Monday, February 19, 2018

উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি চাষের সম্ভাবনা

  উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি চাষের সম্ভাবনা 
আলী ফোরকান 
ষাটের দশক থেকে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে মৎস্য চাষ হয়ে আসছে। জোয়ারের পানি বাঁধ দিয়ে আকটিয়ে রেখে পানির সাথে থাকা চিংড়ি ও মাছের পোনাকে ৩-৪ মাস লালন পালন করে তা আহরিত করা হত। পরবর্তী কালে বিশ্ববাজারে চিংড়ির চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশে চিংড়ি চাষের বি¯তৃতি ঘটতে থাকে। আশির দশকের দিকে চিংড়ি চাষের পদ্ধতিগত উন্নয়ন হয়। এসময় উপকূলীয় অঞ্চলের বক্সবাজার, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় ব্যাপকভাবে চিংড়ি চাষ এলাকা বৃদ্ধি পায়। কক্সবাজার ছাড়া তিনটি জেলায় মূলত ধান ক্ষেতে ধান উৎপাদনের পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে চিংড়ি চাষ শুরু করা হয়।
চিংড়ি চাষের মাধ্যমে ১৯৮৩-৮৪ সালে ৪৩৮৬ মেঃ টন চিংড়ি উৎপাদিত হয়। যা ১৯৯০-১৯৯১ সালে ১৯৪৮৯ মেঃ টন, ১৯৯৬-৯৭ সালে ৫২২৭১ মেঃ টনে দাঁড়ায়। বর্তমানে তা দিন দিন বাড়ছে।  চিংড়ি চাষে এ ব্যাপক উন্নয়নের ধারা প্রকৃত পক্ষে সরকারি-বেসরকারী পর্যায়ের প্রচেষ্টার ফল। তবে এ বিষয়ে স¤প্রসারণের ফলে নানাবিধ অর্থতৈনিক ও সামাজিক সমস্যার সৃষ্টিও হয়েছে। বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিয়ে চিংড়ি চাষীদের চিংড়ি চাষে প্রশিক্ষণ দেয়াসহ পোনার উৎপাদনের জন্য হ্যাচারী স্থাপনে সহায়তা করার লক্ষ্যে সরকার ১৯৮৫ সালে একটি চিংড়ি চাষ প্রকল্প গ্রহণ করে।  চিংড়ি চাষাধীন এলাকা: বর্তমানে বাগদা চিংড়ি চাষের জন্য উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ১.৩০ লক্ষ হেক্টর জমি ব্যবহার করা হচ্ছে। যার মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ জমি বৃহত্তর খুলনা জেলায় অবস্থিত। এছাড়াও দেশের ১৬টি জেলায় প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমি গলদা চাষের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। 
 চিংড়ি চাষ পদ্ধতি-: দেশে চিংড়ি চাষের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলিত থাকলেও সত্যিকার অর্থে কোন পদ্ধতিতেই পদ্ধতিগত দিক হতে রীতি-নীতি মেনে চলা হচ্ছে না। যে কোন পদ্ধতিতেই চাষ হোক না কেন খামারের প্রকৃত লক্ষে কি ধরনের ব্যবস্থাপনা বিদ্যমান তা খামার মালিকদেরও ধারণা কম থাকে। বিশেষ করে বৃহৎ আকারের খামারগুলোতে খামার মালিকগণ নিজেরাই চাষ করে থাকেন বলে এ ক্ষেত্রে খামার পরিচালনায় জটিলতার উদ্ভব কম হবার সম্ভবনা থাকে। দেশে বর্তমানে যে পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে তা প্রধানত প্রচলিত ও আধা-নিবিড় পদ্ধতি। শতকরা ৭৫ শতাংশ জমিতে প্রচলিত পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে। যার উৎপাদন হার হেক্টর প্রতি ২০০-২০৫ কেজি।  