Friday, December 27, 2013

মাধ্যমিক বিদ্যালয় বাড়ছে ঃ কমছে উপবৃত্তি গ্রহণকারী

মাধ্যমিক বিদ্যালয় বাড়ছে  ঃ কমছে উপবৃত্তি গ্রহণকারী
ড. ফোরকান আলী
দেশের মাধ্যমিক শিা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে। আর কমছে উপ-বৃত্তি গ্রহণকারী ছাত্রীর সংখ্যা । গত ১২ বছরের জরিপ অনুযায়ী  প্রতি বছরই বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রীদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯৪ সাল থেকে মেয়েদের মধ্যে উপ-বৃত্তি দেয়া শুরু হয়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিন বছর বৃত্তি গ্রহণকারী ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়নি। এর মধ্যে তিন বছর বৃদ্ধির হার কমেছে। এক বছর বৃদ্ধির হার ছিল দশমিক পাঁচ ভাগ। ১৯৯৪ সালে  দেশে মাধ্যমিক শিা প্রতিষ্ঠান ছিল এক হাজার সাত শ’ ১৩টি (মাদ্রাসাসহ)। ওই সময়ে ৭০ হাজার আট শ’ ৮৬ জন ছাত্রীকে বৃত্তি দেয়া হয়। সরকারের এতে খরচ হয় ২৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। ১৯৯৫ সালে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পায় এক হাজার চার শ’ ছয়টি। বৃদ্ধির হার ছয় ভাগ। ওই বছর বৃত্তি পায় ১৪ লাখ নয় হাজার তিন শ’ ৮২ জন ছাত্রী। এতে সরকারের ব্যয় হয় ৮৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ১৯৯৬ সালে শিা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পায় দুই হাজার ছয় শ’ তিনটি। বৃদ্ধির হার ১৮ দশমিক ৪৪ ভাগ। ওই বছর বৃত্তি গ্রহণ করে ২৩ লাখ ৬২ জন ছাত্রী। এতে সরকারের ব্যয় হয় ১৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা।  ওই তিন বছর শিা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পেলেও বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রীর হার  এবং সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পায়নি। তবে সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৭ সালে শিা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পায় এক হাজার এক শ’ ২৫টি। বৃদ্ধির হার ছয় দশমিক ৭৩ ভাগ। বৃত্তি গ্রহণ করে ২৮ লাখ ২৫ হাজার তিন শ’ ৫০ জন ছাত্রী। এতে সরকারের ব্যয় হয় দুই শ’ ছয় কোটি ৫১ লাখ টাকা। এ বছর বৃত্তি গ্রহণকারী ছাত্রীর বৃদ্ধির হার ২০ দশমিক ৪৪ ভাগ। সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি পায় ২৪ দশমিক ২৭ ভাগ। ১৯৯৮ সালে শিা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পায় আট শ’ ৭৪টি। বৃদ্ধির হার চার দশমিক ৯ ভাগ। বৃত্তি গ্রহণ করে ৩১ লাখ ৯৮ হাজার পাঁচ শ’ ৫৯ জন ছাত্রী। বৃদ্ধির হার ১৯ দশমিক ৮০ ভাগ। সরকারের ব্যয় হয় দুই শ’ ৪০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পায় ২১ দশমিক ৪২ ভাগ। ১৯৯৯ সালে শিা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পায় ৬৭টি। বৃদ্ধির হার দশমিক ৩৬ ভাগ। ওই বছর বৃত্তি গ্রহণ করে ৩৫ লাখ ৬৪ হাজার চার শ’ চারজন ছাত্রী। বৃদ্ধির হার ১১ দশমিক ৬৩ ভাগ। সরকারের ব্যয় হয় দুই শ’ ৬৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। ব্যয় বৃদ্ধি পায় ১১ দশমিক ৩৩ ভাগ। ২০০০ সালে শিা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পায় এক