স্মরণ : ধরলা নদীর তীরে ফিরে গেলেন সৈয়দ হক
আলী ফোরকান
‘এখন মধ্যরাত।
তখন দুপুরে রাজপথে ছিলো মানুষের পদপাত।
মিছিলে মিছিলে টলমল ছিলো সারাদিন রাজধানী।...
নিদ্রিত সব।
ওই একজন জানালায় রাখে তার বিনিদ্র হাত
ছিলো একদিন তার
উজ্জ্বল দিন, ছিলো যৌবন ছিলো বহু চাইবার।
সারা রাত চষে ফিরেছে শহর খুঁজেছে সে ভালোবাসা।
(‘এখন মধ্যরাত’, সৈয়দ শামসুল হক)
জন্ম : ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্ব
মৃত্যু : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬
সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর, কুড়িগ্রামে। পাঠকপ্রিয় এই কবি ২৭ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। সমাপ্তি ঘটে বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়ের। প্রসন্নতা, অগ্রগমন, রহস্যময়তা আর মাটিলগ্নতার কবি। কেবল কবি বলি কেন তাঁকে; তিনি কবিতা চাষের পাশাপাশি করেছেন গল্প-উপন্যাস-নাটক-প্রবন্ধের বীজ ও চারাগাছ। লালন করেছেন কাব্যনাট্যের বৃক্ষরাজি। প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল সাহিত্য সাধনায় সক্রিয় থাকার ব্যাপারটিও কোনো সামান্য ঘটনা নয়। সময়-পরিসরের বিবেচনায় যেমন, তেমনি সৃজন-অবদানের দিক থেকেও সৈয়দ হক সহজকথায় অসামান্য শিল্পপ্রতিভা। পূর্বপাকিস্তান, পূর্ববাংলা, বাংলাদেশ- এসব ক্যানভাস ছাড়িয়ে এখন তাঁর সাহিত্য আভা বিশ্বপ্রেক্ষাপটের বিরাট জমিনে দাঁড়িয়ে; শিল্পকথক সৈয়দ শামসুল হক যেন বাংলাদেশের এক উঁচু ভবন থেকে উচ্চারণ করছেন ভাবনা-প্রকাশের সূত্রাবলি, শিল্প-প্রকাশের মর্মবাণী। আর তা নানান তারে ছড়িয়ে পড়ছে দিগি¦দিক। দেখা-না-দেখা আর ধরা-না-ধরার সাহিত্যমায়া তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে যেন সেই ঘোরলাগা প্রথম কবিতাপ্রহর থেকে- ‘রংগপুরের কনকরঙা মেয়ে/ হঠাৎ সাড়া জাগিয়ে দিয়ে লুকোয় পরান পণে।/ এই দেখেছি এই দেখিনি বৃষ্টি ভেজা মাঠ।’ তারপর থেকে তাঁর দুরন্ত যাত্রা- আজো যার দিক-নিশানা নেই; নেই সমাপ্তি ইঙ্গিত।
সৃজনযাত্রায় তাঁর সাধনা ‘চেতনার গূঢ় মূলে জল’, বীজ, শস্য, হাসি আর ‘উপদ্রুত হৃদয়ের বাঁধভাঙা ভক্তির বন্যা।
¯্রােতবাহী নদী তাঁকে খুব টানত। শৈশবে বাবার সাথে নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়াতেন। দেখতেন নদীর বিদ্রোহী রূপ। নদীর ভাঙনে তাঁদের গ্রাম তলিয়ে গেছে। একদিন তাঁর বাবা বললেন : ‘আমরা নদী থেকে দূরে ঘর বানিয়েছি।’ টিনের ঘর ছিল বাবার। দালান বাড়ির খুব শখ ছিল সৈয়দ হকের বাবার। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ২০১৪ সালে জন্মদিন উপলক্ষে কুড়িগ্রামে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কবি বলেছিলেন : ‘যদি আমি চলে যাই। চির শয়নের জন্য আমাকে এই কুড়িগ্রামে নদীর ধারে নিয়ে এসো।’ সৈয়দ শামসুল হক কবি। কাব্যনাট্যে তাঁর সাফল্য ঈর্ষণীয়। তবে উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতি শাখায় সাবলীল পদচারণা ছিল তাঁর। ‘সব্যসাচী লেখক’ হিসেবে তিনি পরিচিত। গীতিকারও ছিলেন তিনি। সাহিত্যচর্চা ছাড়াও মাঠে-ময়দানে, শিল্পের সভায় ও আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন সক্রিয়। ২৯ বছর বয়সে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। এখন পর্যন্ত বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া সর্বকনিষ্ঠ লেখক তিনি। পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বাংলা কাব্যনাটকের শৈল্পিক রূপায়ণে তিনি অবিকল্প নির্মাতা। লোক-ঐতিহ্য, ইতিহাস, সমকালীন রাজনীতি এবং জাতিগত অপার সম্ভাবনার বিরাট ব্যাপক ক্যানভাসে তিনি সাজিয়েছেন