Wednesday, April 27, 2016

রবীন্দ্রনাথ: মানবধর্ম ও মানবপ্রেম

রবীন্দ্রনাথ: মানবধর্ম ও মানবপ্রেম 
আলী ফোরকান
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নিঃসন্দেহে একজন দার্শনিক কবি। কবি হিসেবে তাঁর ধ্যান-ধারণা ও ভাব-কল্পনার মূল উপাদান দার্শনিক যুক্তি নয়। অনাবিল অপরোক্ষ অনুভূতি; কিন্তু তাই বলে তিনি হৃদয়াবেগের চাপে দার্শনিক বিচার-বিশ্লেষণের পথ পরিহার করেননি। যেখানে যুক্তির সঙ্গে সংস্কার বা বিশ্বাসের বিরোধ দেখা দিয়েছে, সেখানে তিনি বুদ্ধিকে খাটো করে দেখেননি। এ কথা প্রকৃতি, সমাজ ও রাষ্ট্রের বেলায় যেমন সত্য, তেমনি সত্য ধর্ম বিশ্লেষণের বেলায়ও। যেমন, তিনি ধর্মীয় বিধি-বিধান ও আচার-অনুষ্ঠানকে সরল বিশ্বাসে মেনে নেননি, যাচাই করে দেখেছেন যুক্তির কষ্ঠিপাথরে। তিনি তাঁর এই দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পৌত্তলিকতা, অর্থহীন আচার-অনুষ্ঠান, বিশেষত নিষ্ফল মন্ত্রযপের বিরুদ্ধে বিশ্লেষণী লেখালেখির মাধ্যমে। একথা ঠিক রবীন্দ্রনাথের চিন্তার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটেছে ধর্মীয় প্রত্যয় ও অনুভূতিকে আশ্রয় করে। উপনিষদ ছিল তার ভাবজীবনের মূল উৎস এবং পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তার পূর্বাচার্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মনের উদারতা তাকে ব্রাহ্মধর্মের মধ্যে সীমিত থাকতে দেয়নি। ধর্মকে বিশ্বকবি দেখতে চান বৈশ্বিক দৃষ্টিতে। বিশ্বমানবতার মুক্তি, শান্তি ও ব্যাপক কল্যাণের উৎস হিসেবে। তাইতো কবি বলেন, ‘সংসারে একমাত্র যাহা সমস্ত বৈষম্যের মধ্যে ঐক্য, সমস্ত বিরোধের মধ্যে শান্তি আনয়ন করে, সমস্ত বিচ্ছেদের মধ্যে একমাত্র যাহা মিলনের সেতু, তাহাকেই ধর্ম বলা যায়। তাহা মনুষ্যত্বের এক অংশে অবস্থিত হইয়া অপর অংশের সহিত কলহ করে না-সমস্ত মনুষ্যত্ব তাহার অন্তর্ভুক্ত।’ আবার প্রকৃত ধর্ম আচারসর্বস্ব নয়, মোক্ষসাধন কিংবা পরলোকচর্চাও ধর্মের মূল লক্ষ্য হতে পারে না। ধর্ম মানে দেহ-মন-বুদ্ধি-ইচ্ছার সামগ্রিক কর্ষণ তথা সর্বাত্মক জীবনচর্চা সমাজ বিশ্ব মানবতার কল্যাণ সাধন। যিনি কল্যাণ পথের অভিসারী, তিনিই প্রকৃত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। এ অর্থেইতো বলা হয়, ধর্ম মানুষের জন্য, মানুষ ধর্মের জন্য নয়। যে ধর্ম-কর্ম করার অর্থ মানুষের অকল্যাণ সাধন, তা প্রকৃত ধর্ম নয়, ধর্মের ছদ্মবেশী কুসংস্কার মাত্র। জীবনের প্রতি বিমুখ হয়ে সমাজ সংসারকে উপেক্ষা করায় মুক্তি নেই। প্রকৃত মুক্তি আসে জগতের সঙ্গে নিজেকে মনেপ্রাণে যুক্ত করায় এবং সর্বজনীন মৈত্রীর প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সেবাকর্মে প্রবৃত্ত হওয়ায়। কবির ভাষায়:
বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি,
 সে আমার নয় 
অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ। 