হাজার এক শ’ ৩১টি। বৃদ্ধির হার ছয় দশমিক দুই ভাগ। বৃত্তি গ্রহণ করে ৩৯ লাখ ৬১ হাজার এক শ’ ৯৪ জন ছাত্রী। বৃদ্ধির হার তিন দশমিক ৩০ ভাগ। সরকারের ব্যয় দুই শ’ ৭৭ কোটি চার লাখ টাকা। ব্যয় বৃদ্ধির হার তিন দশমিক ৮৩ ভাগ। ২০০১ সালে শিা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পায় এক হাজার আটটি। বৃদ্ধির হার পাঁচ দশমিক ৫৬ ভাগ। বৃত্তি গ্রহণ করে ৪১ লাখ, ৯১ হাজার ৫৮ জন ছাত্রী। বৃদ্ধির হার নয় দশমিক সাত ভাগ। সরকারের ব্যয় হয় তিন শ’ তিন কোটি ৪৫ লাখ টাকা। বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়ায় এক দশমিক ১২ ভাগ।  ২০০২ সালে শিা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পায় এক হাজার আট শ’ ৬৬টি। বৃদ্ধির হার আট দশমিক ৮৭ ভাগ। ওই বছর বৃত্তি গ্রহণ করে ৪১ লাখ ৯৩ হাজার ৩৫২ জন ছাত্রী। বৃদ্ধির হার দশমিক পাঁচ ভাগ।  সরকারের ব্যয় হয় তিন শ’ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়ায় এক দশমিক ১২ ভাগ। ২০০৩ সালে শিা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পায় আট শ’ ২৬টি। বৃদ্ধির হার তিন দশমিক ৬১ ভাগ। বৃত্তি গ্রহণ করে ৩৪ লাখ ৬৭ হাজার ১২৩ জন ছাত্রী। বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়ায় ১৭ দশমিক ৩২ ভাগ। সরকারের ব্যয় হয় দুই শ’ ৪৫ কোটি নয় লাখ টাকা। বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৩২ ভাগ। ২০০৪ সালে শিা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পায় এক হাজার দুই শ’ ৩১টি। বৃদ্ধির হার পাঁচ দশমিক ১৯ ভাগ। বৃত্তি গ্রহণ করে ২৩ লাখ ৫৬ হাজার আট শ’ ৫৬ জন ছাত্রী। বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়ায় ৩২ দশমিক দুই ভাগ। সরকারের ব্যয় হয় ১৩২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়ায় ৪৬ দশমিক ৮৪ ভাগে। ২০০৫ সালে শিা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পায় চার শ’ ৭৫টি। বৃদ্ধির হার এক দশমিক ৯০ ভাগ। বৃত্তি গ্রহণ করে ২২ লাখ ৭০ হাজার তিন শ’ ৪৩ জন ছাত্রী। বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়ায় তিন দশমিক ৬৭ ভাগ। সরকারের ব্যয় হয় এক শ’ ৫৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। বৃদ্ধির হার ২০ দশমিক ৬৯ ভাগ। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম আসাদুজ্জামান বলেন, দেশে যে পরিমাণে শিা প্রতিষ্ঠান বাড়ছে সে তুলনায় মেয়ে শিার্থীর সংখ্যা বাড়ছে না। যার ফলে মেয়ে শিার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির হার সমানতালে বাড়ছে না। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, প্রতি বছর উপবৃত্তি গ্রহণকারী মেয়ের সংখ্যা কমে যাওয়া খুবই হতাশাজনক। তিনি বলেন, মেয়েদের শিার হার বাড়ানোর জন্য উপবৃত্তি দেয়াটা সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত। বৃত্তি গ্রহণকারী মেয়ের সংখ্যা কমে গেলে দেশ ও জাতিকে হতাশ হতে হবে। তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি, দিন দিন মেয়ে শিার্থী বৃদ্ধির হারও কমে যাচ্ছে। এটা কেন হচ্ছে তা অনুসন্ধান করা দরকার। তিনি বলেন, সরকারের উচিত যে কোন মূল্যে মেয়ে শিার্থীর সংখ্যা বাড়ানো।