তাঁর নাটকের মঞ্চ ও যাবতীয় প্রাসঙ্গিক-আনুষঙ্গিক সাজসজ্জা। সাধারণ মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অসাধারণত্ব আর মানবিক গুণাবলি ও সৃজনশীলতার অন্বেষা এবং প্রকাশের দিকে সৈয়দ হকের ঝোঁক পরিলক্ষিত হয় সব সময়। তিনি যেন শক্তি ও সাহসের সমাচার লিপিবদ্ধকরণের শিল্পী; জেগে ওঠার গল্প বানানোর দক্ষ ও অভিজ্ঞ কারিগর। সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় বাস্তবতার বিশ্বস্ত বিবরণ আছে, আছে প্রতিবাদ, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনার চিত্র, আছে প্রবল আশাবাদ; বিষণ্নতার আড়ালে তিনি অনায়াসে নির্মাণ করতে পারেন প্রসন্নতার দারুণ ইতিহাস। বৃষ্টিস্নাত মাঠে কবি রোপণ করে চলেছেন কবিতার মোহময়তা-স্নিগ্ধতা আর সৌকর্য। সৈয়দ হকের কবিতা তাই আমাদেরকে আশান্বিত করে, উদ্যমী করে; গতিশীল করে আমাদের চিন্তাযন্ত্রকে প্রসারিত করে আমাদের বিচরণভূমির আবছাজমিন।
নাটকের প্রতি হৃদয়ের টান এবং ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটক রচনার পরিপ্রেক্ষিত, ঘটনাপ্রবাহ ও কার্যকারণ সম্বন্ধে সৈয়দ হক লিখছেন- “ভাষা মাধ্যমে নাটক আমার সবশেষের সংসার; অথচ, এখন পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই, নাটকের জন্য আমি তৈরি হয়ে উঠছিলাম সেই ছোটবেলায় বালকের বিস্ময় নিয়ে লেখা ভোরের শেফালী ফুল আর দেয়ালে ঝোলানো বিবর্ণ তাজমহল বিষয়ে দু’টি পদ্য রচনারও বহু আগে- আগে এমনকি আমার এই আমিকে অনুভব করে উঠবার। একেক মানুষ বয়সের একেক কালে তার আমির সাক্ষাৎ পায়; আমার বেলায় তা একটি অসুখের (টাইফয়েড) পর, যখন সবাই বলছিল ‘এ যাত্রা এ শিশু টিকে গেলে হয়’; এবং টিকে যখন গেলাম, এক স্বর্ণলতার মতো আলোর ঝুরি নামা ভোরে বলে উঠলাম ‘আমি বেঁচে আছি তাহলে’- ঐ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমি নাটকের দোলা অনুভব করে উঠি আমার শোণিতে, এখন শনাক্ত করতে পারি।’ (ভূমিকা, কাব্যনাট্য সংগ্রহ, ফেব্রুয়ারি ১৯৯১) ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ কাব্যনাটকটির শুরুতে গ্রামবাসীর সমবেত কণ্ঠের এক উচ্চারণ এ রকম : ‘মানুষ আসতে আছে যমুনার বানের লাহান/...মানুষ আসতে আছে বাচ্চাকাচ্চা-বৌ-বিধবা বইন/...কই যাই কি করি যে তার ঠিক নাই/...বাচ্চার খিদার মুখে শুকনা দুধ দিয়া/...খাড়া আছি খালি একজোড়া চক্ষু নিয়া।’
সৈয়দ হক শৈশবে যাত্রাপাগল মানুষ বাবার সাথে শীতের রাতে ভ্রাম্যমাণ যাত্রাদলের পালা দেখেছেন, কুড়িগ্রামের শৌখিন যুবকদের বাৎসরিক নাট্যাভিনয় উপভোগ করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার কালে অকালে পিতাকে হারিয়ে জীবিকার জন্য বিদেশী বেতার-নাটকের অনুবাদ করেছেন; অতঃপর মৌলিক নাটক লিখে সামান্য সাহস সঞ্চয় করে নাটকের উদার উঠানে প্রবেশ করেছেন। কবিতার ভাবজগতে বিচরণ করতে করতে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বাংলা নাটকের বিকাশের এক বিশেষ সময়-পরিসরে তিনি নাটকে ভাবনার স্থিতি স্থাপন করলেন।
টি এস এলিয়টের কাব্যনাট্যচিন্তা দ্বারা প্রভাবিতও হয়েছেন খানিকটা। আর সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের মাটির গন্ধে ও বাতাসের প্রবাহে লেগে-থাকা নাট্য-আবহ ও সঙ্গীতের তোড়ে ভেসেছেন তিনি মানসিকভাবে; শ্রমজীবী মানুষের জীবনাচার, রাজনৈতিক স্লোগান, ময়মনসিংহ গীতিকা প্রভৃতি বিষয় ও বাস্তবতা সৈয়দ হককে নাটকের ভাষা-কাঠামো এবং পরিবেশনশৈলীর উপাদান জুগিয়েছে।
তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’। ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘নীল দংশন’, ‘বারো দিনের জীবন’, ‘তুমি সেই তরবারী’, ‘কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন’, ‘নির্বাসিতা’, ‘জনক ও কালোকফি’ বিখ্যাত উপন্যাস। কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘একদা এক রাজ্যে’, ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’, ‘পরানের গহীন ভিতর’, ‘অপর পুরুষ’, ‘অগ্নি ও জলের কবিতা’। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নুরলদীনের সারা জীবন’ ‘উত্তরবংশ’ তাঁর কাব্যনাট্য। আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা ও নাটক লেখায় হকের সাফল্য সবার জানা। আর তাঁর কবিতার আবৃত্তি-যোগ্যতাও নজরে পড়ার মতো। মঞ্চে এবং প্রেম রাজনীতির ময়দানে সৈয়দ হকের কবিতার সরব উপস্থিতি পরিচিত প্রসঙ্গ। বহুলপঠিত ‘পরানের গহীন ভিতর’ কবিতা থেকে খানিকটা পাঠ নিচ্ছি- ‘জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,/ চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,/ মানুষ বেকুব চুপ, হাটবারে সকলে দেখুক/ কেমন মোচড় দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর।
/ চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,/ বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পূর্ণিমার চান,/ নিজেই তাজ্জব তুমি- একদিকে যাইবার চাও/ অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টা।/সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না,/ খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানের ইচ্ছায় দেখায়,/ ডাহুক উড়ায়া দিয়া তারপর আবার ধরে না,/ সোনার মোহর তার পড়া থাকে পথের ধূলায়।/এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর/ যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর।’
দেশের আর ভাষার গণ্ডি ছাড়িয়ে, আজ ক্রমাগত তাঁর পরিচিতি বিশ্বসাহিত্যের বিরাট পরিসরের দিকে প্রসারিত। সাহিত্যপথে দীর্ঘদিনের পরিভ্রমণে তাঁর অবদান আর অর্জনের প্রকৃত মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। চেষ্টা যে চলছে না, তা নয়; তবে প্রাতিষ্ঠানিক আর গবেষণাভিত্তিক আরো প্রচেষ্টার উদ্যোগ দরকার। দেশমাতা আর মাতৃভাষার প্রতি নিবিড় শ্রদ্ধাশীল এই শিল্পী-প্রতিভা বরাবরই সত্য আর বর্তমানের জিজ্ঞাসা রূপায়ণে নিষ্ঠাবান। ইতিহাস-ঐতিহ্য তাঁর সাহিত্যবোধের একটি প্রধান অনুষঙ্গও। উনিশ শ’ একাত্তর, পাকিস্তান-বাংলাদেশ প্রসঙ্গ, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অর্জনের সংগ্রাম, প্রতিকূলতা-অনুকূলতা, আসন্ন সম্ভাবনাস্রোতলীন মানুষ, বিপরীত স্রোতের মানুষ, সৃজনশীল সমাজের প্রত্যাশা-প্রচেষ্টা, বিবর্ণতা আর আনন্দ-বিষণœতার গল্প সৈয়দ শামসুল হকের সাহিত্য-পরিসরের বিষয়-আশয়।
সৈয়দ হকের ‘এপিটাফ’ কবিতার পাঠ নিতে নিতে আজকের লেখাটি শেষ করতে চাই- ‘আমি কে তা নাইবা জানলে।/ আমাকে মনে রাখবার দরকার কি আছে?/ আমাকে মনে রাখবার?/ বরং মনে রেখো নকল দাঁতের পাটি,/ সন্ধ্যার চলচ্চিত্র আর জন্মহর জেলি।/ আমি এসেছি, দেখেছি, কিন্তু জয় করতে পারিনি।/ যে কোনো কাকতাড়–য়ার আন্দোলনে,/ পথিক, বাংলায় যদি জন্ম তোমার,/ আমার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাবে ॥/একেই বুঝি মানুষ বলে/ নষ্ট জলে পা ধুয়েছো এখন উপায় কি?/ আচ্ছাদিত বুকের বোঁটা চুমোয় কেটেছি।/ কথার কোলে ইচ্ছেগুলো বাৎসায়নের রতি,/ মানে এবং অন্য মানে দুটোই জেনেছি।/ নষ্ট জলে ধুইয়ে দেবে কখন আমার গা,/ তোমার দিকে হাঁটবে কখন আমার দুটো পা?/ সেই দিকে মন পড়েই আছে, দিন তো হলো শেষ;/ তোমার মধ্যে পবিত্রতার একটি মহাদেশ/ এবং এক জলের ধারা দেখতে পেয়েছি- /একেই বুঝি মানুষ বলে, ভালোবেসেছি।’
0 comments:
Post a Comment