। এই দেশ থেকে যেসব শিক্ষিত লোক বিদেশে যান তারা দেশের জমিজমা বাড়িঘর বিক্রি করে হুন্ডিতে টাকাটা পাচার করে মাইগ্রেশন নিয়ে চিরতরে বিদায় হন। অন্যদিকে যে মানুষগুলো বিদেশে শ্রমিকের কাজ করেন তারা তাদের শেষ পেনিটি পর্যন্ত দেশে পাঠায়। কিন্তু রাষ্ট্র কি এই মানুষদের পাশে থাকে? বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো কি তাদের পাশে থাকে? অথচ আমরা এই খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য রাষ্ট্রকে তেমন কিছু কি করতে দেখি? গার্মেন্টসসহ অন্যান্য শিল্পখাতে যারা কাজ করে রাষ্ট্র তাদের ন্যূনতম মজুরি প্রদানের কোনো নিশ্চয়তা দেয় না। পুরো এক মাসে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা শ্রম দেয়ার পর মাত্র তিন হাজার টাকা প্রদান করার বিষয়ে মালিকপক্ষ নানা যুক্তি তুলে ধরে। তারা তাদের মাসের বেতন বা অভারটাইম সময়মতো তো দূরের কথা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাসের পর মাস পায় না। তাদের জন্য বোনাস আদায় করতে রাস্তায় নামার ঘটনা ঘটে। পাটকলসহ ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হওয়ার ফলে শ্রমিকরা এখন জীবন ধারণের কর্মসংস্থানও পায় না। জাহাজ ভাঙার মতো শিল্পে যারা কাজ করে তাদের জীবন প্রতি মুহূর্তে বিপন্ন হয়Ñ তারা জীবন পর্যন্ত দেয়Ñ কিন্তু এর ক্ষতিপূরণ পর্যন্ত দেয়ার ব্যবস্থা থাকে না। একটু হিসাব করে দেখুনতো এ পর্যন্ত কোনো মালিককে কি শ্রমিকদের বেতন-বোনাস না দেয়ার জন্য একটি মুহূর্তের জন্য আইনের মুখোমুখি হতে হয়েছে? একবার কেন, আমরা জানি এটি কখনো ঘটবে নাÑ ঘটার নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে জাতির জনক যে দেশটিকে কৃষক শ্রমিকের জন্য তৈরি করতে চেয়েছিলেন সেই দেশটি এখন ধনিক শ্রেণীর দেশে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তানের বাইশ পরিবারকে বিদায় করতে গিয়ে আমরা দেশেই বাইশ হাজার পরিবার তৈরি করেছি। তারা চরিত্রগতভাবে লুটেরা। তারা দেশপ্রেমিক বা জনতার বন্ধু নয়। তারা তাদের নিজেদের স্বার্থ ছাড়া অন্য কারো স্বার্থ দেখে না-বোঝে না। দেশের স্বাধীনতার পয়তাল্লি¬শ বছর পার করার সময়ে তাই আমরা যখন মে দিবস পালন করছি তখন বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে হচ্ছে যে বাইশ হাজার লুটেরা ধনিকের জন্য না স্বাধীনতার যুদ্ধ হয়েছে না তিরিশ লাখ শহীদ রক্ত দিয়েছে। যদি আমরা দেশের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে চাই তবে অবশ্যই সেই কৃষক-শ্রমিকের দেশই গড়তে হবে। আজকের মে দিবসে যদি আমরা সেই অঙ্গীকার করি তবেই স্বাধীনতা অর্থবহ হবে।
০১৭১১৫৭৯২৬৭

0 comments:

Post a Comment