স্মরণ :শরৎ চন্দ্র চট্টোপধ্যায়
আলী ফোরকান
জন্ম : ১৮৭৬ সালে
মৃত্যু : ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি।
শরৎ চন্দ্র চট্টোপধ্যায় বাংলা সাহিত্যের একজন অমর কথাশিল্পী। আগামী ১৬ জানুয়ারি তাঁর ৭৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৮৭৬ সালে তিনি হুগলী জেলার দেবানন্দনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব ও প্রথম জীবন কাটে ভাগলপুরে মাতুলালয়ে। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি হুগলী হাইস্কুল ও ভাগলপুরে দুর্গাচরণ এমই স্কুলে অধ্যায়ন করেন। টিএন জুবিলি কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রাস (১৮৯৪) পাসের পর একই কলেজে এফএ শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে তাঁর শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটে।
শরৎ চন্দ্রের প্রথম উপন্যাস বড়দিদি (১৯০৭) প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে সাহিত্য জগতে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তিনি একে একে বিন্দুর ছেলে অনন্যা (১৯১৪), পরিণীতা (১৯১৪), পল্লী সমাজ (১৯১৬), দেবদাস (১৯১৭), চরিত্রহীন (১৯১৭), নিষ্কৃতি (১৯১৭), শ্রীকান্ত (৪ খণ্ড), গৃহদাহ (১৯২০), দেনা পাওনা (১৯২৩), পথের দাবি (১৯২৬), শেষ প্রশ্ন (১৯৩১), নারীর মূল্য (১৯২৩)Ñ এগুলোর মধ্যে শ্রীকান্ত, চরিত্রহীন, গৃহদাহ, দেবদাস, পথের দাবি খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। শরৎ চন্দ্রের জীবন ও সাহিত্য অবিচ্ছেদ্য। জীবনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তাঁর সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করেছে। বলিষ্ঠ আদর্শবান অনুসরণ চরিত্র চিত্রণ শরৎ সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য। জীবনের চলার পথে মানুষকে তিনি শুধু চোখ দিয়ে দেখেননি, প্রাণ দিয়ে দেখেছেন, ভালোবাসার দৃষ্টি দিয়ে, মায়া আর মমতার দর্পণে। এই দেখা থেকে যেসব চরিত্র তিনি সৃষ্টি করেছেন, তা যেমন জীবন্ত, তেমনি প্রাণস্পর্শী। তাঁর প্রতিটি লেখা যেন প্রাণের রঙে চিত্রিত। শরৎ চন্দ্র বলেছেন, মানুষের মৃত্যু আমাকে ততখানি আঘাত দেয় না, যতখানি দেয় মনুষ্যত্বের মৃত্যু।
তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয় পল্লী জীবন ও সমাজ, ব্যক্তি মানুষের মন, পল্লী সংস্কারাচ্ছন্ন, মানসিকতার আঘাতে কতটা রক্তাক্ত হতে পারে তারই রূপচিত্র এঁকেছেন তিনি তাঁর রচনায়। মুসলমান সমাজের প্রতি তাঁর গভীর মমতাবোধ ও শ্রদ্ধা তুলনাহীন।
তার কালজয়ী ছোটগল্প মহেশ (১৯২৬), শুরুতে এভাবে বিবরণ দিয়েছেন- গ্রামের নাম কাশিপুর, সীমানার ধারে গফুর মিয়ার বাড়ি। পূজা সেরে তর্করতœ দুপুর বেলায় বাড়ি ফিরছিলেন। পথের ধারে পিটালী গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তর্করতœ উচ্চ কণ্ঠে ডাক দিলেন, ওরে গফুর বলি ঘরে আছিস। তার ১০ বছরের মেয়ে আমিনা দুয়ারে দাঁড়িয়ে সাড়া দিলো কেন বাবাকে? বাবার যে জ্বর। ডেকে দে তাকে। হাঁক ডাকে গফুর ঘর থেকে বের হয়ে জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে কাছে এসে দাঁড়াল। একটা পুরাতন বাবলা গাছের ডালে বাঁধা একটি ষাঁড়। তর্করতœ দেখে কহিল এটা হচ্ছে কি শুনি, এ হিন্দুর গাঁ ব্রাহ্মণ, জমিদার সে খেয়াল আছে। তার