নারী ও শিশু পাচার প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
আলী ফোরকান
নারী ও শিশু পাচার একটি ঘৃনীত সামাজিক অপরাধ। এসমস্যা আজ শুধু বাংলাদেশের একার নয়। এ সমস্যা আর্ন্তজাতিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। নারী ও শিশু পাচার এখন তিনটি বৃহৎ অবৈধ ব্যাসার একটি। মাদক ও অস্ত্রের অবৈধ ব্যাবসার পরই নারী ও শিশু পাচারের ব্যাবসার অব¯থান। জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রন ও অপরাধ নিরোধ সংস্থা (ঙউঈঈচ)-এর রিপোর্ট মতে পাচারকারী চক্র প্রতি বছর আন্তর্জাতিক সীমান্ত দিয়ে ৪০লক্ষ নারী-পুরুষ পাচার করে ৭০০কোটি ডলার মুনাফা করে থাকে। নারী ও শিশু পাচার দেশের গন্ডি পেরিয়ে আজ বৈশ্বিক অন্যতম বৃহৎ এক সমস্যায় পরিণত হয়েছে।
নারী ও শিশু পাচার প্রেক্ষিত বাংলাদেশঃ ২০০৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ইউএনএফপি এর বাংলাদেশের প্রতিনিধি প্র“নচাই ও আন্তর্জাতিক মাইগ্রেশন সংস্থার আঞ্চলিক প্রতিনিধি শহিদুল হক সারাবিশ্বে এক যোগে প্রকাশিত জাতিসংঘ জনসংখ্যা রিপোর্ট সিরডাপ অডিটেরিয়ামে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করে। রিপোর্টে বলা হয় ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৫ সাল পযর্ন্ত সিঙ্গাপুরে ১৪৭ জন অভিবাসী গৃহপরিচারিকা মারা গেছেন কিংবা আতœহত্যা করেছেন। ২০০৪ সালে সউদী আরব থেকে ১৯ হাজার গৃহপরিচারিকা চাকরিদাতাদের হাত থেকে পালিয়েছেন। রিপোর্টে আরো বলা হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে যাওয়া মহিলাদের বেশির ভাগ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার। এ অঞ্চলের দেশ থেকে পাচারকৃত মহিলার সংখ্যা ২ লাখ ২৫ হাজার। তবে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া নারী অভিবাসী সম্পর্কে কোন তথ্য নেই জাতি সংঘের জনসংখ্যা তহবিল রিপোর্টে। বরং বলা হয়েছে তরুণ-তরুণী,কিশোর-কিশোরী যে দেশে পাচার হয় তারা সে দেশের সম্পদ। (তথ্য সুত্র, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ৭ সেপ্টেম্বর-০৬)
সেন্টার ফর উইমেন চিলড্রেন ষ্টাডিজ(ঈঙডঈঝ) নামক সংস্থার ২০০০ সালের রিপোর্টে মতে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২ লক্ষাধিক নারী ভারতসহ প্রতিবেশী দেশসমূহে পাচার হয়েছে।এর মধ্যে শুধু ভারতেই ১ লাখ ৬০ হাজার পাচার হয়েছে। তাদের সুত্র মতে কলকাতার যৌনকর্মীদের ১৪ শতাংশই বাংলাদেশী।
মার্কিন ষ্টেটস ডিপার্টমেন্টের ২০০২ সালের বার্ষিক রিপোর্টে বাংলাদেশকে নারী ও শিশু পাচারের ১টি উৎস দেশ হিসেবে চিহিৃত করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয় গড়ে প্রতিদিন এ দেশ থেকে ৫০ জন শিশু ও নারী বিদেশে পাচার হচ্ছে। আর প্রতি বছর ৫-১৫ হাজার কিশোরী ও নারী ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাচার হয়। এশিয়ার নারী পাচারের দ্বিতীয় উৎসস্থল বাংলাদেশ বলে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশের নারী-শিশুরা কিভাবে পাচার হয়ঃ
