শিক্ষার আলো প্রস্ফুটিত হউক সবার ঘরে ঘরে
আলী ফোরকান
শিক্ষা শেকড়ের রস। তেতো হলেও এর ফল কিন্তু মিষ্টি। রবীন্দ্রণাথের এ শিক্ষা সম্পর্কিত বাণী- প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সব শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একুশ শতকে এসে শিক্ষা, শিক্ষা কাঠামো,শিক্ষা ভাবনায় যেমন পরিবর্তন এসছে তেমনি বৈশ্বিক শিক্ষার প্রেক্ষাপটও নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। আর ভাবনা এসেছে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ ও বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে। আর বিশ্বায়নের মোকাবিলা করতে প্রয়োজন জীবনমুখী কর্মমুখী সুশিক্ষা। কারণ জীবনমুখী কর্মমুখী সুশিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত। বর্তমান বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে শিক্ষা এবং প্রযুক্তির অভিনব আবিষ্কার দিয়ে। শিক্ষা ছাড়া প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। সমাজ সভ্যতার ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। ব্যক্তি বা সমাজ উন্নয়নে, ব্যক্তির প্রত্যাশা পূরণে শিক্ষা শক্তিশালী হাতিয়ারের ভ‚মিকা রাখছে। পূরণ করছে দ্রæত বিকাশ মান সামাজিক চাহিদা। আজকের দিনে শিক্ষা বিবেচিত হচ্ছে একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ বিজ্ঞান রূপে। শিক্ষা অভিহিত হচ্ছে ‘শিক্ষা বিজ্ঞান’ নামেও। শিক্ষা আসলে কি? শিক্ষার উদ্দেশ্যই বা কি? কিভাবে একে সঙ্গায়িত করা যায়? জ্ঞানকে কাজে লাগাবার কৌশল বা শক্তি অর্জনই শিক্ষা। এ শক্তি অর্জন করার জন্যই স্কুল-কলেজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদান করা হয়। এতে পশ্চাৎপদ, অসংগঠিত জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী মানব সম্পদে রূপান্তরিত করা যায়। শিক্ষা বলতে তাই সবসময় কাক্সিক্ষত পরিবর্তনকে বুঝায়। যে শিক্ষা সামাজিক পরিবর্তনে সাহায্য করে না তাকে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা বলা যায় না। শিক্ষার উদ্দেশ্য ব্যক্তি সত্তার বিকাশ সাধন। শিশুর সমর্থনযোগ্য আচরণের পরিবর্তনকে শিক্ষার উদ্দেশ্য বলা যেতে পারে। এবার দেখা যাক শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি কোথায়? শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ভ‚মি হলো প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মূল ভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষা। শিক্ষাদান এবং গ্রহণের সবচে গুরুত্বপূর্ণ ¯Íর হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের শিক্ষা দেয়া। এ ¯Íরের শিশুকে শিক্ষা দান বড় জটিল ও কঠিন কাজ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগমন প্রত্যেক শিশুর জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কেননা এ সময়ে শিশু তার আপন পরিচিত ভুবন থেকে সম্পূর্ণ নতুন এক ভুবনে প্রবেশ করে। একান্ত প্রিয়জন আব্বা-আম্মা-ভাইবোন ছেড়ে দিনের কিছুটা সময় তাকে কাটাতে হয় অপরিচিত জনের সান্নিধ্যে। তখন সেই পরিবেশ পরিজন তার কাছে সহজ স্বাভাবিক না লেগে বিরূপ লাগাই স্বাভাবিক। শিশুর এই মানসিক অবস্থা অনুধাবন করে যিনি তাকে স্বজন প্রিয়জনের মত কাছে টেনে নেন সস্নেহে, তিনি তার শিক্ষাগুরু, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। যাঁর কথা সে সারাজীবন বুকের গভীরে লালন করে এক স্বপ্নীল আবেশে। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে হতে হবে যাদুকরের মত, হেমিলিয়নের বংশী বাদকের মত। তিনি হবেন মজার মানুষ। শিশুর বিদ্যালয়ে অবস্থানের প্রতিটি মুহূর্তকে তিনি করবেন স্বপ্নের মুহূর্ত। প্রতিটি দিন করবেন নতুন সূর্য উদয়ের দিন। তাঁর স্নেহ-মায়া-মমতা, জ্ঞানদানের ধরণ শিশুকে এতটাই মুগ্ধ করবে যে বিদ্যালয় শিশুর কচি মনে ফুটে উঠবে রঙিন ফুলের মতো। শিশু ভাববে আমাদের স্কুল- স্বপ্নের এক রঙিন ফুল। তার ভাবনাকে প্রসারিত করে শিক্ষক বুঝিয়ে দেবেন বিদ্যালয় কেবল যেন তেন স্থান নয়। এটা পবিত্র শিক্ষাঙ্গন। এখানে সভ্যতার ফুল ফুটানো হয়- এখানে প্রতি ভোরে নতুন সূর্যোদয়। এ কাজ শাসনে নয়- করতে হবে স্নেহের আন্তরিকতায়। যিনি যতটা সফলভাবে করতে পারবেন তিনি হবেন ততটা সফল শিক্ষক। শিক্ষকগণই হবেন আদর্শ শিশু-শিক্ষার্থী সৃষ্টির মহান দায়িত্ব পালনের দিশারী। প্রাথমিক শিক্ষা যেহেতু সকল শিক্ষার মূল ভিত্তি- যেহেতু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে জাতির প্রত্যাশাও প্রচুর। কেননা তাঁরা মানুষ গড়ার কারিগর- ফুল ফুটাবার মালাকার। জাতিকে নির্মাণ করেন, মেধাকে সৃজন করেন তাঁরা। তাঁদের কর্ম দিয়ে মেধা এবং প্রতিভার স্ফ‚রণ ঘটান। প্রাথমিক শিক্ষকগণ কি পারছেন সে আশা পূরণ করতে? যদি না পারেন তবে দুর্বলতা কোথায়? খতিয়ে দেখতে হবে অপারগতার মূল কারণ। বিদ্যালয় যতই সাজানো-গুছানো হোক না কেন- শিক্ষক যদি সুশিক্ষক না হন তবে সব প্রচেষ্টাই পানিতে পড়তে বাধ্য। তাই সর্বাগ্রে সচেষ্ট হতে হবে সুশিক্ষক নিয়োগে ঘুষ গ্রহণ এবং অন্য চাপের মুখে সুশিক্ষক নিয়োগ কষ্টকর দুর্নীতির দুষ্টবলয়ের প্রভাব মুক্ত হয়ে এই পদক্ষেপ নিতে হবে। নিয়োগ করতে হবে সত্যিকার যোগ্যতম শিক্ষককে আদর্শ নীতিমালার মাধ্যমে। যোগ্যতম শিক্ষক হবেন প্রজ্ঞাবান, সদালাপী, মিষ্টভাষী, চরিত্রবান সর্বোপরি স্নেহ প্রবণ। শিশুদের ভালবাসার গুণ থাকতে হবে তার। এসব মানবিক গুণাবলী ছাড়াও যোগ্যতম শিক্ষক হবেন ট্রেনিং প্রাপ্ত ব্যক্তি। শিক্ষাদানে যার থাকবে যথাযথ প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ মানুষকে পূর্ণ করে। শিক্ষক যদি হন একজন পূর্ণ মানুষ তা হলে তিনি দিতেও পারবেন পরিপূর্ণ ভাবে। খন্ডিত মানুষ পূর্ণতা দিতে পারেন না। বৈষম্য কখনই ভাল ফল বয়ে আনতে পারে না। শিক্ষকে শিক্ষকে বৈষম্য সৃষ্টি হোক তা কেউ চাইবেন না। প্রয়োজনে একই ক্যাটাগরির শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। শিক্ষকদের মধ্যে ভেদাভেদের দেয়াল তুললে শিক্ষার মানের হেরফের হবেই। বাংলাদেশে সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা আজও সম্ভব হয়নি। তাই মানসম্মত শিক্ষার একটি মাপকাঠি ঠিক করা। এর প্রয়োগর ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে দক্ষ শিক্ষক তৈরি, প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ এবং এর জন্য প্রশিক্ষণ, গবেষণা, মূল্যায়ন ও সংশ্লিষ্ট মহলের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক একথা এখনও গ্রামের অনেক অভিভাবক জানে না- জানলেও মানে না। তাই সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠায় না- সন্তান উদ্দেশ্যহীন জীবন যাত্রায় ছন্নছাড়া হয়ে যায়। নিজের জীবন নষ্ট করে তাদের পাল্লায় পড়ে অন্যরাও উচ্ছন্নে যায়। ছোট থেকে বড় হয়ে সে সন্তান আর সমাজের জন্য ভাল কিছু করতে পারে না। বখাটে মা¯Íান হয়ে পরিবারের, সমাজের তথা দেশের ঘাড়ে বোঝা হয়। এজন্য আর্থসামাজিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে সব অভিভাবকের উচিত সন্তানকে স্কুলে পাঠানো এবং স্কুল থেকে কোথায় যায় না যায় বা সে কেমন পড়ালেখা করেছে তা শিক্ষকের কাছ থেকে জেনে নেয়া। কোন অবস্থাতেই যেন ছাত্র স্কুল থেকে ঝরে না পড়ে সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখা। তবে অনেক সময় উপবৃত্তিও শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অধিকাংশ সময় উপবৃত্তি প্রাপ্ত স্কুলের শিক্ষকদের এ মহান দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে লাঞ্জিত হতেও হচ্ছে। কারণ হিসেবে জানাযায়, যে সব শিক্ষার্থী উপবৃত্তির সুবিধাভোগী নয় সে মনে করে তার স্কুল শিক্ষকেরা তাকে দিচ্ছে না। অথচ সরকার তার জন্য ও উপবৃত্তি দিচ্ছে। এছাড়া অনেক শিক্ষার্থী যারা নিয়মিত স্কুলে অনুপস্থিতির কারণে অথবা ফলাফল বিপর্যয়ের কারণে উপবৃত্তি থেকে বঞ্চিত হয়। এসব শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা মনে করেন,স্কুল কতৃপক্ষসহ শিক্ষকেরা এ টাকা আত্মসাৎ করেছে। এ সব কারণে অনেক সময় সুবিধাভোগী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকের সাথে শিক্ষকদের বচসার মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। যে কারণে এসব শিক্ষার্থী ও শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা শিক্ষকদের বন্ধুর পরিবর্তে দোসর ভেবে থাকেন। এসব কারণে ও অনেক সময় শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ে। এর পর ও সবাইকে মনেপ্রাণে চাইতে হবে সম¯Í প্রতিক‚লতা কাটিয়ে দেশে শিক্ষার মান বাড়–ক, বাড়–ক শিক্ষার হার। অগণিত শিক্ষার্থী সম¯Í অন্ধকার, বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে ফুলের মত প্রস্ফুটিত হোক। যারা তাদের ফুটিয়ে তুলবেন তারা মনে রাখবেন শুধু লৌকিক আচার, মৌখিক কথা, পুথিগত বাক্যে নয়- শিশু শিক্ষার্থীকে স্নেহে সোহাগে শিক্ষাদানের তাগিদ ধর্মেও দেয়া হয়েছে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) বলেছেন, “শিশুরা আলøাহর ফুল।” (তিরমিযি শরীফ)। আবারও শিক্ষকের কাছেই আবেদন এ ফুলকে আন্তরিকতা দিয়ে, চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে সৎ গুণাবলীর ধারক-বাহক করে ফুটিয়ে তুলুন। দেশ ও জাতির কল্যাণ করে আপনার মহান পেশাকে আরো সমুন্নত করুন, নিজে হউন আরো মহৎ। তবেই সুশিক্ষার আলো প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠবে সবার ঘরে ঘরে।
0 comments:
Post a Comment