মুখখানা রাগে রক্তবর্ণ। সে মুখ দিয়ে তপ্ত কথা বের করতে লাগল। কিন্তু হেতুটা বুঝতে না পেরে গফুর শুধু চেয়ে রইল। অন্য দিকে, মহেশকে নিয়ে জ্বালাতনের শেষ নেই। দড়ি ছিঁড়ে মাঝে মাঝে পালিয়ে যায়। একজন প্রতিবেশী তাকে খোঁয়াড়ে দিলো। জরিমানা দিয়ে গফুর তাকে ছাড়িয়ে আনল। গফুর মহেশকে বিক্রি করে দিতে চাইল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্রেতাদের তাড়িয়ে দিলো। গফুরের দু’বেলা খাবার জোটে না। উপোস কাপষে তার দিন কাটে। একদিন মজুরি খাটতে গিয়ে কাজ না পেয়ে গফুরও ফিরে এলো। ভাতের ব্যবস্থা না থাকায় গফুর রেগে গিয়ে আমিনাকে বকাবকি করল ও তার গালে চড় লাগিয়ে দিলো। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে পানি আনতে গেল। জমিদারের পেয়াদারা গফুরকে ধরে নিয়ে গেল। প্রচণ্ড মারধর খেয়ে সেখান থেকে ফিরে গফুর বিছানায় শুয়ে পড়ল। এমন সময় একটি আর্তচিৎকার তার কানে এলো। বেরিয়ে এসে গফুর দেখল আমিনার পানি ভরা কলস মহেষ গুঁতো মেরে ভেঙে দিয়েছে। আর মাটি থেকে ষাঁড় পানি চুষে নিচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে গফুর জ্ঞানশূন্য হলো। লাঙলের মাথা দিয়ে মহেষের মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করল। সে আঘাতে মহেষ পড়ে গেল এবং তার মৃত্যু হলো। আমিনা মহেষের মৃত্যুতে কেঁদে উঠল। সেই রাতেই গফুর গৃহত্যাগ করল। সে ফুলবেড়ের চটকলে কাজ করতে যাবে। মেয়ে আমিনার হাত ধরে মহেষের শোকে সে হুহু করে কেঁদে উঠল। গফুর সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচার দিয়ে বলল, হে সৃষ্টিকর্তা! তোমার দেয়া পানি যারা মহেষকে খেতে দেয়নি তারা কশুর। বিধাতা যেন তাদের কখনো ক্ষমা না করেন।
শরৎ চন্দ্রের কাহিনী নির্মাণে অসামান্য কুশলতা এবং শৈল্পিক, অতি প্রাঞ্জল ও সাবলীল ভাষা তাঁর কথাসাহিত্যে জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির প্রধান কারণ। বাংলাসহ বিদেশে বিভিন্ন ভাষায় তাঁর অনেক উপন্যাস চিত্রনাট্য নির্মিত হয়েছে। সেগুলো অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য শরৎ চন্দ্র কুন্তলীন (১৯০৩), জগধাত্রিনী স্বর্ণপদক (১৯২৩), বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ (১৯৩৪), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিলিট উপাধি (১৯৩৬) লাভ করেন।
শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাস্তব অভিজ্ঞতার ছাঁকুনিতে ফেলে নিপুণ কলমের আঁচড়ে মমতার রস ঢেলে সেই চিত্র অঙ্কন করেছেন। শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন একজন যোগ্য শিল্পীর মতো। তাই সময়ের প্রেক্ষাপটে বিচার করলে আজো বাংলা সাহিত্যে চিরসবুজ একটি নাম শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।॥
এই কথাশিল্পী আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তি নিকেতনে শরৎ চন্দ্রের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে রয়টার প্রতিনিধিকে বলেন, জিনি বাঙালির জীবনের আনন্দ ও বেদনাকে একান্ত অনুভূতি দ্বারা চিত্রিত করেছেন আধুনিককালে সেই প্রিয়তম লেখকের মহা প্রয়াণে দেশবাসীর সাথে আমিও গভীর মর্মবেদনা অনুভব করছি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৬১ বছর চার মাস। তিনি মরেও অমর।
0 comments:
Post a Comment