প্রকৃত চিংড়ি চাষ এলকা চিহ্নিতকরণ-: বর্তমানে যে সব এলাকায় চিংড়ি চাষ হচ্ছে সেগুলো প্রকৃতপক্ষে কতখানি চিংড়িচাষের জন্য উপযোগী তা যাচাই বা পরীক্ষা করে দেখা হয়নি বা দেখার সুযোগও হয়নি। শুধুমাত্র জমি প্রাপ্তির সুবিধার উপর নির্ভর করেই খামার স্থাপিত হয়েছে। বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের অধিকাংশ চিংড়ি খামার ধান ক্ষেতগুলোতে স্থাপিত। এগুলো সাধারণত কয়েক মাসের জন্য জমির মালিক থেকে  ইজারা নিয়ে চিংড়ি চাষ করা হয়। ফলে একটি আদর্শ চিংড়ি খামারের জন্য যে সকল অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা থাকার কথা তা এতে থাকে না। পানির গভীরতা কোন কোন স্থানে মাত্র ১২ ইঞ্চি বা তারও নীচে থাকে। এ সকল কারণে প্রয়োজনের তুলনায় অযথা বিস্তীর্ণ এলাকায় লবন পানি প্রবেশ করিয়ে চাষ করা হচ্ছে। অর্থাৎ অবকাঠামোগত দিক বিবেচনা করে খামার স্থাপনা করা হলে এক দিকে চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে সুবিধা হত আবার অন্য দিকে আরও অনেক কম আয়তনের জমি ব্যবহার করে খামার স্থাপনা করা যেত। আর সে সঙ্গে খামারের অবকাঠামোগত প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি করা যেত। বর্তমানে তা করা সম্ভব হচ্ছে না। 
 অবকাঠামোগত ও ব্যবস্থাপনা সমস্যা-: খামার মালিক অথবা খামার পরিচালনার জন্য নিয়োজিত লোকের চিংড়ি চাষের উপর ব্যাপক কারিগরি জ্ঞান কম।  আবার অনেকের সামান্য জ্ঞান থাকলেও অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে উন্নত কারিগরি ব্যবস্থায় পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া খামার মালিক খামার পরিচালনার ক্ষেত্রে তার নিয়োজিত খামার ব্যবস্থাপকের দেয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করেই খামার পরিচালনার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেনও অর্থ বিনিয়োগ করে। খামার ব্যবস্থাপনায় যে সকল তথ্য পরিবেশিত হয়ে থাকে তা কতটুকু নির্ভরযোগ্য তা যাচাই করে দেখা হয় না। ফলে যে কোন কারণে উৎপাদন ব্যাহত হলে সাধারণ চিংড়ি রোগ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। যা সর্বক্ষেত্রে সত্য নয়।  উপকরণ সমস্যা-:চিংড়ি চাষের জন্য চিংড়ি পোনা ও চিংড়ির খাদ্যই হচ্ছে মুল উপকরণ। দেশের বাগদা চিংড়ি বিভিন্ন পদ্ধতিতে চাষের জন্য প্রতি বছর প্রায় ৪৬০ কোটি পোনার প্রয়োজন হয়। এর থেকে বর্তমানে হ্যাচারী থেকে প্রায় ১’শ কোটি এবং প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রায় ২’শ কোটি পেনা সরবরাহ হয়। আহরিত পোনার মৃত্যুহার ধরা হলে এ হিসেবে প্রতি বছর প্রায় ২’শ কোটিরও অধিক সংখ্যক পোনার ঘাটতি থেকে যায়। দেশের বাদগা চিংড়ি পোনার মোট চাহিদার প্রায়  ৭০ শতাংশ প্রয়োজন হয় খুলনা অঞ্চলে যার সংখ্যা প্রায় ৩২২ কোটি। এ অঞ্চলে প্রাকৃতিক উৎস্য ও হ্যাচারী থেকে মাত্র ৫৭ কোটি পোনা পাওয়া। ফলে এ অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পোনার ঘাটতি থেকে যায়। এ জন্য কক্সবাজার অঞ্চল হতে সড়ক ও আকাশ পথে খুলনা অঞ্চলে পেনা পরিবহন করা হয়ে থাকে। সড়ক পথে পরিবহনের সময় পোনার মৃত্যুর হার ৩০ শতাংশেরও অধিক। তাছাড়া খুলনা অঞ্চলের