শিক্ষা নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র রুখতে হবে
ড.ফোরকান আলী
যদিও একথা সবার জানা, আর যে জাতি শিায় যত অগ্রসর সে জাতি তত উন্নত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এ দেশে শিা নিয়ে বিভিন্ন ভাবে ষড়যন্ত্র চলছে। এমনকি প্রাথমিক শিা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, উচ্চশিা নিয়েও। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দাতা সংস্থার বিভিন্ন গবেষণার নামে এ শিা ব্যবস্থাকে কিভাবে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে, যা যে কোন বিবেকবান মানুষকে হতবাক নাকরে পারে না। একটি পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, প্রাইমারি পর্যায় থেকে যে সংখ্যায় ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া শুরু করে দেখা যায় এসএসসি পর্যায়ে গিয়ে সে সংখ্যা আর টেকে না। এ দৃষ্টান্ত বহু বছর ধরে চলে আসছে। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার তেমন হচ্ছে না। বিগত নির্বাচিত সরকারগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পন্থায় পদপে নিলেও তেমন আশানুরূপ ফল এখনো লাভ হয়নি। তাহলে সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠতে পারে প্রতি বছর এস এস সি ও সমমানের পরীায় এ সফলতা কিভাবে এল? সম্প্রতি কানাডার সাইমন ফ্রাজার ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট মিস জেনিফার হোভ বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিা নিয়ে গবেষণা করেন তাতে তিনি বলেন, মাধ্যমিক স্তরে ৮৩ ভাগ শিার্থীই ঝরে পড়ছে। তবে এর চেয়েও উদ্বেগজনক খবর হচ্ছে, প্রাথমিক শিা শেষ হওয়ার পর ৫৫ ভাগ শিার্থী মাধ্যমিক স্তরে পাই রাখে না। ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া ছাত্রীদের শতকরা মাত্র ১৪ জন আর ছাত্রদের মধ্যে ২০ জন অংশ নেয় এসএসসি পরীায়। শিােেত্র এ নাজুক অবস্থা সম্পর্কে গবেষকের মতামত হচ্ছে, দারিদ্র্য, অশিা, পাইভেট পড়া প্রথা, বাল্যবিবাহ, স্কুল ও আর্থ-সামাজিক প্রতিকূল পরিবেশ, স্বল্পসংখ্যক উপবৃত্তিসহ পারিপার্শ্বিক অবস্থা দায়ী। একথা বলার অপো রাখে না যে, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম একটি দরিদ্র দেশ। একমাত্র দারিদ্র্যের কারণে এ দেশ নানা বিষয়ে আজও পিছিয়ে আছে। শিা তার মধ্যে প্রধান। দুর্নীতি দূর না হলে, প্রশাসনে স্বচ্ছতা না এলে এ দেশের দারিদ্র্য দূর হবে না। দারিদ্র্য বিমোচন না হওয়া পর্যন্ত এ দেশে শিার হার বাড়বে না, শিােেত্র ঝরেপড়া বন্ধ হবে না। মিস হোভ তার গবেষণাপত্রে আরও একটি মূল্যবান তথ্য পরিবেশন করেছেন, মাধ্যমিক স্তরে শিার মানের কোনো উন্নতি হচ্ছে না। কারিকুলাম এবং ট্রেড ও ভোকেশনাল শিা এজন্য বিশেষভাবে দায়ী। এছাড়া শিা বা শিাপ্রতিষ্ঠান ও শিকের সুযোগ সুবিধার অতি কেন্দ্রীভূতকরণ, ব্যাপকভিত্তিক প্রশিতি ও যোগ্য শিকের অভাব এবং স্কুল ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতাও এেেত্র বিশেষ ভূমিকা রাখছে। মিস হোভ সুপারিশ করেন, ছাত্রীদের উপবৃত্তি লাভের জন্য পাস নম্বর ৪০ এবং প্রাথমিক ও গণশিা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিা অধিদফতরের সমন্বিত কর্মপ্রয়াস, স্কুলের একাডেমিক-আর্থিক কার্যাদি মনিটরিং ও মূল্যায়নের। আমরা মিস হোভের গবেষণাশ্রমকে সাধুবাদ জানাই। সেই সঙ্গে একথা জোর দিয়ে বলতে চাই, শিাসহ দেশের যে কোনো অগ্রগতি ও উন্নয়ন ঘটাতে চাইলে সবার আগে দারিদ্র্য বিমোচন করতে হবে। আর তÍারচেয়ে ও যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে, তা হলো শিকের শূন্যপদ গুলো পূরণ করা। অবাস্তব হলেও সত্যযে, বর্তমানে সারা বাংলাদেশে ৩১৭টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৩১৭টি প্রধান শিক/শিকিার পদের মধ্যে ১৯৯টি এবং সহকারী শিকদের ৪৮৫টি পদ শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যালয় প্রশাসন ও পরিদর্শন শাখায় ১০টি উপপরিচালকের মধ্যে ৯টি, ১৬টি বিদ্যালয় পরিদর্শক/পরিদর্শিকার মধ্যে ১০টি এবং ১৬টি সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক/পরিদর্শিকার মধ্যে ১৬টি শূন্য রয়েছে। এ চিত্রটি সামনে রাখলে সচেতন কোনো ব্যক্তির পইে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, মাধ্যমিক শিার উন্নয়নের েেত্র মূল প্রতিবন্ধকতা কোথায়। কিভাবে শিার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর মাধ্যমিক শিা চলছে? পাশাপাশি আমরা দেখছি ৩০/৩৫ বছর শিকতা করার পর একজন শিক সহকারী শিক হিসেবে অবসরে চলে যান। তার পদোন্নতি হয় না। কেন হয় না? ঐ শিকের কি পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্যতা নেই? আমরা