Monday, March 5, 2018

কাগজ শিল্পের সম্ভানা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

 কাগজ শিল্পের সম্ভানা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
আলী ফোরকান 
কাগজ বর্তমান সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ শিল্প পণ্যেরএকটি। বই, ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র, ইত্যাদি ছাপার অপরিহার্য উপাদান কাগজ। লেখার অন্যতম উপকরন ছাড়াও কাগজের হাজারো ব্যবহার রয়েছে। লেখা ও ছাপার কাগজ না থাকলে শিক্ষা, শিল্প কারখানা, সরকার ও অচল হয়ে পড়বে। পৃথিবীর প্রতিটি সভ্য দেশে কাগজের ব্যবহার রয়েছে। কাগজ ছাড়া সভ্যতাকে কল্পনা করা যায়না। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর এদেশে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কাগজ শিল্পের বিকাশ ঘটে। ৫০ এর দশকে স্থাপিত কর্ণফুলী পেপার মিল ও খুলনা মিল থেকে সারা দেশে কাগজের চাহিদা মেটানো যেত। কালক্রমে কাগজের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ৬০ এর দশকের শেষের দিকে নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্বাধীনতার পর ‘সিলেট পাল্প এন্ড পেপার মিল’ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে স্থাপিত এক মাত্র কাগজ কল। বর্তমানে রাষ্ট্রয়ত্ত খাতে ৩ টি কাগজ কল ছাড়াও বেসরকারি মালিকানাধীন ছোট-বড় বহু কাগজ কল রয়েছে। এ সব মিলে বিদেশ থেকে মন্ড আমদানি এবং ছেঁড়া বা পুরানো কাগজ রিসাইক্লিং করে কাগজ তৈরি করে। 
কাগজ তৈরির ইতিহাস: কাগজের ইংরেজী প্রতি শব্দ পেপার।প্যাপিরাস থেকে পেপার শব্দ টি এসেছে। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার মানুষেরা নীল নদের তীরে জন্মানো প্যাপিরাস নামক এক প্রকার গাছের ছাল শুকিয়ে লেখার কাজে ব্যবহার করতো। কিন্তু বর্তমানে আমরা যে ধরণের কাগজের সাথে পরিচিত তার আবিস্কার চীনে, ১০৫ খ্রীষ্টাব্দে। সম্রাট হোতাই-এর রাজ কর্মচারী সাইলুন প্রথম কাগজ তৈরি করেন। তিনি এ কাজের জন্য তুঁতগাছের ভেতর থেকে আঁশ সংগ্রহ করেন। পরে চীনারা আরো বহুবিধ উপকরণ থেকে কাগজ তৈরির প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেন। তারা পুরানো মাছ ধরার জাল থেকেও কাগজের মন্ড তৈরি করে। চীনাদের কাছ থেকে কাগজ তৈরির শিল্প সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। মধ্য এশিয়া জয়ের পর মুসলিম বণিকেরা (চীনদের কাছ থেকে) কাগজ শিল্প বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করে। ৭৯৫ খ্রীষ্টাব্দে বাগদাদে প্রথম কাগজ শিল্প স্থাপিত হয়। মুসলমানদের শিল্পের প্রভূত উন্নতি ঘটে। আরবদের উত্তর আফ্রিকা অভিযান ও খৃষ্টানদের ক্রুসেডের মধ্যদিয়ে আফ্রিকা ও ইউরোপে কাগজ প্রস্তুত প্রণালী রফতানি হয়। ১৬৯০ সালে ফিলাডেলফিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কাগজকলটি স্থাপিত হয়। সে সময় পর্যন্ত কাগজ তৈরি হতো আলাদা আলাদা শীটে। ১৭৯৮ সালে নিকোলাসলুইস রর্বাট নামে এক ফরাসী দীর্ঘ রোল-এর আকারে কাগজ তৈরির যন্ত্র আবিস্কার করেন। তখন এই যন্ত্রটির নামকরণ করা হয় ফোরড্রাইনার মেশিন। ১৮২৭ সালে যুক্ত রাষ্ট্রে প্রথম এই যন্ত্র তৈরি হয়। কাগজের মন্ড তৈরির ব্যাপক ব্যবহৃত স্টোন গ্রাউন্ড পদ্ধতি আবিস্কৃত হয় ১৮৪০ সালে জার্মানীতে। ১৮৫৪ সালে ইংল্যান্ডে রাসায়নিক পদ্ধতিতে মন্ড তৈরির প্রক্রিয়া আবিস্কৃত হয়। ১৮৫০ এর দশকে র্মাকিন রসায়নবিদ বেনজামিন টিলগম্যান সালফিউরাস এসিডের মাধ্যমে কাঠের আঁশ পৃথক করার পদ্ধতি আবিস্কার করেন। ১৮৮২ সালে কাঠের মন্ড তৈরিতে  ব্যাপকভাবে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৮৮৩ সালে র্জামান বিজ্ঞানী কার্লডাল আবিস্কার করেন যে, মন্ড তৈরিকালে সোডিয়াম সালফেট যুক্ত করা হলে আঁশগুলোর রাসায়নিক বন্ধন খুবই দৃঢ় হয়। এই আবিস্কারের নাম হয় ‘ক্রাফট প্রক্রিয়া’। র্জামান ভাষায় ক্রাফট মানে শক্তিশালী। ১৯০০ সালের শুরু থেকেই ক্রাফট পক্রিয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রণালী হিসেবে আবির্ভূত হয়। ‘ফোরড্রাইনার’ এই যন্ত্রটি কাগজ প্রস্তুতের প্রাথমিক হাতিয়ারে পরিণত হয়। বর্তমান যুগে কাগজ প্রস্তুত প্রণালীতে অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে। থার্মো মেকানিকাল পাল্পিং, সিনথেটিক ওয়ারস এন্ড ফেল্টস, টুইন-ওয়ার মেশিন ইত্যাদি অত্যাধুনিক পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে কাগজ তৈরির কাজে। ব্যবহৃত হচ্ছে কম্পিউটার। কম্পিউটারের মাধ্যমে কাগজের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। 
কাগজ তৈরির উপকরণ: পৃথীবির বিভিন্ন দেশে হাজারো রকমের ও মানের কাগজ তৈরি হচ্ছে। উপাদান ও প্রস্তুত প্রণালীর উপর কাগজের মান নির্ভর করে। কাগজ তৈরির উপাদান মূলত সেলুলাসযুক্ত আঁশ। প্রতিটি গাছের কোষ প্রাচীরে এই রাসায়নিক উপাদানটি বিদ্যমান। পানির সাথে মিশিয়ে এই আঁশ মসৃণ জালির উপর দিয়ে প্রবাহিত করলে আঁশগুলো পরস্পর যুক্ত হয়ে কাগজে রুপ নেয়। শুকানোর পর কাগজের রাসায়নিক উপাদানগুলো দৃঢ়ভাবে পরস্পর যুক্ত হয়। বিভিন্ন উৎস থেকে কাগজ তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করা হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে বাশঁ, কাঠ, তুলা, আখের ছোবরা, শন, ধান ও গমের বিচালী ইত্যাদি। তবে কাগজ তৈরিতে কাঠ সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়।  বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের বর্তমান তিনটি কাগজ কল ভিন্ন ভিন্ন কাঁচামাল ব্যবহার করে কাগজ উৎপাদন করে। কর্ণফুলী পেপার মিলে কাগজ তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয় বাঁশ। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিপুল বাঁশ সম্পদকে সামনে রেখে এই মিলটি তৈরী করা হয়েছে। পাবনার নর্থবেঙ্গল পেপারমিল তৈরী হয়েছে উত্তর বঙ্গের চিনি কলগুলোর উদ্বৃত্ত আখের ছোবড়াকে সামনে রেখে। সুনামগঞ্জের ছাতকে সিলেট পাল্প ও পেপার মিলটি তৈরি হয়েছিল নলখাগড়াকে সামনে রেখে। এখন নলখাগড়া মওজুদ শেষ হয়ে যাওয়াতে বাঁশ ও গাছের উপর নির্ভর করে চলছে। বেসরকারি খাতের মিলগুলো গড়ে উঠেছে বিদেশী পাল্প এবং ছেড়া ও পুরানো কাগজকে অবলম্বন করে। এই পাল্প ও পুরানো কাগজ দিয়ে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের কাগজ ও বোর্ড মিল।
 বনজ সম্পদের দিক থেকে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ নয়। ফলে কাঁচামাল সংকটের কারণে বড় বড় কাগজের কলগুলো বিপর্যয়ের সম্মূখীন হয়। এছাড়া মিলগুলো তৈরির করার সময় কাঁচামাল প্রাপ্তির যে হিসেব করা হয়েছিল তা যথার্থ ছিলনা। একারণে নর্থ বেঙ্গল পেপার মিল ও সিলেট পাল্প এন্ড পেপার মিল প্রায় সময় কাঁচামালের সংকটের কারণে উৎপাদনে বিঘœ ঘটে। ফলে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এদু’টি মিল কোন সময় লাভের মুখ দেখেনি। বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি কাগজ কলগুলোতে যে কাগজ উৎপাদিত হয় তা চাহিদার চেয়ে অনেক কম। উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ কাগজ উৎপাদনে অনেক পিছিয়ে।
