Saturday, December 28, 2013

বাংলাদেশের চারপাশে ভয়ংকর অগ্নিকুন্ড

বাংলাদেশের চারপাশে ভয়ংকর অগ্নিকুন্ড

ড. ফোরকান আলী
বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ বার্মা (মায়ানমার) পরমানু কর্মসূচী গ্রহন করেছে মর্মে সম্প্রতি দুনিয়া কাঁপানো একটি খবর দিয়েছে আল জাজিরা টেলিভিশন। প্রচারিত ওই সচিত্র প্রতিবেদনটি বিশ্বব্যাপী অসংখ্য টেলিভিশন চ্যানেল যেমন দেখিয়েছে, পাশাপাশি প্রিন্ট মিডিয়ায়ও ফলাও করে খবরটি প্রচারিত হয়েছে।
বাংলাদেশের অতি নিকটতম প্রতবেশী দেশ বার্মা। দীর্ঘ প্রায় চার দশকের সামরিক শাসনে দেশটির অর্থণীতি, রাজনীতি ও সামাজিক অবস্থা যেমন বিপর্যচ্চ হয়ে পড়েছে, তেমনি সামরিক শাসকদের গোয়ার্তুমির কারণে প্রায় বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে বার্মা। বার্মার এ দুরবস্থা আর দুঃসময়কে কাজে লাগায় আয়তনে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ, উদীয়মান অর্থণৈতিক পরাশক্তি চীন। প্রাচ্যের বৃহৎ এ দেশটি যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, তার অর্থণৈতিক শক্তি যাতে পাখা মেলতে না পারে সেজন্য তাইওয়ানকে হাত করে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে সমুদ্র উপকুল যাতে স্বাভাবিকভাবে ব্যবহারের সুযোগ না পায় তা নিশ্চিত করতে বার্মাকেও বগলদাবা করার উদ্যোগ নেয় মার্কিণ প্রশাসন। বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেই বর্মী সামরিক জান্তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বর্মী শাসকদের পেছন থেকে প্রয়োজনীয় সবরকমের শক্তি যোগাতে শুরু করে চীন। চীনের এ কৌশলকে ভন্ডুল করতে ‘গণতন্ত্র’ নামক অস্ত্রটি ব্যবহারের পথ বেছে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। তারা বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের ডামাডোল বাজিয়ে বিশ্ববাসীকে বোকা বানানোর চেষ্টা করে। গণতন্ত্রের লেবাস গায়ে লাগিয়ে তারা বিরোধী নেত্রী অংসান সূচীকে ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়। তাকে দিয়ে মার্কিণ প্রশাসন বার্মার সামরিক শাসকদের মত্চ্যুত করতে নানামুখী চেষ্টা চালায়। মার্কিণীদের এ অপতৎপরতা বুঝতে পেরেই বর্মী শাসকরা অংসান সূচীকে গৃহবন্দী করেন। যুক্তরাষ্ট্রের এ অপতৎপরতা ব্যর্থ হওয়ায় দেশটির বৌদ্ধ ভিুদের উস্কে দেয় মার্কিণ গোয়েন্দা সংস্থা। কিন্তু শাসকদের কঠোর অবস্থান এবং আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে তরিৎ কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ফলে সেযাত্রা আন্দোলন হালে পানি পায়নি। কিন্তু তারপরও বার্মার পিছু ছাড়েনি মার্কিণ প্রশাসন। তারা নানাভাবে দেশটিকে যেমন বিরক্ত করছে, তেমনি বার্মাকে মুঠোবদ্ধ করে চীনকে কোনঠাসা করার প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের এই হীন উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেই বার্মাকে সব ধরণের সাপোর্ট দেয়ার পথ বেছে নেয় চীন। একই সঙ্গে মার্কিণীদের চুসূল উত্তর কোরিয়ার প্রতিও সহযোগিতার হাত বাড়ায় চীন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, চীনের ল্য হচ্ছে প্রাচ্যে চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, বার্মাসহ আরো যেসব দেশ মার্কিণ অত্যাচারের শিকার সেসব রাষ্ট্র নিয়ে একটি শক্তিশালী মার্কিণবিরোধী বলয় সৃষ্টি করা। উত্তর কোরিয়াকে পরমানু কাবে ওয়েলকাম জানিয়ে সে বলয় রচনার প্রথম ধাপ রচিত হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। আর দ্বিতীয় ধাপে শুরু হচ্ছে বার্মাকে পারমানবিক শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিনত করা।