জানতে চাই ১৯৯১ সাল থেকে সরকারি নিয়োগবিধির মাধ্যমে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যারা শিকতায় এসেছেন তাদের মধ্যে কমপে ৬০-৭০% ভাগ শিক রয়েছেন যাদের অনার্সসহ মাস্টার্স ডিগ্রি রয়েছে এবং অধিকাংশ শিকের ২/৩টি বা কারো ৪টিই প্রথম শ্রেণী রয়েছে। পাশাপাশি তাদের প্রায় সকলেই বিএড-এমএড ডিগ্রিসহ বিভিন্ন প্রশিণ রয়েছে। এতো যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা কেন পদোন্নতি এবং মর্যাদা বঞ্চিত? এজন্য কারা দায়ী? যে দেশে শিকের যোগ্যতার মূল্যায়ন হয় না, শিকদের পদোন্নতি নেই, সামাজিক মর্যাদা নেই, ন্যূনতম বেঁচে থাকার মতো বেতন নেই সে দেশে ুধার্ত শিকের কাছ থেকে তৃষ্ণার্ত শিার্থীর জন্য কি পেতে পারি ? এতো লাঞ্ছনা-বঞ্চনা এবং অধিকার বঞ্চিত হয়েও শিকরা তাদের পেশার প্রতি আন্তরিক। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এসএসসির ফলাফলই তার প্রমাণ। পত্রিকায় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিকদেরকে কোচিং/ টিউশনি নিয়ে ঢালাওভাবে অভিযুক্ত করা হলো। শুধু কি সরকারি হাইস্কুলের শিাকরাই টিউশনি করেন? সরকারি-বেসরকারি কলেজ এবং বেসরকারি হাইস্কুলের শিকদের কথা কেন বলা হয় না? আমরা বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাইÑ কোনো শিকই বিদ্যালয়ে ৬-৭ ঘন্টা কাস নেওয়ার পর স্বেচ্ছায় টিউশনি করতে চায় না। টিউশনি করে বাধ্য হয়ে। পরিবার বর্গকে নিয়ে বেঁচে থাকার মতো বেতন স্কেল দিয়ে সরকার আইন করে কোচিং ব্যবসা এবং টিউশনি বন্ধ করতে পারেন। এ ব্যাপারে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এখানে ও শেষ নেই, এছাড়া ও বহু ভাবে চলছে দেশের শিা ব্যবস্থা নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র। বিভিন্ন কলা কৌশলে শিা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার চেষ্টাও চলছে। বর্তমানে এসএসসি পরীায় খারাপ ফলাফলের অজুহাতে সারা দেশের ৩১৩টি মাধ্যমিক শিা প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। এই সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা ইতিমধ্যে পৌঁছেছে দেশের ব্যাংকগুলোতে। জুলাই মাসের বেতন-ভাতা উত্তোলন করতে গিয়ে বিষয়টি জানতে পারেন শিকরা। তবে বোর্ড কর্তৃপ এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন। বিষয়টি সম্পর্কে শিকেরা ব্যাংক কর্তৃপরে কাছেই প্রথম জানতে পারেন। ব্যাংক কতৃপ শিকদের জানান, শিা মন্ত্রণালয়ের সহকারী পরিচালক মোঃ আনোয়ারুল হোসেন স্বারিত দুটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ১৭ জুন থেকে দেশে ৩১৩টি শিা প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ঢাকা বোর্ডে ৫৫টি, রাজশাহীতে ১০৫টি, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা বোর্ডে ৪৭টি, বরিশাল শিা বোর্ডে ৭৪টি, যশোর শিা বোর্ডে ১৭টি এবং সিলেট শিা বোর্ডে ১৫টি স্কুল রয়েছে। পরবর্তী সময়ে নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এদের বেতন-ভাতা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। ২০০৬ সালের এসএসসি পরীায় পাশের হার শূন্য এবং মাত্র ৫ জন পরীার্থী অংশ নেওয়া শিা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিঠি দেয় সরকার। পৃথক দুটি নির্দেশনা উল্লেখ করে দেওয়া ওই চিঠিতে ফলাফল খারাপ এবং শিার্থী কম থাকার বিষয়ে কারণ দর্শাতে বলা হয়। চিঠির জবাব দেওয়ার পর পাশের হার শূন্য থাকা ৩১৩টি শিা প্রতিষ্ঠানসহ ৭শ’র বেশি মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। এই সংক্রান্ত চিঠিও দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট শিা বোর্ডগুলোতে। চিঠি পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট শিা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তা পাঠিয়ে দেয় শিা বোর্ড। এরপর আর এ ব্যাপারে নতুন কোনো খবর জানতে পারেনি কেউ। এদিকে জুলাই মাসের বেতন উত্তোলনের জন্য বিল তৈরির ব্যাংকে গিয়ে বেশ কয়েকটি শিা প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা জানতে পারেন যে তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শিা মন্ত্রণালয় থেকে আসা চিঠির বরাত দিয়ে তাদেরকে এই তথ্য জানান ব্যাংক কর্মকর্তারা। শিকেরা স্ব-স্ব শিা বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করেও এ ব্যাপারে বোর্ড কর্তৃপরে কাছ থেকে কোন তথ্য জানতে পারেনি। আমরা আশাকরি নবনির্বাচিত সরকার শিার প্রতি সুনজর দিয়ে এ দেশের শিা ব্যবস্থাকে বাঁিচয়ে রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবেন।
Friday, December 27, 2013
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment