Sunday, May 20, 2018

স্মরণ : ড. রশীদ আল ফারুকী

স্মরণ : ড. রশীদ আল ফারুকী
আলী ফোরকান
জন্ম : ১৯৪০ এর ১৫ মার্চ 
মৃত্যু :১৯৮৭ এর ১৯ ডিসেম্বর 
রশীদ আল ফারুকী ওরফে খায়ের উল বশর ১৯৪০ এর ১৫ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার গোপ্তাখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মোহাম্মদ নুরুল আবছার, মাতা গোলচেহরা চৌধুরী। রশীদ আল ফারুকী প্রাচীন অভিজাত আলেম পরিবারের মানুষ। হাতিয়ার অধিবাসী সুফি শাহ ভোঙ্গান শাহের উত্তর পুরুষ তিনি। তাঁর দাদা মওলানা আব্দুস সাত্তার সীতাকুণ্ড সিনিয়র মাদ্রাসায় ২৫ বছর শিক্ষকতা করেছেন। মাওলানা সাহেব মুসলমান সমাজে ইংরেজী শিক্ষার প্রবর্তক স্যার সৈয়দ আহমদের আহবানে সারা দিয়ে পুত্র মোহাম্মদ নুরুল আবছারকে ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত করেন তিনি ১৯২৪ সালে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করে স্বর্ণপদকে ভূর্ষিত হন। আলেম পরিবারের ইংরেজি শিক্ষিত পিতার সন্তান রশীদ আল ফারুকী এবং পীরের সন্তান পিরজাদা খায়ের উল বশর পরবর্তীতে সাহিত্যিক রশীদ আল ফারুকী।
স্থানীয় গ্রামে গোপ্তখালী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু। এখানে তিনি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর তাঁকে ফেনীর আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। সেখানে তিনি চার বছর লেখাপড়া করেন। ১৯৫৮ সালে বামপন্থি রাজনীতির সংস্পর্শে এসে মাদ্রাসা শিক্ষায় আস্থা হারিয়ে ফেলেন। রাজনীতি হতে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য তাঁর পিতা তাঁকে মীরসরাইয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুফিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে তিনি দুই বছর লেখাপড়া করেন। মাদ্রাসায় পড়লেও রাজীনীতি হতে তিনি দূরে সরে যাননি। এ অবস্থায় তাঁর পিতা তাঁকে পারিবারিক বইয়ের দোকানের ব্যবসার কাজে লাগিয়ে দেন। বইয়ের ব্যবসায় যুক্ত থাকা অবস্থায় ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রামের ওয়াজেদিয়া মাদ্রাসা হতে ফাজিল পাস করেন। রশীদ আল ফারুকী মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি তাঁর কোন আগ্রহ ছিলনা। পরবর্তীতে তিনি সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং ১৯৬০ সালে সীতাকুণ্ড টেরিয়াল হাই স্কুল হতে দ্বিতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সে সময় তাঁর পিতার মামাতো ভাই শুল্ক কর্মকর্তা ফোরক আহমদের জেষ্ঠ্য কন্যা মেহের–উন নিসা রুবির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ হতে মানবিক শাখায় দ্বিতীয় উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন এবং ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বি.এ সম্মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ও দ্বিতীয় শ্রেণি লাভ করেন।
১৯৬৩–৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যায়নকালীন সময়ে রশীদ আল ফারুকী সাহিত্য– সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পরেন। এ সংগঠন হতে “সুন্দরম” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ছাত্রাবস্থায় ১৯৫৮ সালে পিতা নুরুল আবছার যুক্তফ্রন্টের পক্ষে চট্টগ্রাম–২ আসনে (সীতাকুণ্ড ডবলমুরিং) নির্বাচনে অংশ নেন। এ নির্বাচনে যুক্ত থাকায় তিনি ছাত্ররাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৫৫ সালে যুবলীগে যোগ দেন। ১৯৫৭ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইনে তাঁকে গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রকালীন সময়ে আইয়ুব বিরোধী শিক্ষা আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকায় সামরিক শাসন বিরোধী শিক্ষা আন্দোলনে অংশ থাকায় পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। সে সময় রাজনীতি প্রাঙ্গণে তিনি শাহাজাদা খায়ের–উল বশর নামে সুপরিচিতি হয়ে উঠেন। কর্মজীবনে পরবর্তীতে রাজনীতি হতে দূরে সরে আসেন। ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এম.এ পাস করেন।
১৯৬৭ সালে রাউজান কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদেয়ার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। এখানে তিনি তিন বছর শিক্ষকতা করেন। ১৯৭০ এ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো হিসেবে বাংলা বিভাগে যোগ দেন। রাউজান কলেজে অধ্যাপনাকালে তাঁর প্রথম স্ত্রীর অকাল মৃত্যু ঘটে। ১৯৭১ সালে তিনি বদরুন নিসার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদেন। ১৯৭৫ সালে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য কলকাতা যান। ১৯৮১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ড. অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে “মুসলিম রচিত বাংলা উপন্যাস (১৮৮৫–১৯৩০) শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে তিনি এ ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে ফিরে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮২ সালে বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতী পান। ১৯৮৬ সালের ১৬ এপ্রিল তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং আমৃত্যু তিনি এপদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এ.এফ.রহমান হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব পালন করেন। একই বছর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিকেশন সমিতির সদস্য মনোনীত হন। ১৯৮৬ সালে ঢাকার বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। সাহিত্য চর্চায় তরুণদের উজ্জীবিত ও সংগঠিত করার জন্য ১৯৮৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ সাহিত্য পরিষদ। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়ে রাজনীতি হতে দূরে থাকলেও তিনি ছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও গবেষক। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন সাময়িকী ও গবেষণা পত্রিকায় তাঁর অনেক গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হন। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় সাহিত্যের পাতায় তিনি নিয়মিত প্রবন্ধ রচনা করেছেন। গবেষণা সূত্রে কলিকাতায় অবস্থানকালে অর্জুন দাস ছদ্মনামে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন।
সাহিত্য চর্চার শুরুতে তিনি প্রথমে খায়ের উল বশর নামে সুপরিচিত হয়ে উঠেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনে পিরজাদা খায়ের উল বশর নামেও সুপরিচিত ছিলেন। লেখনিতে রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিতি হয়ে যেতে পারে সে আশংকায় তিনি পরে লেখক হিসেবে রশীদ আল ফারুকী নামটিকে গ্রহণ করে নেন। কলকাতায় পিএইচডি গবেষণা শেষে তিনি বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের গবেষণা প্রকল্পের আওতায় আল ইসলাম পত্রিকায় “ভাষা ও সাহিত্য অধ্যায়ন” বিষয়ে