চীন যদি এ ধরণের পারমানবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো নিয়ে একটি মার্কিণ বিরোধী জোট গঠনের উদ্যোগ নেয় তা কি অন্যায় হবে ? এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে একক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। বিশ্বজুড়ে তার শক্তির ডানা বিচ্চৃত হয়। শক্তির মদমত্ততায় বহু শান্তিপ্রিয় দেশে অশান্তির দাবানল ছড়িয়ে দিয়ে ফায়দা লুটতে শুরু করে মার্কিণ প্রশাসন। ভেঙ্গে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি দেশের অধিকাংশই মার্কিণ খপ্পড়ে পড়ে। বাকি দেশগুলোতে  একের পর এক গণঅসন্তোষ সৃষ্টি করে রুশপন্থী শাসকদের যেমন বিব্রত ও বিরক্ত করে, তেমনি জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন, দণি কোরিয়া ও তাইওয়ানকে বগলচাপা করে চীনকে বিরক্ত করা, জাপান উপকুল, প্রশান্ত মহাসাগর, ভারত মহাসাগরে মার্কিণ উপস্থিতি ও সমরশক্তি বৃদ্ধি কিছুতেই বরদাচ্চ করছে না চীন। শুধু তাই নয়, বার্মাকে গেটওয়ে হিসেবে ব্যবহার করে ভারত মহাসাগর ব্যবহারের চীন যে সহজ পরিকল্পনা করছে সে েেত্রও নানাভাবে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের এসব স্বেচ্ছাচারী কর্মকান্ডের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতেই বার্মাকে আরো শক্তিশালী ও মার্কিণ বিরোধী বেপরোয়া শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় চীন। আগামীতে এ উদ্যোগ ও পরিকল্পনা আরো বিচ্চৃত হলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবেনা। কিন্তু সেেেত্র বাংলাদেশের অবস্থান কি ?
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী দেশ বার্মা। বার্মার পারমানবিক কর্মসূচী গ্রহন বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে একটি উদ্বেগের বিষয়। কারণ, সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশ-বার্মা সম্পর্কের কিছুটা হলেও অবনতি ঘটেছে। বিগত তত্ত্ববধায়ক সরকারের সময় বাংলাদেশের নৌ-সীমানার অভ্যন্তরে সমুদ্রতলের তেল-গ্যাসসহ খনিজ সম্পদ আহরনের জন্য কুপ খননের  উদ্যোগ নেয় বার্মা। অন্যান্য জাহাজের সঙ্গে একাধিক যুদ্ধ জাহাজও পাঠায় তারা। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় যুদ্ধ জাহাজসহ সম্ভাব্য কুপ এলাকায় বাংলাদেশও শক্তি বৃদ্ধি করে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের এই কঠোর অবস্থান এবং পাশাপাশি কুটনৈতিক প্রচেষ্টায় পরিস্থিতির আর অবনতি ঘটেনি। বার্মা তার উপস্থিতি প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু এখানেইতো শেষ নয় ? পুনরায় এ অবস্থার যে সৃষ্টি হবেনা তার নিশ্চয়তা কোথায় ? একই সঙ্গে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক, হঠাৎ করে বার্মার এ যুদ্ধংদেহী অবস্থান কেন ?
বিগত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ মতাসীন হওয়ার পর অতিমাত্রায় ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের অর্থণীতি, রাজনীতি, প্রশাসনিক কাঠামো, সাংস্কৃতিক অবস্থান, ট্রানজিট, কানেকটিভিটি, ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুবিধাদান, এশিয়ান হাইওয়ের নামে ভারতকে একতরফা সুবিধা দেয়াসহ বিভিন্ন ইস্যুতে অতিমাত্রায় মাখামাখির কারণে বাংলাদেশের ওপর প্রচন্ড নাখোশ দীর্ঘ দিনের পরিীত দেশ চীন। বিশেষ করে এশিয়ান হাইওয়ের রুট পরিবর্তণের বিষয়টি চীন সহজভাবে নিচ্ছে না। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম-কবাজার থেকে বার্মার সঙ্গে এশিয়ান হাইওয়ের সংযুক্তিতে চীনের সম্মতি ছিল। কিন্তু আওয়ামী সরকার রাষ্ট্র মতায় বসেই মাত্র ৩/৪ মাসের মাথায় নির্ধারিত ওই রুট পরিবর্তণ করে সিলেট-করিমগঞ্জ রুটের পে ওকালতি শুরু করে এবং ওই রুট বাচ্চবায়নের উদ্যোগ গ্রহন করে। এসব কারণে বাংলাদেশের বর্তমান শাসককুলের ওপর নাখোশ চীন। ফলে বার্মাকে দিয়ে বাংলাদেশকে ডিস্টার্ব করার পথে যদি চীন হাঁটতে শুরু করে তাতে অবাক হওয়ার কি আছে।