চাহিদার তুলনায় পরিবহনকৃত পোনা সংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল। যার ফলে প্রায় ক্ষেত্রেই খামারগুলোতে পোনা মজুদ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম হয় ও উৎপাদন ব্যাহত হয়। কক্সবাজার অঞ্চলেই মুলত বাগদা চিংড়ি হ্যাচারীগুলো অবস্থিত। বর্তমানে হ্যাচারীগুলো অতি সন্তোষজনক ও লাভ জনক উপায়ে  পোনা উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ শুরু হয়েছে। এ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে আকাশ পথে চিংড়ি পোনা পরিবহনের সৃষ্টি হবার কারণে। খুলনা অঞ্চলে চিংড়ি উৎপাদনের স্বার্থে গত কয়েক বছর থরে আকাশ পথে চিংড়ির পোনা পরিবহনের জন্য সরকার উদ্যোগ নেয়। ফলে বর্তমানে নিয়মিতভাবে দুটি ভাড়া করা বিমানে কক্সবাজার থেকে যশোর বিমান বন্দর পর্যন্ত আকাশ পথে পোনা পরিবহন করা হচ্ছে। যশোর বিমান বন্দর হতে তা ট্রাকযোগে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন খামারে পরিবহন করে নেয়া হচ্ছে। কক্সবাজার থেকে যাশোর হয়ে খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন চিংড়ি খামার পর্যন্ত পেনা পরিবহনে মোট সময় লাগে ৪-৪.৩০ ঘন্টা। এ প্রক্রিয়ায় পোনা পরিবহনের সময় মৃত্যুহার ২-৩ শতাংশ হয়ে থাকে। ফলে আকাশ পথে পোনা পরিবহন কার্যক্রম লাভজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। বিগত ফেব্র“য়ারী ৯৯ হতে ১৫ই জুন পর্যন্ত আকাশ পথে এ যাবৎ প্রায় ৫০-৫৫ কোটি পোনা পরিবহনের জন্য প্রতিটির জন্য ব্যয় হত ০.০৭ টাকা। কিন্তু পোনার মৃত্যুর হার বিচেনা করলে তুলনামুলকভাবে আকাশ পথে এ ব্যয় হচ্ছে ০.০৪ -০.০৫ টাকা। এ বছর খুলনা অঞ্চলের খামারগুলোতে পূর্বের তুলনায় পোনা মজুদের হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়। উন্নত পদ্ধিতিতে বাগদা চাষের জন্য যে খাদ্যের প্রয়োজন হয় তা সাধারণঃ পিলেটেড ফুড, যার প্রতি কেজির মূল্যের প্রায় ৪০ টাকা। দেশে বর্তমানে উন্নত প্রচলিত ও আধানিবিড় চাষের জন্য এ সকল খাদ্য ব্যবহার হচ্ছে।  তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্থায়ীভাবে তৈরী চিংড়ি খাদ্য ব্যবহার করা হয়। পোনা বাজারজাত করার সমস্যা-: খুলনা অঞ্চলে এ বছর প্রায় ৫ কোটি পোনা উৎপাদিত হয়েছে বলে জানা যায়। কক্সবাজার অঞ্চলে বর্তমানে যে ১৯টি হ্যাচারী রয়েছে। তাদের উৎপাদন ক্ষমতা যথেষ্ট না হলে ও অতি অল্প অবকাঠামোগত পরিবর্তন করে এর উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু কক্্রবাজার অঞ্চলে পোনার চাহিদার তুলনায় হ্যাচারী ও প্রাকৃতিক উৎস থেকে  যে পরিমাণ পোনা উৎপাদিত হয় তাতে এ অঞ্চলে বাড়তি থেকে যায়। কক্্রবাজার অঞ্চলের হ্যাচারীগুলোতে বিগত বছরের তুলনায় দ্বিগুণের চেয়েও বেশি পোনা উৎপাদিত হবে বলে হ্যাচারীগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এ বছর পোনার সংকট না থাকায় খামার মালিকেরা অল্প টাকায় পোনা পেয়েছে। একারণে এ বছর প্রকৃতি বৈরী না হলে তাদের উৎপাদন ও লাভ বেশি হবে বলে খামার মালিকদের আশাবাদ। 

0 comments:

Post a Comment