প্রসঙ্গ : ছাত্র রাজনীতি ও একটি পরিসংখ্যান
আলী ফোরকান
ছাত্র জীবন মানুষের সর্বোৎকৃষ্ট সময়। তাই ছাত্রদের দায়িত্ব ও কর্তব্য খুব সামান্য নয়। যদিও অধ্যয়নই ছাত্রদের সাধনা। তথাপি তাদের দায়িত্ব শুধু অধ্যয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। স্বাধীন দেশের ছাত্রদের দায়িত্ব ও কতর্ব্য ক্ষেত্র বিশেষে অনেক বেড়ে যায়। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায় যে, যখনই কোন নব ব্যবস্থা প্রর্বতনের উদ্দীপনা জেগেছে, তখনই ছাত্রসমাজ হয়েছে সেই কর্মক্ষেত্রের মূখপাত্র। রাশিয়া, চীন, তুরস্ক প্রভৃতি দেশের ছাত্র সমাজ নিজ নিজ দেশের নবজাগরণে পুরোপুরি অংশগ্রহণ করে দেশের উন্নতি সাধনে ভূমিকা রেখে চলেছে। আমাদের দেশেও ছাত্র সমাজ বিভিন্ন সময়ে গৌরবময় অবদান রেখেছে।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ’র মতে, ছাত্র রাজনীতি যদি অতীতের মতো গৌরবজনক হয় তাহলে ছাত্ররাতো রাজনীতি করবেই। আর যদি অসৎ উদ্দেশ্য থাকে, অসৎ উদ্দেশ্যে কাজ করে তাহলে সে রাজনীতি করা শুধু ছাত্ররা কেন কারোরই কাম্য নয়। যারা একসময় বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন করেছে, পাকিস্তান আন্দোলন করেছে, ভাষা আন্দোলন করেছে, চৌয়ান্ন সালের যুক্তফ্রন্টের আন্দোলন করেছে, সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন করেছে, মুক্তিযুদ্ধে অকাতরে রক্ত দিয়েছে তাদের সম্পর্কে রাজনীতি করা আর না করা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে কেন? আমাদের মতো স্বল্প সচেতন সমাজে সৎ রাজনীতির ক্ষেত্রে একমাত্র ছাত্ররাই অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করতে পারে। তিনি বলেন,এ আমার গত ৬৫ বছরের রাজনীতির অভিজ্ঞতা। কিন্তু কথা হলো এতোদিন পর এ প্রশ্ন উঠছে কেন? এ প্রশ্নের ক্ষেত্রে যারা এখন রাজনীতি করেন তাদের চেয়ে ছাত্ররা কম দায়িত্বশীল বলে আমি মনে করি না। যাদের কারণে কিছু ছাত্র রাজনৈতিক পার্টিগুলোর লেজুরবৃত্তি করতে প্রলুব্ধ হয় তাদের কাছে এ প্রশ্ন উত্থাপন করা অবান্তর। ছাত্ররা কখনো রাজনৈতিক পার্টির অঙ্গ সংগঠন ছিল না। তারা ছিল গণসংগঠন। তারা ছিল স্বাধীন, তারা যে কোন সিদ্ধান্ত স্বাধীনভাবে নিয়েছে। সেটাকে অঙ্গসংগঠন করলো কে? বিশেষ উদ্দেশ্যে পিপিআর দিয়ে এটাকে অঙ্গসংগঠন করা হলো। এ প্রসঙ্গে বর্তমান ছাত্র রাজনীতির তথা অপরাজনীতির দোষ দিয়ে লাভ কি। তাদের মূল সংগঠনগুলোইতো সৎ, নীতি, আদর্শের রাজনীতি বাদ দিয়ে অসৎ, চক্রান্ত, অপরাজনীতি, ব্যবসার রাজনীতিতে লিপ্ত। তাই বলবো কেহ যদি রাজনীতির নামে অসৎ রাজনীতি, চক্রান্ত, দুর্নীতি, ব্যবসা ইত্যাদি বুঝে থাকেন তাহলে এ ধরনের রাজনীতির নামে অপরাজনীতি শুধু ছাত্ররা কেন কারোরই করা উচিত নয়।
অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান’র মতে, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ছাত্রদের গৌরবজনক ভ‚মিকা সর্বসম্মত। তবুও বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে স্বাধীনতা-পূর্ব ছাত্র রাজনীতি এবং স্বাধীনতা পরবর্তী ছাত্র রাজনীতির স্বরূপ একরকম হওয়ার কথা নয়। আমার মনে হয় দেশের চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মতো ছাত্ররা নিজেরাও এ বিষয়ে একমত। সুতরাং ছাত্র রাজনীতিকে গঠনমূলক দিকে পরিচালিত করার উদ্যোগ ছাত্রদের কাছেও প্রশংসনীয় হবে। তাই বর্তমান সরকারের ছাত্র রাজনীতির গঠনমূলক দিকে পরিচালনার উদ্যোগ সফলকাম হবে। এই বিষয়টি গ্রহণের আগে ছাত্রদের মতামত জানা প্রয়োজন। ছাত্ররা নিজেরাই হয়তো বুঝতে পারছে যে, স্বাধীনতা পূর্ব ছাত্র রাজনীতি এবং স্বাধীনতা পরবর্তী ছাত্র রাজনীতির স্বরূপ একরকম নয়। তাই ছাত্ররাও চায় ছাত্র রাজনীতির একটা পরিবর্তন আসুক। উপসংহারে