Wednesday, May 23, 2018

স্মরণ: ইবসেন: বিশ্বনাটকের মহাস্থপতি

স্মরণ: ইবসেন: বিশ্বনাটকের মহাস্থপতি
আলী ফোরকান
জন্ম : ১৮৮২ সালের ২০ মার্চ
 মৃত্যু :১৯০৬ সালের ২৩ মে
ইবসেন জন্মেছিলেন নরওয়ের সমুদ্রতীরবর্তী শিয়েন শহরে ১৮৮২ সালের ২০ মার্চ তখনকার রাজধানী ক্রিস্টিয়ানিয়া; আজকের অসলো, থেকে এই শহরটি একশ মাইল দক্ষিণের ছোট্ট একটি শহরে। ইবসেন আমাদের কাছে এক নামে পরিচিত ‘আ ডলস হাউস’র নাট্যকার হিসেবে। সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ছবি ‘গণশত্রু’ ইবসেনের ততোধিক বিখ্যাত নাটক ‘অহ ঊহবসু ড়ভ ঃযব চবড়ঢ়ষব’ থেকে অভিযোজিত। ইবসেন এই দুটি নাটকের মধ্য দিয়ে পরিবার ও সমাজে ব্যক্তির ভূমিকাকে চিহ্নিত করেছেন। আর এই ব্যক্তির ভূমিকাকে চিহ্নিত করতে কিছু বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া যায় যেমন: ব্যক্তি, ব্যক্তির সাথে অন্যদের সম্পর্ক, সম্পর্কের সূত্র, সম্পর্কের সংঘাত, ব্যক্তির সিদ্ধান্ত ইত্যাদি।

শেক্সপীয়রের পরে বিশ্বসাহিত্যে ইবসেনের মতো নাট্যকার কমই এসেছেন বলে অনেকে মনে করেন। সুইডিস নাট্যকার অগাস্ট স্ট্রীন্ডবার্গ  ইবসেনকে তাঁর একইসঙ্গে পূর্বসূরীও হয়ে ওঠার পথে প্রধান বাধা বলে মনে করতেন। শোনা যায়, ইবসেনের ছবি নিজের লেখার টেবিলের ওপর রেখে নতুন নতুন লেখার প্রেরণা পেতেন স্ট্রীন্ডবার্গ। জেমস জয়েসের মতো  যুগন্ধর ঔপন্যাসিক ইবসেনকে বিশেষ ভক্তি করতেন, কিন্তু তাঁর দেশ নরওয়ের বিখ্যাত লেখক ন্যূট হ্যামসুন ইবসেনকে দেখতেন তীব্র সমালোচনার দৃষ্টিতে। এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে ইবসেনের মুখের ওপরেই ন্যূট হ্যামসুন বলেছিলেন, ইবসেনের লেখা তরুণদের আর কোনো কাজে লাগবে না, তাঁর সাহিত্যও হয়ে গেছে একঘেয়ে ও বিবর্ণ। সুতরাং ভালো-মন্দ মিলেই ইবসেন তাঁর সমকাল থেকে চিরকালের দিকে এখনো অগ্রসরায়মান।
১৮৫০ সালে ‘ক্যাটিলিন’ নাটক লেখার ভেতর দিয়ে ইবসেনের নাটক লেখার সূচনা। কিন্তু নাট্যকার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করতে তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে  দীর্ঘ ১২টি বছর। বলতে গেলে ‘ব্র্যান্ড’ (১৮৬৫) নাটকটি ইবসেনকে খ্যাতিমান করে তোলে। পরবর্তীকালে একটির পর একটি নাটক সফলতার মুখ দেখতে থাকে। ‘পিয়ের গিন্ট’ (১৮৬৭), ‘দি লীগ অব ইয়ুথ’ (১৮৬৯), ‘দি পিলারস অব সোসাইটি’ (১৮৭৭), ‘এ ডলস হাউস’ (১৮৭৯), ‘গোস্টস’ (১৮৮১), ‘অ্যান এনিমি অব দি পিপল’ (১৮৮২), ‘দি ওরাইল্ড ডাক’ (১৮৮৪), ‘রোজমার্সাহোম’ (১৮৮৬), ‘দি লেডি ফ্রম দি সী’ (১৮৮৮), ‘হেডা গাবলার’ (১৮৯০), ‘দি মাস্টার বিল্ডার’ (১৮৯২), ‘লিটল আইওলফ’ (১৮৯৪), ‘জন গ্যাব্রিয়েল বর্কম্যান’ (১৮৯৬) এবং ‘হোয়েন উই ডেড এওয়েইকেন’ (১৮৯৯) উল্লেখিত প্রত্যেকটি নাটকই বিশ্বনাট্যের ইতিহাসে একেকটি স্বার্থক নাটক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে।
ইবসেন মারা গিয়েছিলেন ১৯০৬ সালের ২৩ মে অসলোতে। ১৯০০ সাল থেকেই ইবসেনের শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছিল, যে কারণে আমরা দেখতে পাই ‘হোয়েন উই  ডেড এওয়েকেইন’র পর ইবসেন আর তেমন কোনো রচনায় হাত দিতে পারেননি। সেই অর্থে বিংশ শতাব্দীর সূচনা হয় ইবসেনের নাটক ছাড়াই। কিন্তু উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে শেষ পর্যন্ত যে পঞ্চাশ বছরের সাহিত্য-জীবন ইবসেন পার করেছিলেন সেটি বিশেষভাবে বর্ণাঢ্য। নাট্যকার হিসেবে সূচনালগ্নের কিছু পরে ইবসেনকে স্বেচ্ছানির্বাসনে কাটাতে হয়েছিল ইতালি ও জার্মানিতে। উনিশশ সালের দিকে তাঁর অসুস্থতাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল উন্মাদ রোগ হিসেবে। এ-সময়ে  ইবসেন বর্ণমালা শেখার জন্য তাঁর আশপাশের পরিচিত মানুষ ও বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি সকরুণ অনুরোধ জানাতেন। এই কথাটি আমাদের তাঁর প্রতি করুণা না জাগিয়ে পারে না।
একজন সমাজসচেতন ও প্রতিবাদী নাট্যকার হিসেবে ইবসেন যেমন গণ্য হয়ে থাকেন, ততটাই গণ্য হয়ে ওঠেন মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার অন্যতম বিশ্লেষণকারী নাট্যকার হিসেবে। তাঁর শেষ দিকের নাটকগুলোতে মানুষের অন্তর জগতের খোঁজ মেলে। ‘হেডা গাবলার’ নাটককে তো কেউ কেউ বীভৎস গল্প হিসেবে অভিহিত করেছেন। সেই সময়ের ‘ডেইলী টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছিল এই নাটক পড়লে যেন মনে হয় মর্গে ভ্রমণ করে এলাম। এ নাটক সম্পর্কে মর্গেন ব্লাডেড লিখেছিলেন: ‘ঐড়ৎৎরবফ সরংপড়ঁৎধমব ড়ভ রসধমরহধঃরড়হ’। এ নাটক পড়লে মনে হতেই পারে এডগার অ্যালেন পো-র রহস্যময় অন্ধকারাচ্ছন্ন গল্পগুলির কথা আর আধুনিক কালের ‘ন্যয়ার’ চলচ্চিত্রের কথা সেখানে অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিস্থিতিতেই ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটে বা ভয়ংকর পরিস্থিত না ঘটলেও সবকিছু রহস্যময়তার আবহ পায়। আধুনিক জগতের নানা বিন্যাসের মূলে যে ক্ষমতা কাঠামোর নানান রকম ওলোট পালোট তার সূত্রমুখ ইবসেনের নানান নাটক থেকে আমরা পেতে পারি। এ-কথা বলাই যায় ইবসেন কেবল নাট্যকারই নন, বিশ্বাসাহিত্যের অঙ্গনে ও মানববিদ্যা চর্চার এক মহাস্থপতি।
ইবসেনের যাত্রা বাস্তববাদ থেকে আধুনিকবাদের দিকে। আধুনিকতার প্রধান প্রণোদনগুলি ইবসেনের নাটকের মধ্য দিয়ে পরিস্ফুটিত হয়েছিল। সে কারণে নাট্যকার হলেও সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে কবিতা উপন্যাস গল্প সবখানে ইবসেনের প্রভাব প্রবল। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, নারী-স্বাধীনতা, নাগরিক মানুষের নির্মাণ ও ক্ষয় বুঝতে হলে ইবসেনের নাটক পড়া ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই। ফলে আধুনিক মানুষ আর ইবসেনীয় চেতনাকে আমরা সমার্থক বলে মনে করি।

0 comments:

Post a Comment