১৯৭১ সালে স্বাধীণতা লাভের পর বাংলাদেশ যেমন একটি পশ্চাদপদ দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি পেয়েছিল, তেমনি সামরিক শাসনের যাতাকলে বার্মা ছিল বাংলাদেশের চাইতেও দরিদ্র একটি দেশ। দেশটিতে একের পর এক ধারাবাহিক সামরিক শাসনের ইতিহাস প্রায় ষাট বছরের। জাতিসংঘ ও মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচুকে উপো করে স্বীয় সিদ্ধান্তে অবিচল রয়েছে বর্মী শাসককুল। বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থাগুলোর সহযোগিতা ছাড়াই ‘একলা চলো নীতি’ গ্রহন করে বার্মা এগিয়ে গেছে এবং অব্যাহত মার্কিণ বিরোধীতার কারণেই দেশটি আজ পারমানবিক কাবে প্রবেশের চেষ্টা করছে। অথচ সে তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে বহু যোজন দূরে। বিগত প্রায় চার দশকে বাংলাদেশে শুধুই রাজনৈতিক হানাহানি প্রত্য করেছে বিশ্ববাসী। বিশেষ করে প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলের পরস্পরের প্রতি অসহিষ্ণুতার কারণে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও বাংলাদেশের কাংখিত উন্নয়ন হয়নি। অথচ পশ্চাদপদ বার্মা আজ পরমানু শক্তিধর দেশের কাতারে নিজেদের শামিল করার উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও বর্মী কর্তৃপ বিষয়টি অস্বীকার করেছে। কিন্তু আল জাজিরায় প্রচারিত সচিত্র প্রতিবেদনে স্পষ্টতঃই পরমানু স্থাপনার কাজ এগিয়ে নিতে দেখা গেছে। তাছাড়া এ যাবতকালে বিশ্বের যেসব দেশ গোপনে পরমানু কর্মসূচী গ্রহন করেছে, পারমানবিক বোমা বানিয়েছে, শত শত পরমানু বোমার বিশাল মজুদ গড়ে তুলেছে, তারাও কোনদিন তাদের পরমানু কর্মসূচীর কথা স্বীকার করেনি। ইসরাইলের হাতে দু’শতাধিক পরমানু বোমার মজুদ থাকলেও আজো পর্যন্ত কর্তৃপ স্বীকার করেনি। আবার এনপিটিতেও স্বার করেনি। সুতরাং বর্মী কর্তৃপ তাদের পরমানু কর্মসূচীর কথা যতই অস্বীকার করুক গণমাধ্যমে প্রচারিত ছবিই প্রমান করে বার্মা তাদের পরমানু কর্মসূচী শুরু করেছে এবং তা দ্রুত এগিয়ে নিতে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান কি ?
বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনী গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে দেশের বিদ্যুত ঘাটতি পূরণ ও ক্রমাগত চাহিদা মেটানোর জন্য শান্তিপূর্ণ পরমানু কর্মসূচী শুরু করা হবে বলেও জানান। সেদিন অনেকেই আশানি¦ত হয়েছিলেন এই ভেবে যে, সময়ের চাহিদা ও দেশের নিরাপত্তার প্রতি ল্য রেখে সম্ভাব্য এ ‘কর্মসূচীকে’ আরো সামনে এগিয়ে নেয়া হবে। কিন্তু রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে আতুরঘরেই সে সম্ভাবনার মুত্যু ঘটে।
বর্তমান মতাধর আওয়ামী সরকারকে দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার স্বার্থে অবশ্যই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। চীনের সঙ্গে আলোচনা করে হয় বার্মার পরমানু কর্মসূচী বন্ধে প্রয়োজনীয় পদপে নিতে হবে। বার্মা তাতে রাজী নাহলে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহনে উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, হাত পা গুটিয়ে জলন্ত অগ্নিকুন্ডের ওপর বসে থাকলে শুধু পুড়েই মরতে হবে, অন্য কিছুই হবেনা। বাংলাদেশের প্রতিবেশী চীন, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্থান এরই মধ্যে পারমানবিক শক্তি অর্জন করেছে। ইরানের পারমানবিক কর্মসূচী নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের মাথাব্যাথার অন্ত নেই। বার্মাও একই পথ ধরে এগুচ্ছে। প্রাচ্যের আরো দু’একটি দেশের নাম শোনা যায়, যারা অতি সংগোপনে তাদের পরমানু কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের চারপাশেই এখন ভয়ংকর অগ্নিকুন্ড। অতএব সময়ের প্রয়োজনেই বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যার দাবি রাখে। অবস্থাটা এখন এমন দাঁড়িয়েছে, পারমানবিক শক্তি অর্জন, পরমানু বোমার অধিকারি হওয়া মানেই হচ্ছে, দেশের নিশ্চিত নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হওয়া। তাই সময়ের প্রয়োজনেই আমারা আমাদের দেশের নিশ্চিত নিরাপত্তা বলয় দেখতে চাই।

0 comments:

Post a Comment