রবীন্দ্রনাথের মতে, ধর্ম মানে মানুষের ধর্ম। ‘মানুষের ধর্ম’ গ্রন্থে ধর্মের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ধর্ম মানেই মনুষ্যত্ব যেমন আগুনের ধর্ম অগ্নিত্ব, পশুর ধর্ম পশুত্ব। তেমনি মানুষের ধর্ম মানুষের পরিপূর্ণতা।’ শুদ্ধাচারে যোগাসনে নয়, আত্মত্যাগ ও সেবা ধর্মের মাধ্যমেই মানুষ পরবে পরিপূর্ণতা লাভ করতে, অসীমের সন্ধান পেতে। অসীম জগতের বাইরে অবস্থিত কোনো অতীন্দ্রিয় সত্তা নন, তাঁকে সর্বভূতে প্রত্যক্ষ করা যায়, প্রকৃতি জগতেই পাওয়া যায়। ভক্তি প্রীতি কর্ম দিয়ে স্রষ্টাকে মানুষের সত্তায়ই আবিষ্কার করা যায়, কারণ তিনি নির্গুণ ব্রহ্ম নন, জীবনদেবতা। মানুষের মধ্য থেকেই তিনি পরিচালিত করেন তার জীবনকে। সসীম ও অসীমের সম্বন্ধ যেন বারিবিন্দু ও সমুদ্রের সম্বন্ধ। বিন্দু বিন্দু বারি নিয়েই তো সমুদ্র। বিন্দুরূপ সসীম মানুষ ব্যাকুলতা অনুভব করে সমুদ্ররূপ ঈশ্বরের জন্য। সসীম-অসীমের এই ঘনিষ্ট সম্বন্ধই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কবির ভাষায়: ‘অসীম যে চায় সীমার নিবিড় সঙ্গ, সীমা হতে চায় অসীমের মাঝে হারা।’
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি, বিশ্বমানবতার কবি। তিনি তাই বাঁচতে চেয়েছেন এই মানুষের মাঝে, সীমার মাঝে পেতে চেয়েছেন অসীমকে। তাইতো তিনি অপছন্দ করেন সবধরনের সংকীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে বিশেষ করে হিন্দু মুসলমানের ভেদ-বিভেদ ও দাঙ্গার ঘটনাবলি বিক্ষুব্ধ করেছিল কবিকে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই মোহমুগ্ধ ধর্ম বিভীষিকার চেয়ে সোজাসুজি নাস্তিকতা অনেক ভালো। ঈশ্বরদ্রোহী পাশবিকতাকে ধর্মের নামাবলি পরালে যে কি বীভৎস হয়ে ওঠে, তা চোখ খুলে একটু দেখলেই বেশ বোঝা যায়। আজ মিছে ধর্মকে পুড়িয়ে ফেলে ভারত যদি খাঁটি ধর্ম, খাঁটি আস্তিকতা পায়, তবে ভারত সত্যই নবজীবন লাভ করবে।’
বিশ্বকবি বলেন, এই বিশাল বিশ্বকে আমরা যে একান্ত আপন করে নিয়েছি, তার কারণ এখানে অবশ্যই একটা ঐক্য ও অখন্ডতাবোধ। সেই বোধ থেকে যখন সঞ্চারিত হয় প্রীতি, তখনই আমরা ব্রতী হই পরহিত সাধনে, তখনই উদ্বুদ্ধ হই বিশ্ব মানবতাবোধে। কর্মের সঙ্গে যখন সংযোগ ঘটে প্রীতির, তখনই মানুষ আনন্দ পায় পরহিতে, মা যেমনটি পেয়ে থাকেন তাঁর সন্তানের সেবা করে। এই স্নিগ্ধ প্রেমানুভূতির কথাই কবি বারবার উচ্চারণ করেছেন তাঁর সুপ্রসিদ্ধ 'জবষরমরড়হ ড়ভ গধহ’ শীর্ষক হিবার্টা বক্তৃতায়, একই কথার তিনি পুনরাবৃত্তি করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত ‘মানুষের ধর্ম’ শীর্ষক হিবার্ট বক্তৃতার ভাবানুবাদে। আর এ প্রীতি ও প্রেমের মাধ্যমে সমগ্র বসুন্ধরাকে সুন্দর করে গড়ে তোলার প্রত্যয়ই তিনি ব্যক্ত করেছেন ‘পুরস্কার’ কবিতার এই ক’টি অনবদ্য ছত্রে: 

‘সংসার মাঝে কয়েকটি সুর
রেখে দিয়ে যাবো করি’ সুমধুর
দু-একটি কাঁটা করি’ দিব দূর-
তার পরে ছুটি নিব।’
০১৭১১৫৭৯২৬৭

0 comments:

Post a Comment