গবেষণার কাজ শুরু করেন। যা তাঁর অকাল মৃত্যুতে অসমাপ্ত থেকে যায়। জীবিত অবস্থায় তাঁর সতেরটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে দশটি প্রবন্ধ গ্রন্থ, চারটি সম্পাদিত গ্রন্থ,একটি জীবনী গ্রন্থ, একটি কিশোর গ্রন্থ ও একটি অনুবাদ গ্রন্থ। এছাড়াও তাঁর বহু রচনা এখনো অগ্রন্থিত রয়েছে। ১৯৭৩ সালে তিনি মওলানা আবুল কালাম আজাদের লেখা “ইন্ডিয়া উইলস ফ্রিডম” বইটি বাংলা অনুবাদ করে তা প্রকাশের জন্য বাংলা একাডেমিতে পাণ্ডু লিপি জমা দিয়েছিলেন। বইটি অপ্রকাশিত থাকে। রশীদ আল ফারুকীর প্রকাশিত গ্রন্থ সমূহের তালিকা এখানে দেয়া হলো: ১। রুচি ও প্রগতি, প্রকাশকাল– ১৯৬৯ইং ২। বাঙলা সাহিত্যে চরিত্র চিত্রন, প্রকাশকাল –১৯৬৯ । ৩। উর্দু সাহিত্যের রুপরেখা, প্রকাশকাল –১৯৭০ । ৪। শরৎ সাহিত্য জিজ্ঞাসা, প্রকাশকাল – ১৯৭১ । ৫। হারকিউলিসের দুঃসাহসিক অভিযান, প্রকাশকাল–১৯৬৯ । ৬। মুসলিম ম্যানস্ঃ সংঘাত ও প্রতিক্রিয়া– কলিকাতা হতে প্রকাশিত ১৯৮১ ৭। বাঙলা উপন্যাসে মুসলমান লেখকদের অবদান– কলকাতা হতে প্রকাশিত ১৯৮৮, ৮। সমকালীন প্রসঙ্গ– ঢাকা হতে প্রকাশিত ১৯৮৪ ইং ৯। বাঙলার জাগরণ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ– ঢাকা হতে প্রকাশিত ১৯৮৫ ইং। ১০। নুরুন্নেসা খাতুন বিদ্যা বিনোদনী– ঢাকা হতে প্রকাশিত ১৯৮৭ ইং। ১১। ধর্ম ও রাষ্ট্র– ঢাকা হতে প্রকাশিত–১৯৮৯ ইং। ১২। মুসলিম ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা (অনুবাদ গ্রন্থ) ঢাকা–১৯৮৮ইং। ১৩। ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব–ঢাকা ১৯৮৯ ইং সালে প্রকাশিত। এসব গ্রন্থ ছাড়াও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থগুলো হলো, ১। আধুনিক সাহিত্যের রূপকার (সমালোচনা সংগ্রহ) ঢাকা–১৯৭৫ ইং। ২। প্রসঙ্গ ভাষা ও সাহিত্য– কলকাতা ১৯৮১ ইং। ৩। কাজী আব্দুল ওদুদ প্রসঙ্গে– চট্টগ্রাম হতে প্রকাশিত ১৯৮৭। ৪। বঙ্কিম পরিক্রমা (মুক্তধারা ঢাকা হতে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা)। ৫। নব দিগন্ত (সাহিত্য) পত্রিকা ১৯৬৮ ইং (বিবিধ সাহিত্য পত্রিকা)। ৬। আগুণ ঝড়া ফাগুন (একুশের সংকল, কলকাতা)। ৭। নবজাতক (৩টি সংখ্যা) এবং পান্ডুলিপি, শেষোক্ত “পান্ডুলিপি’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের গবেষণাপত্র। শিক্ষকতা, গবেষণা, লেখালেখি সম্পাদনার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে সাংগঠনিক কর্মকান্ডেও জড়িত ছিলেন। ড. রশীদ আল ফারুকী বাংলাদেশ সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, চট্টগ্রাম বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি, বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতি, উদিচী শিল্পী গোষ্ঠী, বাংলাদেশ কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বিশ্ব মৈত্রী ও সংহতি পরিষদের সাথে সড়াসড়ি সম্পৃক্ত থেকে কাজ করেছেন। ড. রশিদ আল ফারুকী জীবন পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখা গেছে তিনি একই সময়ে অনেকগুলো কাজ সম্পাদন করা অফুরান প্রাণ শক্তির একজন মানুষ। অধ্যাপনা, লেখালেখি, সাংগঠনিক কর্মকান্ড নিয়ে ব্যস্ততায় নিবেদিত প্রাণ মানুষটি নিজের শরীরের দিকে কোন খেয়ালই রাখেননি। ১৯৮৭ এর শেষের দিকে তিনি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৮৭ এর ১৯ ডিসেম্বর চিকিৎসারত অবস্থায় রশীদ আল ফারুকী ইহলোক ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৮ বছর।

0 comments:

Post a Comment