আমি বলতে চাই যে, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা যাবে না, এটা কোন না কোন রকমভাবে থাকবেই। এটা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকারী আইনের চেয়ে বেশী দরকার রাজনীতিবিদদের মধ্যে ছাত্র রাজনীতি সম্বন্ধে একটা সমঝোতায় আসা। রাজনীতিবিদদের নিজেদেরই বুঝতে হবে দেশের কথা ভেবে, দেশের মঙ্গলের জন্য, কোন ধরনের ছাত্র রাজনীতি থাকবে। রাজনীতিবিদদের নিজেদেরই উচিত হবে ছাত্রদেরকে দলীয় রাজনীতিতে না টানা। এ বিষয়ে সরকার যে আইন প্রণয়নের চেষ্টা করছে তার উপর রাজনীতিবিদদের মতামত নেয়া যেতে পারে। তাহলেই আইনটা যথাযথভাবে পালন করা হবে। ছাত্র রাজনীতি এমনভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত যার মধ্যদিয়ে মেধাবী ও সৎ ছাত্ররা নেতৃত্ব দিয়ে আসতে পারে। বার বার রাজনীতিবিদরা এ বিষয়ে নিশ্চুপ থাকার কারণেই ছাত্র রাজনীতি পরিবর্তন সম্ভব হয়নি। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট চিন্তা করলে মনে হয় যে, তত্ত¡াবধায়ক সরকারের বর্তমান উদ্যোগ সফলকাম হতে পারে। এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছাত্রদের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য হতে পারে এবং আশা করি বিষয়টির উপর ছাত্ররাও গুরুত্ব দিতে একমত হবে।
সমাজ বিজ্ঞানী ড. মীজানূর রহমান শেলী’র মতে, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচার, স্বৈরতন্ত্র ও উচ্ছৃঙ্খলতা থেকে রাজনীতিকে মুক্ত ও স্বাধীন করা সময়ের অন্যতম দাবী। এ লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল, নির্বাচন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া এবং সরকার কাঠামো পদ্ধতির নানাবিধ সংস্কারের কথা ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। সংস্কারের দাবী উঠেছে ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রেও। রাজনীতিতে যাঁরা সংশ্লিষ্ট এবং যাঁদের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা নেই এমন অনেকেই বলছেন যে, কিছুকালের জন্য হলেও ছাত্র (এমনকি শিক্ষকদের) রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা উচিত। অনেকে আবার এতখানি চরম পদক্ষেপ গ্রহণের পক্ষপাতি নন। তাঁরা মনে করেন যে, ছাত্র রাজনীতির সুনির্দিষ্ট সীমা এবং অবয়ব থাকা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরা অবশ্যই রাজনীতি-সচেতন থাকবেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি তাদের আনুগত্য এবং সমর্থনও থাকতে পারে। ছাত্র-স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ন জাতীয় নীতি এবং কার্যক্রমের ব্যাপারে তাঁদের চিন্তা-ভাবনা থাকা স্বাভাবিক। অনুমত এবং অহিংস পন্থায় দাবী আদায়ের অধিকারও নাগরিক হিসাবে তাদের থাকা উচিত। তবে রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট কর্মকান্ড যেন তাদের লেখাপড়ার ব্যাঘাত না ঘটায়। কিন্তুু যাঁরা ছাত্র রাজনীতিকে সীমিত পর্যায়ে রাখতে চান তারা মনে করেন যে, ছাত্র সংগঠন ও ছাত্র সংস্থাগুলোর রাজনৈতিক দলের লেজুরে পরিণত হওয়া কাঙ্খিত নয়। কোন ছাত্র সংগঠনেরই বিশেষ কোন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন হিসাবে কাজ করা বাঞ্চনীয় নয়। ছাত্র রাজনীতির উগ্র দলীয়করণ ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাক্তিগত ও সামষ্টিক শিক্ষা জীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। শিক্ষাঙ্গনে বিশৃঙ্খলা ও ব্যাপক সহিংসতার জন্ম দেয়। ফলে শিক্ষার পরিবেশ কলুষিত হয়। শিক্ষাদান ও গ্রহণের প্রক্রিয়া হয় বিপর্যস্থ। দুঃসহ সেশন জটে শিক্ষা জীবন অনাকাঙ্খিতভাবে দীর্ঘ হয়। শিক্ষার মানের মারাত্মক অবনতি ঘটে। পরিণতিতে জাতির ভবিষ্যত ভয়াবহ হুমকি ও সংকটের কবলে পড়ে। সন্দেহ নেই যে, বিজ্ঞ পর্যবেÿক এবং বিশ্লেষকদের এ ধরনের চিন্তার বাস্তব ভিত্তি ও যুক্তি-যুক্ততা রয়েছে। কিন্তুু প্রশ্ন হলো বাস্তব ঐতিহাসিক ও সমকালীন পরিস্থিতিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা অথবা কঠোরভাবে সীমিত করা কতখানি সম্ভব ও বাঞ্চনীয় ? বিশ্ব এবং আঞ্চলিক প্রেক্ষিতে রাজনীতিতে যুব সমাজ বিশেষত ছাত্র সমাজের অনস্বীকার্য ভূমিকা রয়েছে। গত শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকে রাজনৈতিকভাবে উন্নত ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বিভিন্ন দেশ যথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং জার্মানীসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশেও জাতীয় রাজনীতির বৈপ্লবিক পরিবর্তনে ছাত্র সমাজ সক্রিয় ভূমিকা রাখে। ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ছাত্র সমাজ সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ফ্রান্সে দ্যা’গলের আমলে শিক্ষার্থীরা প্রবল আন্দোলনের মাধ্যমে সেদেশের রাজনৈতিক ও সরকারী কাঠামোর যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করে। উপমহাদেশে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্র সমাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রাক-১৯৭১-এর পাকিস্তানে বাংলাদেশের বাঙ্গালীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলন ও মুক্তি সংগ্রামে এ অঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীরা গৌরবময় ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২-র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ’৬১ থেকে ’৬৩, ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ৬৯ থেকে ’৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশের বাঙ্গালীর স্বাধীকারের আন্দোলন ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র-ছাত্রীরা অগ্রণী ভূমিকা রাখে। স্বাধীনতা উত্তরকালে বিভিন্ন সময়ে ছাত্র সমাজ স্বৈরতন্ত্রবিরোধী এবং গণতন্ত্রের লেবাসধারী স্বেচ্ছাচারী শাসনের বিরুদ্ধেও সফল সংগ্রামে অংশ নেয়। এ ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত স্মরণে রাখলে বিধিনিষেধ আরোপ বা বল প্রয়োগ করে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ বা সীমিত করার প্রচেষ্টা বাস্তবে কতটা কাঙ্খিত বা সফল হতে পারে সে সম্পর্কে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। একথা ঠিক যে, প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ, শিক্ষক সমাজ, অভিভাবকবৃন্দ এবং ছাত্র-ছাত্রীদের নেতা-নেতৃরা একমত হয়ে যদি ছাত্র রাজনীতিকে কাঙ্খিত সীমানার মধ্যে এনে এতে শান্তি শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা দেবার চেষ্টা করে তাহলে সে প্রয়াস সফল হতে পারে। এজন্যে দরকার সুচিন্তিত এবং পরিকল্পিত পদক্ষেপ। সুবিন্যস্তভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকার, বিশেষত: শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষায়াতনগুলোর সহায়তা নিয়ে কাঙ্খিত সংস্কারের লক্ষ্যে প্রাথমিক উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। ঈস্পিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য নীবিড়, ব্যাপক ও অর্থবহ আলোচনা ও ভাব বিনিময় অবশ্য প্রয়োজন। মূল বিষয়টি ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ বা সীমিত করা নয়। আসলে যা প্রয়োজন তা হলো জাতীয় রাজনীতির মত ছাত্র-রাজনীতিকেও দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও অন্ধ-রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তির কবল থেকে মুক্ত করা। এই