যে কারণে উপবৃত্তির সুফল পাওয়া যাচ্ছেছ না: ১৯৯৪ সালে মাধ্যমিক স্তরে যখন উপবৃত্তি কার্যক্রম শুরু হয়, তখন এর উদ্দেশ্য ছিল নারীর মতায়ন, সকল দরিদ্র মেয়েকে শিার আওতায় আনয়ন ও ড্রপআউটের হার ক্রমান্বয়ে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা। এ ল্যকে সামনে রেখে ২০০৫-০৬ শিাবর্ষ হতে তিন বৎসর মেয়াদি উচ্চ মাধ্যমিক ছাত্রী উপবৃত্তিও চালু হয়। কিন্তু এতদিনেও উপবৃত্তি কার্যক্রমের কাঙিত সুফল পাওয়া যা্েচ্ছ না। সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার এন্ড টেকনোলজির একজন ভিজিটিং ফেলোর গবেষণায় দেখা যায়, ১৪ বৎসর পরও মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রী ড্রপআউটের হার প্রায় ৮৬ ভাগ। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উপবৃত্তি গ্রহণকারী মোট ছাত্রীর ৬০ ভাগই ঝরে পড়ছে। এদিকে গত তিন বৎসরে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে উপবৃত্তি খাতে ব্যয় করা হয়েছে ১৮৪ কোটি টাকা। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উপবৃত্তির ল্য-উদ্দেশ্য আশানুরূপ বাস্তবায়ন না হওয়ার মূল কারণ বিরাজমান শিার স্তরে স্তরে অবশ্যই দুর্নীতি। এহা ছাড়া সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, দারিদ্র্য, পাঠ গ্রহণে টিউটরের নির্ভরতা, শিকদের অবহেলাও সমভাবে দায়ী। উপবৃত্তি প্রদান কিংবা বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান প্রভৃতি সবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু এদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী হইতে শুরু করে যেখানে প্রায় সকলেই দুর্নীতিগ্রস্ত কিংবা দুর্নীতি মানসিকতার ব্যাধিতে আক্রান্ত।  সেকারনে  কোন উত্তম পদপেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আরও বলিতে হয়, দারিদ্র্যের কষাঘাত ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার শিকার ছাত্র-ছাত্রী উভয়েই। নূতন নিয়ম অনুযায়ী ‘প্রো-পুওর টার্গেটিং প্রোগ্রাম’-এর আওতায় মোট শিার্থীর ৩০ ভাগ ছাত্রী ও ১০ ভাগ ছাত্রকে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং অনেকে স্কুলের বিভিন্ন পাওনা পরিশোধ করছে না। এই অবস্থায় সার্বিক ড্রপআউট আরও কমপে ১০ ভাগ বাড়তে পারে বলিয়া আশংকা করা হচ্ছে। এসএসসি ও এইচএসসি এ দু’পর্যায়ে উপবৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রীদের ড্রপআউটের হার উদ্বেগজনক। এ দু’ স্তরের শিার্থীদের ব্যাপারেই দেশ ও জাতির প্রত্যাশা ব্যাপক। এ দু’স্তরে ড্রপআউটের হার অবশ্যই কমাতে হবে। নতুবা উপবৃত্তির কোন উপযোগিতা থাকে না। শিার বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির উচ্ছেদ অবশ্যই ঘটাতে হবে। জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকলেই তা বহুলাংশে সম্ভব। উপবৃত্তির সঠিক বাস্তবায়নে স্কুল-কলেজের শিক ও অভিভাবকদের আরও সচেতন হতে হবে। শিা প্রতিষ্ঠানে ঠিকমত পাঠদানের স্বার্থে গভর্নিং বডির ব্যর্থতাগুলো অচিরেই দূর করা প্রয়োজন। আমরা আশা করি, ড্রপআউট প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপ আরও দায়িত্ব জ্ঞানের পরিচয় প্রদান করবেন।

0 comments:

Post a Comment