কাঁচা পাট থেকে কাগজ তৈরি: ১৯৯৪ সালের জুলাই মাস থেকে দেশের ৩টি রাষ্ট্রায়াত্ত কাগজ কল কাঁচা পাট থেকে কাগজ তৈরি শুরু করে। দীর্ঘকাল ধরে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে কাগজ তৈরির পরিবর্তে কাঁচা পাট ব্যবহার লাভজনক বিবেচনা করে এই প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে পরবর্তী ৭ বছরে কাঁচা পাট থেকে ৬ লাখ ৯৮ হাজার মেট্রিক টন কাগজের মন্ড উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কাগজ তৈরিতে বাঁশ ও কাঠের উপর চাপ কমাতে এবং প্রতি বছর মন্ড আমদানিতে বিপুল অর্থ ব্যয় পরিহারের উদ্দেশ্যে কাঁচা পাট থেকে মন্ড তৈরির সম্ভাবনাময় এই প্রকল্পটি হাতে নেয়। ১৬.৬৬ মেট্রিক টন সবুজ পাট থেকে এক মেট্রিক টন পাটের আঁশ হয়। আর ১ টন মন্ড তৈরিতে সবুজ পাটের প্রয়োজন হয় মাত্র ৫.৩ মেট্রিক টন। 
কচুরীপানা থেকে কাগজ ও মন্ড: কচুরীপানা থেকে কাগজের মন্ড ও উন্নত মানের কাগজ উৎপাদন করা যেতে পারে। কচুরীপানা থেকে উৎপাদিত কাগজ আমদানিকৃত কাগজের চেয়ে কোন অংশ কম নয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা ইতিবাচক ফলাফল পেয়েছেন। তাদের মতে, কচুরীপানা থেকে উৎপাদিত মন্ড দিয়ে উন্নতমানের কাগজ তৈরি সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন। এতে খরচও তুলনামূলক কম হবে। দেশে অসংখ্য হাওর, বিল ও পতিত জলাশয় রয়েছে। এগুলোতে পরিকল্পিতভাবে কচুরীপানার চাষ হলে এর সরবরাহেরও কোন ঘাটতি থাকবেনা। এতে করে দেশের বাঁশ ও গাছের উপর যে চাপ পড়েছে তাও রোধ করা সম্ভব হবে। কচুরীপানা থেকে মন্ড তৈরীর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোন যন্ত্রপাতি লাগবেনা। সবুজ পাট থেকে যে প্রক্রিয়ায় মন্ড তৈরি হয় প্রায় একই প্রক্রিয়ায় কচুরীপানা থেকে মন্ড তৈরী করা যায়। কোন চাষাবাদ ছাড়াই দেশের হাওর-জলাশয়ে প্রচুর পরিমাণ কচুরিপানা জন্মে। পরিকল্পিতভাবে কচুরিপানা চাষ করলে অত্যন্ত সহজে প্রয়োজনীয় কচুরীপানা উৎপাদন সম্ভব হবে। মোট কথায় বাংলাদেশে কাগজ শিল্পের উজ্জল সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের সামগ্রিক শিল্পখাতে কাগজ শিল্পের ৪.৬৫ ভাগ অবদান রয়েছে। ৫০ এর দশকে বাংলাদেশে যখন কাগজ শিল্পের সূচনা হয় তখন এর সাফল্য ছিল উল্লেখ করার মতো। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী কাগজ শিল্পকে জাতীয়করণ করায় বিভিন্ন দলাদলীর কারণে লোকসানের শিকার হয়। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে বেসরকারি খাতে কাগজ কল গড়ে উঠতে শুরু করে। কিন্তু যে আমদানি নীতি ও শুল্ক কাঠামোকে সামনে রেখে স্বল্প সময়ে কাগজ কল গুলো গড়ে উঠেছিল আকস্মিক সে নীতিকে পরিবর্তন করা হয়। এতে বিকাশমান একটি শিল্প রুগ্ন খাতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এরপর ও কাগজ শিল্পের সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে এমন ধারণা করার কোন কারণ নেই। তবে এর সাফল্য সরকারের ইতিবাচক নীতি ও কৌশল গ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। দেশের উন্নয়নের সাথে কাগজ যেমন ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, তেমনি কাগজ শিল্পের অগ্রগতির সাথে জাতীয় স্বার্থও সম্পৃক্ত। এব্যাপারে সরকারকে যেমন দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে, তেমনিভাবে শিল্পোদ্যোক্তদেরও  নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে নিজেদের।   

0 comments:

Post a Comment