উদ্দেশ্য সাধনে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়। গত শতাব্দীর ৪০, ৫০ বা ৬০ এর দশকে ছাত্র-রাজনীতির এবং নেতৃত্বের যে চরিত্র ছিল তা আজকের থেকে ভিন্ন। তখনও যে কলুষ কিছু ছিল না এমন নয়। কায়েমী স্বার্থের দালাল ছাত্র নেতা বা সংগঠনের অংশ-বিশেষের অস্থিত্ব সেকালেও ছিল। কিন্তুু এ ধরনের ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সংখ্যা ও প্রভাব ছিল অতি সীমিত। ব্যাপক গণআন্দোলনের প্রবল জোয়ারে এরা সহজেই ভেসে যেত। যে নেতৃত্ব ছাত্র সমাজকে ইতিবাচক, প্রগতিশীল ও উন্নয়নকামী রাজনীতিতে সামিল করতে সক্ষম হতো তা ছিল ত্যাগী মনোভাব ও সুসংস্কৃতিতে ভূষিত। সেকালে আদর্শের প্রতি আনুগত্য ছিল, যোগ্য নেতৃত্বের মাপকাঠি। নেতৃস্থানীয় ছাত্র-ছাত্রীরা রাজনীতিতে অংশ নিত স্বেচ্ছাসেবী মনোভাব নিয়ে। অর্থলোভ, পদলোভ বা প্রভাবের আকর্ষণ তাদেরকে রাজনীতির সোপান বেয়ে বিত্ত লাভ বা ব্যক্তিগত ভাগ্য উন্নয়নের পঙ্কিল পথে নিয়ে যেতে পারেনি। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ছাত্র রাজনীতির বর্তমান পরিকাঠামো ও পরিবেশের আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। জাতীয় রাজনীতির মত ছাত্র রাজনীতিকেও অবৈধ অর্থবিত্ত এবং অসহনীয় সন্ত্রাসের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। এ বিষয়ে ব্যবস্থাপত্র দেওয়া যত সহজ বাস্তব সাফল্য অর্জন তত সহজ নয়। তাই বক্তৃতা বিবৃতি ও ফাঁকা উপদেশের কথামালা দিয়ে কাজ হবে না। নিষিদ্ধকরণ বা কঠোরভাবে সীমিতকরণের নেতিবাচক আইন-কানুন, বিধিরীতি নয়, ইতিবাচক পদক্ষেপের মাধ্যমে ছাত্র সমাজের রাজনীতি বিষয়ক মনোভঙ্গীর পরিবর্তনের মাধ্যমেই ছাত্র রাজনীতিকে পরিশীলিত ও পরিশ্র“ত করা সম্ভব।
শিক্ষাবিদ ড. এম শমসের আলী’র মতে, বাংলাদেশের সমাজের উপর ছাত্র রাজনীতির একটা প্রভাব অনেক আগে থেকেই দেখা গেছে। বৃটিশ খেদানো আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণআন্দোলন, ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ’৯০-এর গণআন্দোলনে ছাত্ররা একটি উজ্জ্বল ভ‚মিকা রেখেছে। এতে কোনই সন্দেহ নেই কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে যে, এসব আন্দোলনে কোন রাজনৈতিক দলের ছাত্র-ছাত্রীরা এককভাবে অংশ নেয়নি। সব দল ও মতের ছাত্র-ছাত্রীরা দেশের স্বার্থে একযোগে কাজ করেছে। আবারও যদি কোন সময় প্রয়োজন হয় তবে ছাত্র সমাজ এ ধরনের যে বলিষ্ঠ ভ‚মিকা রাখবে তাতে কোনই সন্দেহ নেই। কিন্তু যখন ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার কথা বলা হচ্ছে তখন কিন্তু ছাত্রদের নিজস্ব কর্মক্ষেত্রের রাজনীতি বন্ধ করার কথা বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, তারা যেন কোন রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তি না করে। ছাত্রদের নিজস্ব একটা রাজনীতি তো থাকবেই। তারা যদি লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখে পর্যাপ্ত বই নেই, তারা যদি ক্লাসে গিয়ে দেখে শিক্ষক অন্যত্র কনসালটেন্সি নিয়ে ব্যস্ত, তারা যদি হোস্টেলে গিয়ে দেখে তাদেরকে খাঁচার মুরগির মতো ঠাসা-ঠাসি করে বাস করতে হচ্ছে, তারা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের যানবাহনের সুবিধা না পায়, তারা যদি সুইমিংপুলে গিয়ে দেখে যে ওখানে পুল আছে পানি নেই, ট্রেনারও নেই তবে তারা যদি আন্দোলন করে তবে সেই আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থন অবশ্যই থাকবে। এধরনের আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্রদের অধিকার সংরক্ষণের দাবি মোটেই অগ্রাহ্য মনে করা যায় না। কিন্তু তারা তাদের নিজেদের লেখাপড়া ও সুবিধা-অসুবিধার কথা না বলে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তি করে রাস্তায় ভাংচুর করবে, জনজীবনে বিঘœ ঘটাবে, এটা কোন স্বাধীন দেশের ছাত্র সমাজের ভ‚মিকা হতে পারে না। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে রাজনৈতিক দলগুলো এদেরকে আর টুল হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ পাবে না। যেটা তারা এখন করে আসছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসেন। সুতরাং তাদের যদি কোন সমস্যাই থাকে তবে তা জনগণকে সাথে নিয়ে মোকাবিলা করতে পারেন। ছাত্রদেরকে দাবার ঘুটি হিসেবে ব্যবহার করে নয়। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সব দল ও মতের ছাত্র-ছাত্রী একসঙ্গে হয়ে একটা সেন্ট্রাল ইউনিয়ন গঠন করবে যার মাধ্যমে তারা তাদের লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতি বিষয়ক চর্চা করতে পারবে। এটাই সারা পৃথিবীতে একটা স্বীকৃত পন্থা। আমাদের এখানে আগেও এটাই ছিল। যত শীঘ্র এ সিস্টেম চালু হয় ততই ছাত্র সম্প্রদায় ও দেশের জন্য মঙ্গল। তাই ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির কোন অবকাশই নেই। সাধারণ ছাত্রদেরও বোঝা উচিত যে তারা এই মা-বাবার কষ্টার্জিত পয়সায় পড়াশোনা করতে এসে নিজের কাজ না করে যদি রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থে কাজ করে তাহলে কি তারা সত্যিই নিজেদেরকে গড়ে তুলতে পারবে? লেখাপড়ায় ভাল না হলে নিজ পেশায় উৎকর্ষ সাধন না করলে তারা নেতা হবে কেমন করে? সুতরাং এ বিষয়টি নির্মূহভাবে বিবেচনা করতে হবে সবাইকে। ছাত্ররা দেশের একটা বড় সম্পদ। তাদেরকে এভাবে নষ্ট করা ঠিক হবে না। আজ যখন একবিংশ শতাব্দিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের এমনকি আমাদের প্রতিবেশি দেশসমূহেও তারুণ্যের শক্তি ব্যবহার করে কম্পিউটার সাইন্স, বায়টেকনোলজি, ফার্মেসি, ভাষা জ্ঞান, অর্থনৈতিক প্রভৃতি বিষয়ে ছাত্ররা তাদের জ্ঞান চর্চার সুযোগ পাচ্ছে এবং অসাধারণ মেধার পরিচয় দিচ্ছে সেখানে আমরা শুধু আমাদের ছাত্র সমাজকে একটি আন্দোলনের আবর্তে রেখে দিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করবো এ হতে দেয়া যায় না। বাংলাদেশের ছাত্ররা যখনই পৃথিবীর অন্যত্র গেছে তারা সেখানে তাদের সমসাময়িক ছাত্র-ছাত্রীর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পেরেছে। তাই আমাদের তরুণ সমাজের প্রতি আমাদের এখন যে দায়িত্ব তাহচ্ছে, তাদেরকে শুধু দেশের জন্য নয়, বিশ্বের জন্য সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। আমাদের এখনকার যুগকে আমরা বলছি নলেজ ইকোনোমি। নলেজই হচ্ছে এখন ডেভেলপমেন্টের জন্য, উন্নয়নের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট কাঁচামাল। তাই নলেজে আমাদের ছাত্রদের ঘাটতি আছে অনেক। আমরা হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্টের কথা বলি এবং আমাদের যে বৈদেশিক মুদ্রা আসে তার অধিকাংশই অদক্ষ শ্রমিক পাঠানোর মাধ্যমে। আমরা যদি বিভিন্ন পেশায় দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে পারি তাহলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার অর্জন বহুগুণে বেড়ে যাবে। বিশ্বের দরবারেও আমাদের জাতি হিসেবে আমাদের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বলতর হবে। তাই আর লাফালাফি নয়, লাঠালাঠি নয়, ঢিল ছোড়াছুড়ি নয়, অস্ত্রের ঝনঝনানি নয়, পরিশ্রম, জ্ঞান, ও যুক্তি তর্কের মাধ্যমে ছাত্র শক্তিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে একটা শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এটাই সময়ের দাবি। কালক্ষেপণের সময় আমাদের আর নেই।
(তথ্যসুত্র বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক)
0 comments:
Post a Comment