মূলত বাংলাদেশের নারী ও শিশুরা ভারতসহ অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে পাচার হচেছ। এ পাচারের প্রধান ট্রানজিট পয়েন্ট হলো ভারত। মুম্বাই হচ্ছে নারী ও শিশু পাচারের অন্যতম একটি ঘাঁটি। সেখান থেকে এদের মধ্যপ্রাচ্য, শ্রীলঙ্কা ও ইউরোপে পাচার করা হয়ে থাকে। এসব দেশে পাচারকৃত নারীদের দেহব্যবসা, দাসত্ব থেকে শুরু করে আরো নিকৃষ্ট সব কাজে লাগানো হয় জোর করেই। ভারতে পাচার হওয়ার পর, দেশে ফেরত আসা রাজবাড়ির বলরামপুরের আনসার মন্ডলের মেয়ে শাহনাজ(২৬), নড়াইলের চররামসিদ্ধির কাওছার শিকদারের মেয়ে নেহার(২৪), খুলনার বটিয়াঘাটার সোহরাব হোসেনের মেয়ে জমিলা খাতুন(২২), যশোর মনিরামপুরের হামিদ গাজীর মেয়ে খাদিজা (২১), সাতক্ষীরা কালিগঞ্জের জহুর আলী বিশ্বাসের মেয়ে শিল্পী (২৩) লোমহর্ষক এতথ্য জানায়। তারা আরো জানায়, তাদের মত আরো শতাধিক যুবতী, তরুনী ভারতের বিভিন্ন শেল্টার হোমে মানবেতর জীবন যাপন করছে দেশে ফেরার আশায়।
ভারতে পাচার হওয়া এই পাঁচ বাংলাদেশী যুবতীকে বেনাপোল সীমান্ত পথে হস্তান্তর করেছে। দীর্ঘদিন ভারতের বিভিন্ন কারাগারে এবং বিভিন্ন শেল্টার হোমে আশ্রয়ে থাকার পর অবশেষে দেশে ফিরেছে তারা। ভারতের এনজিও ‘সংলাপ’ বনগাঁ থানা এবং হরিদাসপুর বিএসএফ এর সহযোগিতায় যুবতীদের বালাদেশে ফেরৎ পাঠায়। বাংলাদেশের পক্ষে বেনাপোল বিডিআর কোম্পানীর কমান্ডার , চেকপোস্ট বিডিআর ক্যাম্পের নায়েব সুবেদার , ইমিগ্রেশন ওসি পোর্ট থানার পুলিশ তাদের গ্রহণ করে। বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি ২০০৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর মাসের স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ে ভারতীয় বিভিন্ন হোম এবং কারাগারে আটক ১৬ জন বাংলাদেশী নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে এনে নিজ ঠিকানায় পৌঁছে দেয়ার আবেদন করে। এ আবেদনের আদেশের প্রেক্ষিতে পুলিশ এবং বিডিআর বাংলাদেশে প্রত্যাগত ৫যুবতীকে জাতীয় মহিলা আইনজিবী সমিতির যশোর শাখার কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করে। ভারতীয় পুলিশ সূত্র জানায়, দীর্ঘ ৪বছর পূর্বে বাংলাদেশী এ সকল যুবতীরা দালালের খপ্পড়ে পড়ে ভাল কাজের আশায় ভারতে পাচার হয়ে যায়। এক বছর পূর্বে দিল্ল¬ী এবং মুম্বাই থেকে ভারতীয় গোয়েন্দা পুলিশ এদের আটক করে। পরবর্তীতে ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সংলাপের আশ্রয় হোমে তাদের আশ্রয় হয়।
পাচারের পরের কাহিনী- পাচারকৃত নারীদের নিশ্চিতভাবে পতিতাবৃত্তিতে নিয়োগ করে থাকে। কিন্তু এই পেশা থেকে অর্জিত টাকা পাচারকারিদের পকেটেই চলে যায়। প্রথমে রাজী না হলেও তাদের এ ব্যবসায় জোর করে নামানো হয়। কতক সংখ্যক নারীকে আবার বাসাবাড়ীতে দাসী হিসেবে কাজে লাগানো হয়। আর ছেলে শিশুদের লালন-পালন করা হয়, এ শিশুদের বয়স বৃদ্ধির সাথে এরা তাদের পিতামাতার নাম ভুলে যায়। এদের দিয়েই অপরাধমূলক কাজ সংগঠিত করানো হয়। যারা অপরাধমূলক কাজ করতে চায়না, তাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিয়ে ব্যবসা করা হয়। তাদের চোখ, কিডনী, হৃদপিন্ডের ভাল্বসহ বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করা হয়। মানবদেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ব্যবসা কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজনের জন্য ভারত বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়। ভারতে যত অল্প টাকায় এবং স্বল্প পরিশ্রমে কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন করা সম্ভব হয় তা বিশ্বের আর কোথাও সম্ভব নয়। ১৯৮৫ সালের ১৭ মার্চ ভারতীয় পাক্ষিক ম্যাগাজিন ‘প্রতিক্ষণ’ “বিহারে মাথার খুলির ব্যবসা” সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। ঐ রিপোর্ট মতে বিশ্বের কংকাল, খুলি আর হাড়ের চাহিদার ৮০ শতাংশ যায় ভারত থেকে। এই ৮০ শতাংশের ৬০ ভাগ যোগান দেয় বিহার। রির্পোট অনুসারে মানুষের হাড়-গোড় রফতানিতে ভারতই শীর্ষে। অপহৃত অবাধ্য নারী ও শিশুদের হত্যা করে তাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করা হয় ভারতে। পরে তা বিদেশে রফতানি করা হয়। পাচার হওয়া নারী ও শিশুদের নিয়ে মাফিয়ারা পৈশাচিক খেলায় লিপ্ত থাকে।
যে কারণে নারীও শিশু পাচার হয়ঃ গরীবদেশের নাগরীকেরা দারিদ্রের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে মাফিয়াদের খপ্পরে পরে উন্নত জীবনের আশায়। অপহৃতাদের পাচারকারীরা বিভিন্ন লোভ দেখিয়ে উদ্বুদ্ধ করে। কাউকে ভাল কাজ জুটিয়ে দেয়া, কাউকে গৃহপরিচারিকার কাজসহ বহু চাকুরীর লোভ দেখায় পাচারকারীরা। এ লোভের বশবতী হয়ে বিশেষত গরীব মানুষ তাদের ফাঁদে আটকে যায়। পরে তারা বুঝতে পারে তাদের সাথে চরম প্রতারণা করা হয়েছে। কিন্তু তখন তাদের আর কিছুই করার থাকেনা। তাদের যে পতিতাবৃত্তিতে নামানো হবে তা তারা পূর্বে কল্পনাও করতে পারেনি, কিন্তু ঘটনা সেদিকেই এগোয়। ফলে এক সময় হতাশা, মৃত্যুই শুধু তাদের ভর করে। আবার অনেক সময় প্রেম ভালবাসায় প্রতারিত, অবমূল্যায়িত , যৌতুকের শিকার, স্বামী পরিত্যক্তা নারীরাও সহজেই এদের খপ্পরে পরে ও জীবন নষ্ট করে।
নারীও শিশু পাচার প্রতিরোধঃ নারীও শিশু পাচার প্রতিরোধে সমাজের সকলকে সচেতন হতে হবে। পাচারের পরিণতি সম্পর্কে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাপক প্রচারনা চালাতে হবে। এক্ষেত্রে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিড়িয়ার বিরাট ভুমিকা রয়েছে। এব্যাপারে জাতীয় ঐক্যমত এবং আর্ন্তজাতিক সম্মিলিত পন্থা বা নীতি প্রণয়ন করতে হবে। পাচারকারিদের সাথে জড়িত মাফিয়াদের বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করাতে হবে, তবেই এসমস্যা প্রশমিত হবে ধীরে ধীরে। সব চেয়ে বড় কথা জনসচেনতার কোন বিকল্প নেই। আইন শৃংখলা রক্ষাকারি বাহিনীদের ও এব্যাপারে সচেতনতায় আগ্রহী করতে হবে। আর হারিয়ে যাওয়া বা পাচার হয়ে যাওয়া শিশুদের উদ্ধারে সরকারকে আর্ন্তজাতিক মহলের সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় বিভিন্ন দেশে পাচারকারিদের হাত থেকে এদেশী নারী ও শিশুদের ঐদেশীয় পুলিশ উদ্ধার করে। কিন্তু দেখা যায় পাচার হওয়া এসব হতভাগ্যদের উদ্ধারের পরও তাদের আত্মীয় স্বজনের কাছে হস্তান্তরে আইনি জটিলতায় পড়তে হয়। বিদেশে এদেশীয় রাষ্ট্রদূতদের এব্যাপারে আরো বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে।
নারী ও শিশু পাচারের মতো ঘৃণিত কাজ আর নেই। কারণ এর মাধ্যমে হাজার হাজার নারীও শিশুর জীবনে নেমে আসে চরম দূর্ভোগ। এ অপরাধ দমনে সরকারের পাশাপাশি সমাজের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া এ অপরাধ সমাজ থেকে তাড়ানো অসম্ভব। তাই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নারী ও শিশু পাচার রোধ করা একান্ত জরুরী।
0 comments:
Post a Comment